আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নূরজাহান বেগমের ইন্টারভিউ

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

বেগম পত্রিকার সম্পাদক, বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক ও মনস্তাততিক জাগরনের অগ্রদুত নূরজাহান বেগমের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম সেদিন। তা ছাপা হয়েছে যায়যায়দিন পত্রিকায়। এই বয়সে এসে দীর্ঘ এই সাক্ষাতকার দিয়েছেন তিনি। জীবনের প্রকাশিত অপ্রকাশিত অনেক কথাই বলেছেন তিনি। পড়ুন নূরজাহান বেগমের ইন্টারভিউ।

যাযাদি : আপনার জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন। কিছুদিন আগে আপনি ৮২ বছরে পা রাখলেন, জীবনের এ পর্যায়ে আপনার শৈশবের স্মৃতি সম্পর্কে জানাতে চাইছি। অর্থাত কেমন ছিল আপনার শৈশব? নূরজাহান বেগম : আমার জন্ম চাদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। আমি প্রায় তিন বছর পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। সে সময় মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের পরিবার গ্রামেই থাকতো।

কলকাতা শহরে যেতো না এ জন্য, একটা কুসংস্কার ছিল, মেয়েরা যদি কলকাতায় যায় খ্রিস্টান হয়ে যাবে, বেপর্দা হয়ে যাবে। এ জন্য আমার মাকেও গ্রামে থাকতে হতো। আমার শৈশবকালেই বাবা কলকাতার ১১ নাম্বার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে সওগাত বের করতেন। আমাকে শৈশবকালে মার সঙ্গে গ্রামেই থাকতে হয়েছিল। যাযাদি : শৈশব কেটেছে গ্রামের বাড়িতে।

কেমন ছিল সে সময়টি? নূরজাহান বেগম : শৈশবে দুইটা ঘটনা ঘটে। একবার আমি পুকুরে পড়ে যাই তখন বাবা প্রতিবাদ করে বলেছিল ওদের কলকাতায় নিয়ে যাই। কেননা বাচ্চা এভাবে পানিতে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। তখনো বাড়ির গ্রামের আত্মীয়স্বজন দেয়নি। দাদি, নানি বলেছিলেন, কলকাতায় বউ যাবে না, এখানেই থাকবে।

আমরা বাচ্চা যেভাবেই হোক দেখবো। তারপর তিন বছর বয়সের সময় আবার আমি খালে পড়ে যাই। খালের পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে বেচে যাই। জীবনের বড় দুটি ঘটনা আমার চালিতাতলি গ্রামে হয়। তখন বাবা একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।

তিনি আমার বড় মামাকে চিঠি লিখলেন, যে অতো তারিখে কলকাতায় শিয়ালদহ স্টেশনে আমি থাকবো। আপনার বোন এবং আমার মেয়েকে নিয়ে আপনি চলে আসবেন। তখন বাবা কোনো বাধা, কোনো কুসংস্কার মানলেন না। আমাদের নিয়ে যান কলকাতায়। তখন আমার বয়স তিন কি সাড়ে তিন।

যাযাদি : নূরী, মালেকা, নুরুননেসা, নুরুন্নাহার আর নূরজাহান বেগম। আপনার এতো নামের পেছনের ঘটনাগুলো জানতে চাইছি। নূরজাহান বেগম : চাচা চাচি আমাকে নূরুননেসা বলে ডাকতেন। খেলার সাথী বান্ধবীরা মালেকা নামে ডাকতো। স্কুলে সবাই নূরুন্নাহার বলে ডাকতো।

নানির নাম ছিল নূরজাহান বেগম। তিনি আমার মাকে বললেন, তোর মেয়ের নাম আমার নামে রাখ। এতে তার মাধ্যমে আমাকে স্মরণে রাখবি। তারপর থেকেই আমার নাম হয় নূরজাহান বেগম। যাযাদি : তিন সাড়ে তিন বছর বয়সে আপনি মার সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেন? সে সময়ে কলকাতা কেমন ছিল? নূরজাহান বেগম : সে সময় তো খুব ছোট ছিলাম।

