তখনো ঘুম কাটেনি। প্রচ্ছন্ন একটা স্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিলাম। কখন থেকে ফোন বাজছে বুঝতে পারিনি। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো "কেমন আছো?"
বহুদিন পর শুনলাম সেই বহুদিনের পুরনো কন্ঠ। যার কথাকে আমি বাইবেল মানতাম এক সময়।
" কি চিনতে পারোনি? আমি নবনীতা"
ঘুমের ঘোর তখনো ভালোমতো কাটেনি। গলাটাও ভারী হয়ে আছে। তবু কেন যেনো বড্ড হাসি পেলো। হাসলামও জোরেসোরে। বহুদিন পর হাসলাম।
অবাক কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো," হাসির কি হলো, আমাকে কি সত্যিই চিনতে পারোনি?"
আমি বললাম," বেঁচে আছো তুমি?"
- "কেন মৃত্যু কামনা করেছিলে নাকি?"
- " তুমি মরলে তো আমি শান্তি পাই"
কিছুক্ষণ কোন কথা নেই। হালকা কান্নার শব্দ পেলাম।
-" কি কাঁদছো?"
ও চুপ করে আছে। আমি শুনতে পাচ্ছি ওর নাকি কান্নার ফোঁসফোঁসানি।
এবার ভারি গলায় বললো, " তুমি ঠিকই বলেছো।
আমার মরণ হওয়াটাই ভালো ছিলো। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়টা কি জানো, মৃত্যুও আমাকে ঘৃণা করে।
- "তাই নাকি? তবে......"
-" তবে কি?"
-" তোমার মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি মরেও কষ্ট পাবো। "
-" শুনলাম বিয়েও নাকি করোনি?"
-" তাতে তোমার কোন সমস্যা? আমি অফিসে যাবো। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
"
-"আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই"
-" তোমার মুখটা দেখার কোনই ইচ্ছা নেই আমার। আমেরিকায় আছো, ওখানেই থাকো। "
-" নাউ আই এ্যাম ইন বাংলাদেশ"
-" দেশটা তো নোংরা হয়ে যাবে। "
ও এবার জোরে কেঁদে ফেললো
" ফয়সাল, আমি না মরেও প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করছি। "
- "তাই নাকি ? শুনে বেশ আনন্দ পেলাম।
"
- "তবে একটা প্রশান্তি বুকে নিয়ে আজ তোমাকে ফোন করেছি। "
কিসের প্রশান্তি জিজ্ঞেস করবো লাইনটা কেটে গেলো।
আজ থেকে সাত বছর আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রেম হয় আমার আর নবনীতার। ক্যাস্পাসের কাক-পক্ষীও আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো।
ওর সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করতো। ওর চোখে তাকালে যেনো আমি পুরো বিশ্ব দেখতে পেতাম। ওরা ছিলো বেশ ধনাঢ্য পরিবার।
একদিন ওদের বাসা থেকে ওকে অপহরণ করা হলো। অজ্ঞাত জায়গায় আটকে রাখা হলো ১ মাস।
৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ পাওয়ার পর ফিরে এলো নবনীতা। দেশের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হলো সে খবর। কিছু কিছু পত্রিকা আবার খবরের পেছনের খরব বের করে নিয়ে আসে। নবনীতাকে আটকে রেখে কিভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে তার মুখরোচক কাহিনী ছাপা হলো পত্রিকায়। ক্যাম্পাসে এসে প্রতিনিয়ত ওর জন্য অপেক্ষা করি।
ও ক্যাম্পাসে আসে না। ফোন করলে রিসিভও করে না। শুনলাম ওদের পাশের বাসার এক ধনকুবেরের বখে যাওয়া ছেলে এ অপহরণের সাথে জড়িত। নবনীতা মাঝে মাঝে ওই ছেলেটার কথা আমাকে বলতো। দিনে-রাতে, রাস্তা-ঘাটে ওকে জ্বালাতন করতো।
প্রেমের অফার দিতো। আমি ওকে শান্ত থাকতে বলেছিলাম।
একদিন আমি ওদের বাসায় গেলাম। ওর বাবা-মা আমাকে ভালোভাবেই চিনতো। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারেও জানতো।
আমি দীর্ঘক্ষণ ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে থাকলাম। ওর মা ওকে কিছুতেই আমার সামনে নিয়ে আসতে পারলো না।
আমি উঠে গেলাম ওর রুমে। পাশ ফিরে বসে আছে নবনীতা। ও আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললো।
আমি ওকে স্বাভাবিক হতে বললাম। ও বলল, পত্রিকা পড়োনি?
