"অবশ্যই আমার নামাজ আমার এবাদাত আমার জীবন আমার মৃত্যু সবকিছুই সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহর জন্যে। "
প্রশ্ন : মহানবী (স.)-এর হাদীসে রয়েছে, তোমাদের কারো পাত্রে যদি মাছি পড়ে তবে তাকে চেপে ধরো। কারণ মাছির এক পাখায় রয়েছে রোগ অন্য পাখায় রয়েছে প্রতিষেধক।
এই হাদীস কি সহীহ বোখারী ও মুসলিমে রয়েছে? কেউ যদি এই হাদীস অস্বীকার করে সে কি ইসলাম থেকে খারিজ বিবেচিত হবে? বর্তমান যুগে কোনো কোনো চিকিত্সক এই হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। কেউ কেউ এই হাদীস নিয়ে উপহাস করছে, কারণ আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাছির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে।
এ যাবত কেউ মাছিকে প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করেনি। অথচ হাদীসে বলা হয়েছে, মাছির একটি পাখায় প্রতিষেধক রয়েছে। আশা করি সন্তোষজনক জবাব দেবেন।
উত্তর : সংক্ষেপে আমি কয়েক প্যারায় জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো।
১. এই হাদীস সহীহ কিন্তু বোখারী ও মুসলিম শরীফ দুটোতে এই হাদীস নেই।
উপরোক্ত হাদীস শুধুমাত্র বোখারীতে রয়েছে। সকল যুগের ওলামায়ে কেরাম কোরআনের পরে বোখারী শরীফকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করেছেন।
২. দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে, এই হাদীসে দ্বীনের কোনো মৌলিক নীতিমালার আলোচনা করা হয়নি, আকীদা বিষয়ক কোনো কথাও এখানে বলা হয়নি, দ্বীনের ফরযের কোনো কথাও বলা হয়নি। হালাল-হারামের বিবরণ দেয়া হয়নি। কোনো মুসলমান যদি এই হাদীসটি সম্পর্কে নাও জানে, তবু তার দ্বীনদারীতে কোনো ক্ষতি হবে না।
তার আকীদা বিশ্বাসে কোনো প্রকার ত্রুটি হবে না। কিন্তু এই হাদীসকে ভিত্তি করে পুরো দ্বীন ইসলামকে ঠাট্টাবিদ্রুপ এবং উপহাসের বিষয় করা কোনোক্রমেই সঠিক হবে না।
৩. এই হাদীস যদিও সহীহ শ্রেণীভুক্ত, কিন্তু এই হাদীস হাদিসুল আহাদের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিক (মোতাওয়াতের) ভাবে এই হাদীস বর্ণিত হয়নি। একজন রাবী এই হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হাদীসুল আহাদ সম্পর্কে হাদীস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে যে, এই হাদীস পরিপূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যতার মর্যাদায় উন্নীত হবে নাকি ধারণাপ্রসূত হিসেবে চিহ্নিত হবে। কাজেই কোনো মুসলমান যদি এই শ্রেণীর হাদীস অস্বীকার করে অথবা এই শ্রেণীর হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তবে সেই মুসলমানকে ইসলাম থেকে খারিজ বলা যাবে না। তবে এই হাদীসকে ভিত্তি করে কেউ যদি সমগ্র দ্বীন ইসলামকে উপহাসের বস্তুতে পরিণত করে, তবে নিঃসন্দেহে তাকে ইসলাম থেকে খারিজ বিবেচনা করতে হবে।
৪. কথা থেকে যায় যে, চিকিত্সা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলা যায় কিনা। আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে, বহু সংখ্যক বিজ্ঞানী এই হাদীসের সমর্থনে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর আমীন রেজা ১৯৭৭ সালে 'আত তাওহীদ' নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন।
৪.ক. কোনো ব্যক্তি এই অধিকার রাখে না যে, রসূল (স.)-এর কোনো হাদীসকে এই ভিত্তিতে অস্বীকার করবে যে, যে হাদীস চিকিত্সা বিজ্ঞানের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। কারণ আধুনিক জ্ঞানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। উন্নতির এই ধারায় আধুনিক জ্ঞান এবং আদর্শের অহরহ পরিবর্তন হচ্ছে। আজ একটি মতামত সঠিক প্রমাণিত হলে কালই সেই মতামতকে ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