পুরো ঘটনা মনে নেই। কলকাতা সে সময় খুবই আধুনিক শহর। ফেরিওয়ালারা নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসতো। তখন আমাকে নিচে যেতে দেয়া হতো না। ছাদে উঠতে দেয়া হতো না।

যাযাদি : কলকাতায় আপনাদের ঠিকানা হয়েছিল ১১ নাম্বার ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়ি। সেই বাড়িটি ঘিরে আপনার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমাদের তার কিছু বলবেন কি? নূরজাহান বেগম : আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল জমিদার বাড়ি। তাদের অনেক পশুপাখি ছিল। দুটো হনুমান পালতো তারা।

আমি হনুমানকে খুব ভয় পেতাম। ঈদের দিনে জামাকাপড় পরিয়ে মা সব খাবারটাবার দিয়ে গেছে। খাবার খাওয়া নিয়ে মাকে খুব বিরক্ত করতাম। যখন বললো আয় খেতে আয়, তখন খেলতে চলে গেলাম। তখন জানালা দিয়ে হনুমান এসে সব খাবার খেয়ে যায়।

তখন মা খুব রাগ করেন। আরেকটা ঘটনা অফিসে সবাই কাজ করছে। আমি গিয়ে চিৎকার শুরু করলাম। আমি বললাম ভূত, ভূত। তখন তারা সবাই বললো কি ব্যাপার কি? তখন ঘোরানো সিড়ি ছিল।

সিড়ি দিয়ে তারা খানিকটা উঠে দেখে একটা কালো বিড়াল ভয়ে সিড়ির ফাকে চুপ করে বসে আছে। তখন আমার গায়ে হাত দিয়ে তারা বললেন, দেখছো নূরী এটা কালো বিড়াল, ভূত নয়। তখন আর ভয়ে ছাদে যাইনি। আগে তো দৌড়ে দৌড়ে ছাদে উঠে যেতাম। তারপর কেউ না থাকলে ছাদে যেতাম না।

যাযাদি : আপনাদের সেই বাড়িতেই তো কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন। কাজী নজরুল ইসলামকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? নূরজাহান বেগম : ছোট মানুষ হিসেবে সে সময় সবাই আমাকে খুবই আদর করতো। আমার নামটা একটু পরিবর্তন হলো সে সময়। আমাকে সবাই নুরু নামে ডাকতো। যেহেতু কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল নুরু, সে জন্য আমার নামটা হয়ে নূরী।

কাজী নজরুল ইসলাম জর্দা আর পান খেতেন। আমি তা হাতে করে তার টেবিলে এনে দিতাম। তার আলাদা একটা রুম ছিল। সেখানে বসে বসে তিনি একমনে লিখতেন। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা দেখতাম।

একঘণ্টা-দুইঘণ্টা পরপর তাকে পান দিতে হতো। আরেকটা বিষয় দেখেছি। কাজী সাহেব যে রুমে বসে লিখতেন সে রুমে বাবা বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিতেন। এই জন্য যে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোক এলে একমনে লেখা হয় না। তালা দেখলে লোকজন ফিরে যেতো, কাজী সাহেব নেই ভেবে।

কিন্তু ভেতর দিয়ে রুম খোলা হতো। এভাবেই বাবা কাজী নজরুল ইসলামকে তাগাদা দিয়ে লেখাতেন। সভা, সমিতি, সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠান হলে তাকে আর রাখা যেতো না। তখন পত্রিকা প্রকাশে বেশ সমস্যা হতো। এ নিয়ে বাবা মাঝে মধ্যে দুঃখ প্রকাশ করতেন, তাকে একজায়গায় বসানো যায় না।

উপন্যাসে লেখার মাঝখানে অসুবিধা হয়। সে সময় কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যু ক্ষুধা উপন্যাস লিখছিলেন। কাজী নজরুলকে যখন সংবর্ধনা দেয়া হয় তখন সবাই তাকে সাজিয়ে দিয়ে যায়। ফুল দিয়ে প্রাইভেট গাড়িটা সাজানো। তিনি টুপি মাথায়, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা।

