'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
মেহেরুল হাসান সুজন আজ শিক্ষকদের বিচারের রায় ঘোষণা শেষে এই ব্লগে একখানা পোস্ট দিয়েছে। সেই পোস্টটাতে সে লিখেছে, তার বিভাগের ৩ শিক্ষককে আদালত জেল দিয়েছে। সে কারণে তাদের মন খারাপ। এই পোস্টটার প্রথম মন্তব্যটি নামিরা নামের একজনের। তিনি লিখেছেন, 'আপনার শিক্ষকরা নিশ্চয় এমন কিছু করেছেন, যাতে তাদের শাস্তি হয়েছে।
'
আদালতের রায় যদি এই মন্তব্যের মূল ভিত্তি হয়, তাহলে ধরে নেয়া যায়, এক ধরণের অপরাধ এই শিক্ষকরা করেছেন বলেই সাজাটা পেয়েছেন। তারমানে ৪ শিক্ষক অপরাধটা করেছেন। কেবল এই ৪ জনই ওই মামলায় আসামী ছিলেন না, ছিলেন আরো ২ জন। এদের একজন প্রফেসর সাইদুর রহমান খান, অন্যজন প্রফেসর আবদুস সোবহান। ৬ জনের বিরুদ্ধেই একই অভিযোগ ছিলো।
কিন্তু মামলার রায়ে দেখা গেলো, বাকি দু'জন (প্রফেসর খান ও সোবহান বেকসুর খালাস)। ফিরে যাই নামিরার কাছে। তার মন্তব্যের ভিত্তি যদি আদালতের রায় হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রফেসর খান ও প্রফেসর সোবহান কোনো অপরাধ করেননি। যাক, ২৩ আগস্ট রাতে কথা বলার জন্য বাসা থেকে বয়োবৃদ্ধ এই ২ শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাবার পর ১০ দিনের রিমান্ড। সেই রিমান্ড আবার রাজশাহীতে হবে না।
নিয়ে যেতে হবে টিএফআই সেলে ঢাকায়। ২৮ তারিখে সেখানে নিয়ে আবার ৩০ তারিখেই ব্যাক। আবার ১০ দিনের বিশাল বপুর রিমান্ডের প্রয়োজন মাত্র ৬ দিনেই ফুরিয়ে যাবার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই তাদের আদালতে দেয়া। যাক গে সেসব, আমরা সেসবের যৌক্তিকতা কিংবা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার আশপাশ দিয়েও যাবো না। ওরে বাবা, তা কি যাওয়া সম্ভব! তার চেয়ে বরং আসুন দেখি, নামিরার বলা সেই শিক্ষকদের করা 'এমন কিছু'টা কী ছিলো।
আসুন আদালতে যাই। আদালত ৫৫ মিনিট ধরে যে রায়টা ঘোষণা করলেন, সেখানে বলেলন, জরুরী বিধিমালা ২০০৭ এর ৪ (৩) ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভে প্ররোচনা ও উষ্কানির যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। জরুরী বিধিমালা ২০০৭ এর ৮ (২) ধারা অনুযায়ী বিক্ষোভের পূর্বে শলা-পরামর্শের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাও প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে যে ২১ আগস্ট জরুরী বিধিমালা ২০০৭ এর ৩ (৪) ধারা ভঙ্গ করে ক্যাম্পাসে মৌনমিছিল হয়েছিলো। সেই মিছিলে ব্যবস'াপনা বিভাগের সাবেক সভাপতি মলয় কুমার ভৌমিক, গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, সেলিম রেজা নিউটন ও আবদুল্লাহ আল মামুন অংশ নেয়ার কারণে আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৫ (২) ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ৪ শিক্ষককে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো একমাসের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন।
এছাড়া অভিযুক্ত শিক্ষক প্রফেসর সাইদুর রহমান খান ও আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে জরুরী বিধিমালা ভঙ্গের কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন।
তারমানেটা খুবই পরিষ্কার। মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলে যারা বলে বসেন, শিক্ষকরা ক্লাশ না করিয়ে খালি রাজনীতি করায়, গোপনে ষড়যন্ত্র করে- তাদের কথার গ্রহণযোগ্যতা এ রায়ে ভীষণ কম। কারণ প্রথমতঃ কোনো ম্যাসাকারে শিক্ষকরা ইন্ধন দেননি। কোনো গোপন শলাপরামর্শও তারা করেননি।
অথচ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিচার প্রকি্রয়া থেকে শুরু করে সব সময় শিক্ষক প্রসঙ্গ এলেই এই প্ররোচনা ও উস্কানির কথাটা উঠে আসে। তাহলে আদালতে যখন প্রমাণ হলো, তারা এই দু'য়ের কোনোটিই করেননি, এরপর নিশ্চয় এই অপবাদ থেকে অন্ততঃ তাদের রেহাই মিলবে। এবার আসুন মৌন মিছিলটির প্রসঙ্গে, যে মিছিলটিতে অংশ নেয়ার কারণে ৪ শিক্ষকের সাজা হলো। মিছিলটির উদ্দেশ্য ছিলো খুবই পরিষ্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ আগস্ট সংঘটিত ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের বহিপ্রকাশ। লক্ষ্য করুন আদালত তার রায়েই কিন্তু সুস্পষ্ট বলে দিচ্ছে, ওই দিন মৌনমিছিল হয়েছিলো।
তার মানে মিছিলে কোনো জঙ্গী শ্লোগান তো ছিলোই না, মিছিল ছাড়া মিছিলকারী শিক্ষকদের অন্য কোনো নীলনকশাও (উস্কানি বা প্ররোচনা) ছিলো না। আদালত এই মিছিলটির জন্যও হয়তো সাজা দিতেন না। কিন্তু মিছিলটি হয়েছিলো জরুরি অবস্থার মধ্যে এবং আদালত মনে করেছে, এই মিছিলে অংশ নেয়ার কারণে ৪ শিক্ষক জরুরি বিধিমালা ভঙ্গ করেছেন। ব্যস, বিষয়টির ইতি টানা যায়। আইনের দৃষ্টিতে শিক্ষকরা কতোটুকু অপরাধ করেছেন, তা তো পরিষ্কারই।
এবার আসুন নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করি, রাষ্ট্রীর আইনের মারপ্যাচ বাদে নৈতিকতার দিক থেকে তাদের অপরাধটি কি একেবারেই আকাশ ছোঁয়া সাইজের?
শেষবেলায় ছোট্ট একটা কথা। রাজনীতি করেন বলতে যা বোঝায়, সেইরকম শিক্ষক আসলে এই ৬ জনের মধ্যে খালাস পাওয়া দু'জন ছিলেন- সাইদুর রহমান খান আর আবদুস সোবহান। দু'জনই আোয়ামী ও বাম সমর্থিত শিক্ষক ফোরামের নেতা। আর বাকি ৪ শিক্ষকের কেউই ওই অর্থে প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।