জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
ছোটবেলা গাড়ি নিয়ে খেলেছি বলে মনে পড়ে না। খেলতাম হাড়ি পাতিল নিয়ে। ছোট ছোট লাল ইটের টুকরো ছিল রান্নার গোশতের টুকরো। পানিতে ছেড়ে দিলে কেমন একটা ছুক ছুকে শব্দ হতো, মায়ের রান্নার মত শব্দ ভেবে বিশেষ আমোদ পেতাম।
খেলতাম পুতুল। আমার একটা খরগোশ বাবু ছিল যেটা সব সময় গাজর খেত। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে পেন্সিল বক্সকে দোতালা বাড়ি বানিয়ে সেখানে শ্বাশুড়ি বউয়ের ঝগড়া ঝগড়ি খেলতাম। লেগো খেলতে গিয়েও দিব্যি বাড়ি বানিয়ে, তাতে বাবা মা ভাই বোনে ভরে ফেলতাম। কার কোন ঘর তার বিস্তারিত, সুনিখুঁত পরিকল্পনা থাকতো।
বড় বেলাতেও অনেক অনেক শখের মধ্যে কম্পিউটার গেইমস, এক্স বক্স খুঁজে পাই না। ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে মোটর রেইস বিরক্ত লাগে। শখ করে কারও সাথে কখনও লৌড় লাগালেও, সেটা অল্প সময়ের জন্যই।
এই আমির সাথে হিসাবে না মিললেও, গাড়ি চালাতে আমার খুবই ভালো লাগে।
গেইমসের গাড়ি চালানো না, সত্যি জীবনের গাড়ি চালানো।
সোজা চালানোতে আরাম আছে। কিন্তু বেশি আনন্দ পাই গাড়ির নানাবিধ মেন্যুভারে। সবগুলো আয়নায় দেখে, কৌণিক দুরত্ব, সোজাসোজি আর পাথালি দুরত্ব মেপে, গতিবেগ দেখে, নিপুণ দক্ষতার সাথে গাড়িকে জায়গা মত পৌঁছে দিতে দারুণ লাগে। কারও ড্রাইভিং খুব হিংসা করলে এই একটা জিনিসের জন্যই করি। কি ঝটপট দক্ষতায় গাড়িকে খেলনার মত খেলিয়ে বেড়ায়!
ড্রাইভিং শিখা শুরু করেছিলাম তিন বছর আগে।
ঢিম তেতালে একটু একটু ড্রাইভিং করতাম। দু'এক বার চালানো হতো। মাঝে মাস খানেক কোন খবর নেই। হয় আমার ইউনি থাকে না হয় বাসার সবাই ব্যস্ত থাকে। পরে আবার যখন স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসতাম, তখন ব্রেইক কই আর একসিলেটর কই ভুলে যেতাম।
'লার্নার্স' (মতান্তরে লুজারস) লাইসেন্সের নিয়মানুযায়ী, পাশে দক্ষ এক ড্রাইভারকে নিয়ে ৫০ ঘন্টা ড্রাইভ করে, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে, তবেই একলা চালানোর অনুমতি আছে।
গাড়ি চালাতে ভালো লাগলেও, এভাবে ড্রাইভ করতে কারও ভালো লাগে? ভালো লাগবে কি করে, লার্নার্স বলে সবাই এমন ভাব করতে থাকে, যেন যে কোন মুহূর্তে ট্রাকে চাপা পড়বো গাড়ি শুদ্ধা। কিংবা এমন কোন ভুল করেছি যে আমার মনুষ্য সমাজে থাকা উচিত না। আরে বাবা, প্রথম প্রথম তো ট্রাফিক আইল্যান্ডে গাড়ি একটু লেগে যেতেই পারে, পার্ক করার সময় ফুটপাথে টায়ার লাগতে পারে কিংবা অনেক গাড়ির মাঝে লেইন বদলাতে একটু ভয় লাগতেই পারে! ওদের কে বুঝাবে? যেন ক্লাস টেনে পড়ুয়াকে যোগ বিয়োগ শিখানোর মত কাজ নিয়ে পড়েছে!