সবাই তাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি দোতলার বারান্দায় দাড়িয়ে তা দেখি। এ দৃশ্য এখনো আমার মনে আছে। কি দারুণ একটা সম্মান একজন কবি পাচ্ছে। সে সময় তরুণ কবি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের উদ্যোগে সবাই মিলিতভাবে তরুণ কবিকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল তা তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা ছিল।

আমি যদিও তখন ছোট ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম কলকাতাতে বিরাট কিছু হচ্ছে। যাযাদি : সে সময় তো আপনাদের বাড়িতে সাহিত্যের আসর বসতো। আপনি ছোট থাকতেই সেসব আসরে উপস্থিত থাকতেন। নূরজাহান বেগম : তখন কাজী নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে সওগাত অফিসে খুবই জমজমাট আসর বসতো। বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন, বাঙালি হিন্দু মুসলমানরা আসতেন।

তারা নানা রকম আলোচনা করতেন। সমাজ সংস্কার বিষয়ে কথা বলতেন, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতেন। আমি সে সময় এগুলো কাছ থেকে দেখেছি। ছোট মানুষ হিসেবে সবাই আমাকে খুবই আদর করতো। যাযাদি : আপনার বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সে সময় মাসিক সওগাতের সম্পাদক ছিলেন।

তার কাছ থেকে আপনার শিক্ষা কেমন ছিল? নূরজাহান বেগম : আমাদের বাড়িতে কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন, সাংবাদিকরা আসতেন, তারা বাবার সঙ্গে কথা বলতেন। আমি তা শুনতাম। বাবা আমাকে সব সময়ই উৎসাহ দিতেন। সাংবাদিকতা আমার প্রথম হাতে খড়ি হয়েছিল ছবির বইয়ের মাধ্যমে। বাবা ছোট ছোট গল্পের বই, রঙিন ছবির বই এনে দিতেন।

সে সময় ছোটদের বাইয়ের কোনো অভাব ছিল না। অবশ্য পড়তে পারতাম না কিন্তু পাতা উল্টিয়ে ছবি দেখতাম। যখন আরেকটু বড় হলাম, ছয়-সাত বছর বয়স হলো তখন তিনি আমাকে ফাইলিং করা শেখালেন। বলতেন, আতার্তুকের ছবি এখানে, টার্কির ছবি এখানে, এটা এখানে রাখো। এই যে তাকে তাকে রাখা অর্থাৎ ফাইলিং করা এটাই ছিল আমার প্রথম কাজ।

তিনি বলতেন, টার্কির ফাইলটা আনো তো মা। আমি নিয়ে আসতাম। তিনি খুবই খুশি হতেন। ফাইলিং থেকেই আরম্ভ হলো। বাবা প্রায় সময় বাইরেই থাকতেন।

তাই লেখকরা লেখাগুলো ছোট চাচাকে দিয়ে যেতেন। লেখাগুলো মার কাছে আসতো। আমি লেখাগুলো বাবার কাছে দিতাম। এই যে হাতে খড়ি আমার বাবা দিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে রাখলেন এটি আমার জন্য বেশ প্রাপ্তির। তখন কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের দেখে মনে হয়েছে এটা সবচেয়ে মহৎ কাজ এবং এতে অনেক সম্মান পাওয়া যায়।

আমি দৃঢ় মনোবল পেলাম সাংবাদিকতা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক কাজ। তবে অনেকেই সাংবাদিকতায় এসে অন্য লাইনে চলে যায়, আর্থিক চিন্তার জন্য। এটা একটা বিরাট সমস্যা। এ লাইনে এলে আর্থিক দিকটার চেয়ে সমাজকল্যাণের দিকটা বেশি দেখতে হয়। এই যে আমরা গণমাধ্যমগুলো সমাজকল্যাণের জন্য কাজ করছি।