আমি বলাম," ওসব বাদ দাও তো। তুমি ফিরে এসেছো এটাই আমার বড় পাওয়া। "
- আমি যে সবকিছুই ওখানে হারিয়ে এসেছি ফয়সাল। তুমি চলে যাও আর কখনো এ কলঙ্কিত মুখ দেখতে এসো না।
আমি বললাম, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
ও বললো, তোমার বোঝা হতে চাই না আমি।
ওর বাবা-মাও ওকে অনেক করে বুঝালো। ও কিছুতেই শুনলো না।
একদিন নবনীতার বিয়ে হয়ে গেলো।
যে পিশাচটা ওকে অপহরণ করেছিলো তার সাথে। ওর বাবা-মা'র অজান্তে। পালিয়ে গিয়ে। এরপর আমার মানসিক অবস্থা কি হতে পারে তার বর্ণনা নিরর্থক। শুধু বলে রাখি ঘৃণার জ্বালায় আমার সমস্ত শরীর অনবরত জ্বলছিলো।
কয়েক মাস পর শুনলাম ওরা আমেরিকায় গেছে। ওদের বাসায় ফোন করে জানিয়েছে।
তারপর কেটে গেছে সাত বছর। আমি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছি। বিয়ের কথা আর কখনো চিন্তাই করিনি।
অবশ্য একজনের জন্য আমি গোটা নারী জাতকেও ছোট করে দেখিনি।
নবনীতার আজকের এই ফোনটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
হঠাত ফোনটা আবারো বেজে উঠলো। আমি রিসিভ করে বললাম, কিসের প্রশান্তি?
ও কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, আমি খুন করেছি ফয়সাল। আমি খুন করেছি!
আমি যেনো আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তোমার মাথাটা ঠিক আছে তো? কাকে খুন করেছো?
-" যে তোমার প্রেম, তোমার নবনীতাকে কলঙ্কিত করেছিলো। যে তোমার কাছ থেকে আমাকে দুরে সরিয়ে নিয়েছে। তাকে।
-" তার মানে তোমার স্বামীকে?"
এবার ও হেসে উঠলো, " হ্যাঁ, সেটা বলতে পারো। তবে আমি আজ সফল।
"
ওর কথা শুনে আমার পূরনো প্রেমটা যেন বুকে খোঁচা দিলো। মনে পড়লো ক্যাম্পাস লাইফের সেই নবনীতার ভালোবাসার স্মৃতিগুলো। কেনো জানি ওর প্রতি জমাট বাঁধা ঘৃণাগুলো বরফের মতো গলে গেলো। আমি বুঝে গেলাম নবনীতা প্রতিশোধ নিতেই ওই সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেছিলো।
আমি বললাম, "কবে দেশে এসেছো?"
-" এখান থেকে আমেরিকায় যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ওই পশুটাকে নিজ হাতে খুন করি।
তারপর পাঁচ বছর জেল খেটেছি। জেল থেকে বের হয়ে তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে চেয়েও ক্ষোভে দুঃখে করিনি। তারপরও মনে একটা প্রশান্তি ছিলো। "
সেদিনই সন্ধ্যায় নবনীতা এলো আমার ফ্ল্যাটে। বয়স বাড়লেও চেহারায় এতটুকু বয়সের ছাপ পড়েনি।
আমার বেডে বসতেই আমি বললাম, বসছো কেনো, চলো যাই।
ওবললো, কোথায়?
কোথায় আবার কাজী অফিসে?
এ কথা শোনার পর গোটা রাজ্যের একরাশ বিষ্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালো। কি যেন বলার চেষ্টা করছিলো।
আমি ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে বাইরে এলাম। গাড়ী চালালাম কাজী অফিসের দিকে।
#
(১০০তম পোস্ট উপলক্ষে এ গল্পটা আজকে লিখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।