অন্যায় এর প্রতিবাদ
বিচারকের স্বাক্ষর ও সিল জাল করে ভুয়া রায় তৈরি হচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কোনো যাচাই না করে এ রায়ের ভিত্তিতেই অ্যাকশনে যাচ্ছে পুলিশ-র্যাব। অবর্ণনীয় ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ। তাদের অনেকেই আবার দিনের পর দিন কারাভোগ করেছেন।
অবাক হলেও সত্য, ভয়ঙ্কর এসব প্রতারণার সঙ্গে জড়িত খোদ পুলিশ বিভাগেরই দুর্নীতিবাজ সদস্যরা। প্রতারক চক্রের সদস্যরা মাঝে মধ্যে গ্রেফতার হলেও তাদের জামাই আদর করা হয় থানা হাজতে। বিচার ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'বিচারকের স্বাক্ষর জাল করেও ওয়ারেন্ট ইস্যু করাচ্ছে প্রতারকরা। এটি সত্যি খুব দুঃখজনক।
আমি আশা করব, পুলিশ বিভাগ এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখবে এবং অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করবে। '
ঘটনা-১ : গত ৭ অক্টোবর বেলা আনুমানিক ১টা ১০ মিনিট। সিলেটের বালাগঞ্জ থানায় একটি মামলার ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড, এমন একটি রায়ের কপি দেখিয়ে রাজধানীর পরীবাগ এলাকা থেকে শাহবাগ থানা পুলিশ আটক করে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাদেকুর রহমানকে। ২০১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দায়েরকৃত ওই মামলায় (নম্বর-১১৮/১১) স্বামীর গ্রেফতারের খবর পাওয়ামাত্রই থানায় ছুটে যান হাইকোর্টের আইনজীবী স্ত্রী আফসানা ইসলাম। পাঁচ ঘণ্টা পর শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম নিশ্চিত করেন ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা ভুয়া।
সিলেট জেলা জজের (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল) স্বাক্ষর জাল করে ওই আদেশ তৈরি করা হয়।
তবে তাতেই রেহাই মেলেনি সাদেকুর রহমানের। বিভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে একের পর এক প্রাণনাশের হুমকিসংবলিত কল আসতে থাকে সাদেকুর রহমানের বাসার ল্যান্ডফোনে। ১৪ অক্টোবর তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। এর ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেল বিষয়টির তদন্ত শুরু করে।
এদিকে গত ১৭ নভেম্বর সাদেকুর রহমান তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় গেলে ওই থানার পুলিশ পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় ২০১০ সালের অক্টোবরে করা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে যায়। ওই মামলার রায়ও একই দেখানো হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ দফতরের সিকিউরিটি সেল বিষয়টির তদন্ত করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার অফিসের কর্মচারী মেহেদী হাসান সুলতান ও চিহ্নিত প্রতারক শফিকুর রহমান নেওয়াজের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায়। গত ৯ জানুয়ারি সাদেকুর রহমান শফিকুর রহমান নেওয়াজকে আসামি করে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। ১০ জানুয়ারি পুলিশ নেওয়াজকে গ্রেফতার করলেও ঠিক পাঁচ দিন পর ১৫ জানুয়ারি বীরদর্পে জামিনে বের হয়ে যান তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নেওয়াজকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো প্রয়োজনবোধ করেননি। এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক সাহিদুল বিশ্বাস বলেন, আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তদন্তের প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে দেখা যাবে। ভুক্তভোগী সাদেকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এ প্রতিবেদককে বলেন, একমাত্র কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে আমি প্রতিটি মুহূর্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
আসামি এরই মধ্যে জামিনে বের হয়ে গেছেন। এরই মধ্যে আমি একবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছি। গ্রেফতার আসামি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের শ্যালকের শ্যালক বলে দাবি করায় অনেক সুবিধা পাচ্ছেন।
ঘটনা-২ : পৃথক তিনটি নারী নির্যাতন ও একটি প্রতারণার মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের একটি ভুয়া ওয়ারেন্ট দেখিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের বাসিন্দা সৈয়দ আরিফ নিয়াজী ওরফে ফ্রান্সিস আরিফ (৫৫)-কে গ্রেফতার করে গুলশান থানার র্যাব-১ এর দল। ২৪ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে চট্টগ্রামের সিএমএম আদালতে সাত কর্মদিবসের মধ্যে হাজির হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে এক সপ্তাহের জামিন দেন।
পরে তিনি চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গিয়ে জানতে পারেন, ওই আদালতে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার কোনো নথিই নেই। এমনকি সরকারি রেকর্ডেও এ মামলার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং এ তিনটি মামলার বিপরীতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত থেকে যে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে, তাও ভুয়া। পরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ওয়ারেন্ট বিষয়ে তদন্ত করলে ভয়াবহ জালিয়াতি ঘটনা বেরিয়ে আসে।
ঘটনা-৩ : গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সদরের কাউনিয়া থানা পুলিশ ঢাকার বিশেষ আদালতের একটি গ্রেফতারি পরোয়ানায় গ্রেফতার করে কাউনিয়ার বাচ্চু রাঢ়ী ও ফারুক খানকে।
আট দিন হাজতবাসের পর গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
ঘটনা-৪ : বরিশাল জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৪ এর একটি গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কাফরুল থানা পুলিশ দক্ষিণ ইব্রাহিমপুরের ৯৫৩/৪ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা নাসিম মিয়াকে গ্রেফতার করে। পর দিন তাকে আদালতে হাজির করা হলে ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ কে এম শামসুল ইসলাম তার রায়ে বলেন, 'আমি দায়িত্বসহকারেই বলতে পারি যে, বরিশালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর অস্তিত্ব নেই। ' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত জায়গা-জমি নিয়ে শত্রুতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে কোনো মামলা ছাড়াই প্রতারক চক্রের সদস্যদের দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভুয়া পরোয়ানা ইস্যু করায়। পরবর্তীতে ওই কাগজপত্রগুলো বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও সংশ্লিষ্ট র্যাবের ব্যাটালিয়নে হাতে হাতে কিংবা ডাক মারফত পাঠানো হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় প্রায় সাত-আটটি চক্র এ ধরনের ভয়ঙ্কর কাজ করে থাকে। আদালত ও পুলিশের ডেসপাস শাখার দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। আদালত বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা চক্রটির কাউকে ধরতে পারেনি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।
তবে পুলিশ সদস্যদের উচিত তাদের পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিয়ে এসব বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়া। এসব ভুয়া পরোয়ানার সঙ্গে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, এই প্রতারকরা একটি গ্যাং। এই গ্যাংয়ে প্রশাসনের লোকজন অবশ্যই জড়িত। সাদেকুর রহমানের ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
নইলে মামলার আইও কেন আসামিকে রিমান্ডে নিলেন না?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।