আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

@তাওহীদুর্ রুবুবিয়্যাহর তাৎপর্য অনুধাবন (এক)

জন্মোপার থেকে পৃথিবী হয়ে অনন্তে >>> ©www.fazleelahi.com

আগের পর্ব পড়ুন। আগেই জেনেছি যে, তাওহীদ অর্থ একত্ববাদ। আর রুবুবিয়্যাহর ক্ষেত্রেও সাধারণ প্রচলিত পন্থায় দু'ধরনের অর্থগত সংজ্ঞা হতে পারে- আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা। আভিধানিক অর্থে রুবুবিয়্যাহ্ শব্দটি আরবী "ربب" ক্রিয়ার ক্রিয়ামূল। এ থেকেই 'ربّ' শব্দ উদ্ভুত হয়।

রুবুবিয়্যাহ্ মূলত আল্লাহ্ তা'আলার একটি গুণ। এ গুণ তাঁর রব নাম থেকে গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়াও 'রব' শব্দটির আর কয়েকটি অর্থ প্রচলিত রয়েছে আরবী ভাষায়- মালিক, অনুসৃত মনিব, সংস্কারক ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে তাওহীদুর্ রুবুবিয়্যাহ্ বা প্রভূত্বে একত্ববাদের মূল কথা হলো আল্লাহকে তাঁর যাবতীয় কার্যাদির ক্ষেত্রে এক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকৃতি প্রদান করা। তাঁর কার্যাবলী সীমাহীন ও ব্যাপক, জগৎ সংসারের সব কিছুই তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ এবং কুদরত দ্বারা পরিচালিত।

এমনকি মানুষের জ্ঞান ও দৃষ্টির বাইরেও সীমা-সংখ্যাহীন অদৃশ্য বিষয়াদির স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, ভাল-মন্দকারী, ধ্বংসকারীও একমাত্র তিনিই। তাই সাধারণভাবে যাবতীয় সৃষ্টি ও সেসবের প্রতিপালন-পরিচালনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে ঈমান রাখা প্রতিটি বান্দার উপর ওয়াজিব। তাওহীদুর্ রুবুবিয়্যার জন্য তিনটি সূত্র থেকে প্রমাণাদি উপস্থাপন হতে পারে এবং রয়েছেও তাই। সেগুলো হচ্ছে- মহান আল্লাহর বাণী আল-কুরআন, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ্ হাদীস এবং মানুষের যুক্তি-বিবেচনা নির্ভর অর্থাৎ, মানুষ তার নিজ সত্তা ও সৃষ্টি জগতে বিস্তৃত আল্লাহর নিদর্শনসমূহ বিবেচনা করে প্রভুত্বের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করবে। আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনে বলেন: خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ - هَذَا خَلْقُ اللَّهِ فَأَرُونِي مَاذَا خَلَقَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ بَلِ الظَّالِمُونَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ . ((তিনি আকাশমন্ডলী নির্মাণ করেছেন খুঁটি ছাড়া---তোমরা এটা দেখতে পাচ্ছ; তিনিই পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব ধরনের জীব-জন্তু।

এবং আমিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করি, অতঃপর তাতে উদগত করি কল্যাণকর সবকিছু। এটা আল্লাহর সৃষ্টি! তিনি ছাড়া অন্যরা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও। সীমালংঘনকারীরা তো সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। )) [সূরা লোকমান: ১০-১১] আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেন কুরআনকে বুঝতে মানুষের জন্য আরো সহজ করে দিচ্ছে। কুরআন নাযিলের সময়ও মানুষ জানতো না যে, আকাশ কিভাবে ঝুলে আছে।

আজকের বিজ্ঞান শুধু এতটুকু জানাতে পেরেছে যে, পৃথিবীসহ আরো অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রাদি মহাশূন্য নিজ নিজ কক্ষপথে অন্তহীনভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। যার কথা সূরা ইয়াসীনে আল্লাহ্ জানিয়েছেন। এদিকে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন আলোক বর্ষের ধারণাগত হিসেব কষার পরও তাদের নিকট আজো প্রথম আসমানের কোন সীমানার সন্ধান মেলেনি। অতএব, কত বিস্তৃত সে সত্তার সৃজন পট, ভাবতেই যে মস্তক অবনত হয়ে আসে! পাহাড়-পর্বত যে পৃথিবীকে অটল রাখতে সাহায্য করে একথা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এই তো সেদিন। আর তাই দেশে দেশে নানা আয়োজন চলছে পাহাড়-পর্বত বহাল রেখে প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