৪.খ. সুস্থ বিবেকের সম্মতি পায় না এই অজুহাতেও উপরোক্ত হাদীস বা অন্য যে কোনো হাদীস অস্বীকার করা সমীচীন নয়। হাদীস যদি বিবেকের সাথে সংগতিপূর্ণ না হয়, তবে সেটা আমাদের বিবেক বুদ্ধির দোষ, হাদীসের দোষ নয়। আমাদের বিবেক অপরিপক্ক আর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ। যেসব জ্ঞান এখনো আমাদের আয়ত্বে আসেনি সে জ্ঞান সীমাহীন এবং অসংখ্য। পক্ষান্তরে আমাদের আয়ত্বাধীন জ্ঞান সীমিত।
মানুষ যদি মনে করে তাদের জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করেছে, অনুসন্ধান এবং গবেষণার সকল বিষয় আয়ত্ব করে ফেলেছে তবে বুঝতে হবে যে, মানুষের জ্ঞানের মৃত্যু হয়েছে। কাজেই হাদীস যদি বিবেকের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে দোষ আমাদের বিবেকের। কারণ আমাদের বিবেক এবং জ্ঞানকে আরো অনেক পথ অগ্রসর হতে হবে।
৪.গ. এ কথা ঠিক নয় যে, মাছির মাধ্যমে চিকিত্সা করার ধারণা চিকিত্সা বিজ্ঞানে অনুপস্থিত। প্রাচীনকালে মাছির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চিকিত্সা করা হয়েছে।
আধুনিক যুগেও সার্জারীর বিভিন্ন শাখায় মাছির দ্বারা চিকিত্সা করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে এই উদ্দেশ্যে মাছি পালনও করা হতো, এই চিকিত্সার ভিত্তি হচ্ছে এই যে, মাছির মধ্যে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আবিস্কৃত হয়েছে যা জীবানুনাশক। জীবানু ধ্বংসের জন্যে সেই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হতো।
৪.ঘ. এই হাদীসে বলা হয়েছে যে, মাছির মধ্যে রোগজীবানু রয়েছে। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান মাত্র দুইশত বছর আগে এ বিষয়টি প্রকাশ করেছে।
৪.ঙ. এই হাদীসে আরো বলা হয়েছে যে, মাছিদের মধ্যে রোগ প্রতিষেধকও রয়েছে। অর্থাৎ এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেসব উপাদান জীবানুনাশক এবং মাছি যে বিষ গ্রহণ করে সেই বিষকে উক্ত উপাদান নষ্ট করে দেয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানীদের মতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাবৃদ্ধির পর একটি অন্যটির ওপর হামলা করে এবং একটি ব্যাকটেরিয়া অন্য ব্যাকটেরিয়ার জন্যে প্রাণঘাতী বিষাক্ত উপাদানের জন্ম দেয়। সেই বিষাক্ত উপাদান চিকিত্সার কাজে ব্যবহার করা হয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানের পরিভাষায় আমরা যাকে বলি এন্টিবায়োটিক।
প্রত্যেক যুগেই রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।
৪.চ. এই হাদীস তো এ কথা শিক্ষা দেয় না যে, আমরা যেন মাছি শিকার করি তারপর সেই মাছি পাত্রে চেপে ধরে ডুবিয়ে প্রতিষেধক গ্রহণ করি। এই শিক্ষাও আমাদের দেয় না যে, আমরা আমাদের থালা বাসন যেন খোলা রাখি, যাতে করে বেশী সংখ্যক মাছি উড়ে এসে বসতে পারে। বরং বহুসংখ্যক হাদীসে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং এর তাকিদ দেয়া হয়েছে।
৪.ছ. এই হাদীস এ রকম শিক্ষাও দেয় না যে, কারো খাদ্য এবং পানিতে মাছি বসার পর সেই ব্যক্তি ঐ খাদ্য এবং পানি খেতে ঘৃণা বোধ করলেও তাকে জোর করে খাইয়ে দিতে হবে।
কারো ঘৃণা হলে সহজেই সেই খাদ্য এবং পানি সরিয়ে ফেলতে পারে।
৪.জ. এই হাদীস মাছি মারার উপায় ও পদ্ধতি বন্ধ করার কথাও আমাদের শিক্ষা দেয় না। এ কথাও শিক্ষা দেয় না যে, আমরা যেন মাছি পান করি তারপর সেই মাছি দ্বারা প্রতিষেধক গ্রহণ করি।
*** জবাব দিয়েছেন শায়খ ইউসুফ আল কারদাওয়ী ***
*** অনুবাদ করেছেনঃ হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ ***
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।