লার্নার্স হিসেবে ড্রাইভ করার এইটা হলো এক নম্বর সমস্যা। আর দুই নম্বর সমস্যা হচ্ছে, এই লাইসেন্সের মেয়াদ সীমা ৩ বছর।
আমার ৩ বছর শেষ হওয়ার মেয়াদ সীমা যেখানে এই মাসের শুরুতেই। ৩ বছর শেষ হওয়ার আগে পরীক্ষা দিয়ে পাশ না করলে, নতুন লার্নার্স লাইসেন্স নিতে হবে, সেটায় আবার ১২০ ঘন্টা ড্রাইভিং থাকতে হবে! তাও কি, পরের পরীক্ষাটা দেয়ার আগে আমাকে ১ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আমি বাবা ৫০ ঘন্টা করেই কূল পাচ্ছি না, আবার ১২০ ঘন্টা, আমাকে এত শিখাবেটা কে? ২১ হয়ে গিয়েছি, এখনই পোলাপান 'লার্নার্স' ঝুলানো দেখলে চামে হেসে নেয়। শেষ মেষ দেখা যাবে যেই ড্রাইভিং এত শখ করে করি, সেটাতেই আমার প্রবল অনীহা চলে এসেছে। আমার এমন হয়, কোন কিছু করতে না পারলে সেদিকে দ্বিতীয়বার মুখ ফিরাই না।
তারিখ কাছাচ্ছে আর আমার ভয় বাড়ছে। এর মধ্যেই ৫০ ঘন্টা ড্রাইভ করে, পরীক্ষায় পাশ করে লাইসেন্স নিতেই হবে। এই পরীক্ষার ব্যাপারে আবার অনেক গল্প প্রচলিত আছে, খুব নাকি কঠিন। তখন ভয়ে ভুল ভাল হয়ে যায়। অনেক ছোট খাট ভুল ধরে।
চেনা একজন ৪ বারে পাশ করেছে, আরেকজন ২ বারে, আরেকজন পাশ করায় নি বলে রীতিমত মামলা করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে! সেই মামলায় হেরে আবার বিশাল বেইজ্জতি।
এত্ত কিছু শুনে ভয় উত্তোরত্তর বাড়ছে। ইউনির পড়াশোনার চাপে সময়ই পাচ্ছিলাম না ড্রাইভিঙের।
কিন্তু তব ভাবলাম পরীক্ষা দিয়েই দেখি, পাশ করলে ভালো, না করলে... না হয় এক জীবনে ড্রাইভিং না-ই করলাম! কত ভালো লাগাই তো আমরা বিসর্জন দেই... এ তো সামান্য ড্রাইভিং!
পরীক্ষার তারিখ ছিল গত কালের তারিখ। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক ৫ দিন আগের তারিখ।
পরীক্ষার আগের রাতে, আমার ঝুলিতে কাঁটায় কাঁটায় ৫০ ঘন্টা।
আর বুক জুড়ে প্রবল, প্রবল, তীব্র ভয়।
সব হিসাব করে দেখি, পরীক্ষায় পাশ না করাটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু পাশ না করলে...!