অথচ আল্লাহ্ তা'আলা আধুনিক মানুষদের কথিত সেই মধ্যযুগের অবৈজ্ঞানিক সময়েই জানিয়ে দিয়েছেন যে, পর্বতমালা সৃজন করা হয়েছে এ জন্য যে পৃথিবী যেন তোমাদের নিয়ে ঢলে না পড়ে। যাকে আমরা ভূমিকম্প হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। এছাড়াও বৃষ্টি বর্ষণ ও তা থেকে উৎপাদিত শস্য-বৃক্ষাদির উদাহরণ এসেছে আয়াতে। মরুর খাঁ খাঁ বুকে যদি ক্রমাগত বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে তাহলে দেখা যায় নানা জাতের উদ্ভিদ ও গাছ-গাছালীর জন্মাতে শুরু করে। কে রেখে এসেছে সেই বালুকণার ভেতর বীজ? সোবহান আল্লাহ্! এভাবেই কেবল সত্যসন্ধানীর দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয় তার প্রতিপালকের সত্যতা।

কেবলমাত্র সীমালঙ্ঘনকারীরাই নিপতত থাকে আজন্ম অন্ধত্বে! অন্যত্র আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর রুবুবিয়্যাহর গুণাবলীতে অস্বীকারকারীদের নিকট প্রশ্ন রেখে বলেন: أَمْ خَلَقُوا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بَلْ لَا يُوقِنُونَ . ((তারা কি আপনা আপনিই সৃজিত হয়েছে কোন বস্তু ব্যতিরেকে? না কি তারা নিজেরাই স্রষ্টা?)) [সূরা আত্-তূর: ৩৫] প্রথম মানব সৃষ্টির কথা আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বহু জায়গায় জানিয়েছেন, তারপর থেকে কিভাবে শুধুমাত্র এক ফোঁটা শুক্র থেকে রক্তপিণ্ডে, অস্থিতে, মাংসে এবং অবশেষে রূহ দানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবে রূপান্তরিত হয় সে তথ্য কুরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত রয়েছে যার এক বিন্দুও বর্তমানের বিজ্ঞান কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারছে না। এতই জ্বলজ্যান্ত বাস্তবতা যে সময়ে, সে সময়ে তো সবচেয়ে বেশী পরিমাণে এ সত্যকে গ্রহণ করার কথা। মূলত সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণতি তো ভয়াবহ! অবশ্য বর্তমানের বেশীর ভাগ নওমুসলিমের অন্তরেই কুরআনের প্রামাণ্য সত্যের উপলব্ধি দাগ কাটছে। হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: السيد الله تبارك وتعالى... ((মহান আল্লাহ্ তা'আলাই হচ্ছেন 'আস্-সাইয়্যেদ'…)) অভিধানে 'আস্-সাইয়্যেদ' শব্দের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে 'কর্তা', 'প্রভু', ইত্যাদি রয়েছে যা রব শব্দের অর্থগত দিক থেকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। [আব্দুল্লাহ্ ইবনে শিখ্খীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম আহমাদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।

] আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমাকে নসিহত কালে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتْ الْأَقْلَامُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ . ((…আর জেনে রাখ, যদি উম্মাতের সকলে তোমার কোন কল্যাণ করতে একত্রিত হয়, তারা তোমার ততটুকু কল্যাণই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ্ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা তোমার কোন ক্ষতি করার উপর একতাবদ্ধ হয় তারা তোমার ততটুকু ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু তোমার ব্যাপারে আল্লাহ্ লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, আর কগজ শুকিয়ে গেছে। )) (অর্থাৎ, তাকদীর নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ) [তিরমিযী: ২৫১৬, মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০৭, তিরমিযী বলেছেন হাসান এবং হাকিম বলেছেন সহীহ্] উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনায় যার বিশ্বাস অটল, তার জন্য আর কি চাই? অথচ এসব কিছুই জীবনের বাস্তবতা থেকেই নেয়া।

সুতরাং সুমহান আল্লাহ্ তা'আলার কৃত প্রশ্নটাই তুলে ধরি: ((হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো?)) [সূরা আল-ইনফিতার: ৬]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।