হয় ড্রাইভিং ছেড়ে দাও (কাছের মানুষদের সারা জীবন বিব্রত করো) আর না হয় আরও ১ বছরে ড্রাইভিং শিখে নাও (কাছের মানুষদের অন্তত: ১ বছরের জন্য বিব্রত করো)! নানা জায়গায় গাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন হলে হয় বন্ধুদের না হয় বাসার মানুষদের ধরতে হয়। মানুষকে এত বিব্রত করতে ভালো লাগে না।
বোঝা হয়ে থাকতে খুব, খুব অস্বস্তি হয় আমার। একটু স্বাধীনচেতা হওয়ার বোধ হয় এটাই অসুবিধা।
অথচ, পাশ না করার সম্ভবনা প্রবল। পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি সেই পেনরিথ। রাস্তাটাস্তা কিচ্ছু চিনি না।
চেনা রাস্তায় গাড়ি চালাতে যেই আত্মবিশ্বাস, সেটা খুঁজে পাব না।
সব মিলিয়ে, ভীষণ মানসিক চাপে পড়ে গেলাম! আগের রাতে, সারাটা রাত ঘুম হলো না একদম। একটু চোখ লেগে আসতেই কোথুকে মনে পড়ে, কালকে পরীক্ষা! লাফ দিয়ে উঠে যাই, বুক ধড়ফড় করতে থাকে! পাশ না করলে!!! রাত আড়াইটায় বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। ভাইয়াকে ঘুমাতে না দিয়ে গল্প করলাম এক ঘন্টা। তবু, ভয় কাটে না।
সকালে রেডি হয়ে ভাবলাম একটু গাড়ি চালিয়ে হাত খেলিয়ে নেই। পরীক্ষার আগের দিন গোটা দশের রিভার্স পার্কিং করেছিলাম (সেটাই নাকি সবচেয়ে কঠিন পার্কিং, যদিও আমার মজা লাগে, কিন্তু অনেক দক্ষতার প্রয়োজন আছে)। প্রত্যেকটা খুব সুন্দর হয়েছিল, একদম সোজা গাড়ি, ফুটপাথের যতটা কাছে থাকা উচিত, ঠিক ততটা কাছে। অথচ পরীক্ষার দিন সকালে তিনবার চেষ্টা করলাম রিভার্স পার্কিঙের। ভয়াবহ খারাপ হয়েছে।
আমার গাড়ি আঁকাবাঁকা হয়ে রাস্তার পাশে মুখ বেদন করছিল। আমার শিক্ষক, বাবার মুখ দেখে বুঝলাম বেচারা হতাশ হয়েছে ভীষণ! আবার কষ্ট হলো ভীষণ, আহারে, বেচারার আশা ভরসায় এভাবে জল ঢালছি আমি?! বুকে তীব্র ভয়।
মাথায় ধুম ধাম করছে... ৭০ ঘন্টা... আরও ১টা বছর! মানুষগুলোর বোঝা হয়ে থাকা...
দিলাম পরীক্ষা সেভাবেই। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। সাথে তীব্র মাথা ব্যথা।
নিজেই জানতাম, গাড়ি চালাই আমি এর থেকে ভালো।
পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল মোট আধা ঘন্টা। পনের মিনিট পরেই আমাকে ফিরিয়ে আনলো! আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। পৃথিবী অন্ধকার। কি এমন ভয়াবহ ভুল করলাম যে আমার পরীক্ষাও পুরাটা নিবে না!
মুখ আঁধার করে যখন কাউন্টারে গেলাম তখনই পেলাম খবরটা।
আমি পাশ করেছি!
লাইসেন্সের ছবি নেয়ার সময় খুশিতে হাসি আটকে রাখতে পারছিলাম না। রক্তেরা সব নৃত্যরত। আমি একা একা গাড়ি চালাবো! হাসিতে ফেটে পড়ছে চোখ আর মুখের সব পেশী ব্যবহার করেও হাসি আটকানো যাচ্ছে না। লাইসেন্সে রাখার জন্য এর চেয়ে বাজে ছবি হয় না। কিন্তু তাতে কিছু না।
কাউকে তো আর বিব্রত করতে হবে না!
তো, এখন থেকে আমি আর 'লুজার লার্নার' নই! পেনরিথ থেকে পঙ্খীরাজের মত উড়িয়ে গাড়ি নিয়ে এলাম বাড়ি। আমাদের 'এল' মুক্ত টয়াটো করোলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।