সে সময় এতোটা সহজ ছিল না। সে সময় ১৯৩০ সালে বাবা প্রথম সওগাত মহিলা সংখ্যা বের করলেন মহিলাদের ছবি দিয়ে। তখন তার সঙ্গে সঙ্গে থেকে দেখেছি কিভাবে ছবি সংগ্রহ করতে হয়, কিভাবে লেখা আনতে হয়, কোন কোন মহিলা ভালো লেখেন। সে সময় সওগাত পত্রিকায় আমার মার ছবিও বাবা ছেপেছেন। গ্রামের আত্মীয়স্বজনরা তা খুবই অপছন্দ করেছিলেন।

তারা বলেছিলেন, ফাতেমা খাতুনের ছবি ছেপে তাকে বেপর্দা করে ফেলেছেন। এটা কি করলেন নাসিরউদ্দিন সাহেব? বাবা সেটা কেয়ার করেননি। যাযাদি : এবার আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছি। আপনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলজীবন কেমন কেটেছে? নূরজাহান বেগম : বাবার সঙ্গে বেগম রোকেয়ার খুব পরিচয় ছিল।

বেগম রোকেয়া বাবাকে বললেন, আপনার মেয়েকে স্কুলে দেন। বাবা বললেন, এখন তো ও ছোট, ওর মা রাজি হবে না। মাকে যখন বাবা বললেন তখন মা বিশাল ক্ষেপে যায়। তারপর আমি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হই। শিশু শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করি।

তারপর আবার পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। তারপর কলকাতার লেডি ব্রাবোন কলেজে ভর্তি হই। যাযাদি : কলেজে থাকতেই আপনি কবিতা আবৃত্তি করতেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতেন আবার অভিনয় করতেন। এসব কি রক্তেই ছিল? নূরজাহান বেগম : আধুনিক চিন্তাধারণা মনে স্থান পাওয়ায় সব কিছুই করতে ইচ্ছা হতো।

তখন কিছুই ছিল না। বাঙালি মুসলমানরা নাচতে পারবে না, গাইতে পারবে না, জোরে কথা বলতে পারবে না, তরুণদের সঙ্গে মিলতে পারতো না। সব কিছুতেই না। তবে ওই গ-ির মধ্যে থেকে যতোটা পেরেছি আমরা করেছি। যেসব নিয়ম ছিল না সেগুলো আমরা করেছি।

যেমন সপ্তাহে একবার আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, তিন মাস পরপর একটা করে নাটক করেছি, বছরে একবার পরীক্ষা পর পুরস্কার বিতরণীর সময় ভালো মুভিতে অভিনয় করা। শেষ অভিনয়ের বইটা ছিল চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্তের ভূমিকায় আমি অভিনয় করেছিলাম। লম্বা মেয়ে পাওয়া যায়নি বলে আমাকে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল। যাযাদি : আপনি তো আপনার বাবাকে পত্রিকা বের করার কাজে সাহায্য করতেন।

নূরজাহান বেগম : নানা রকমের কাজ ছিল। তখন ব্লকগুলো রাখতে হতো। বাবার কাগজপত্র এগিয়ে দিতে হতো। ফাইলিংয়ের কাজ করতাম। বাবার এডিটিং রুমে বসে দেখতাম।

বাবার এডিটিংয়ের হাত খুবই ভালো ছিল। তিনি সম্পাদনার সময় সবটা পড়ে লম্বা করে দাগ দিতেন। একবার বাবা কাজী নজরুল ইসলামকে বলেছিলেন, কবিতা হয়েছে, কাজী তুমি এ জায়গাটা পড়ো। এটা ছন্দপাত না বজ্রপাত? যাযাদি : আপনার বাবার উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম মহিলাদের জন্য সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বেগম পত্রিকা হওয়া সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? নূরজাহান বেগম : ১৯৩০ সালে বাবা প্রথম মহিলাদের ছবি ও লেখা দিয়ে প্রথম মহিলা সংখ্যা সওগাত বের করেন।

১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মহিলাদের ছবি সংবলিত সওগাত মহিলা সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে বাবা নানা রকমের পরিকল্পনা করেন। কিভাবে মহিলাদের আরো এগিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে ভাবেন তিনি। তখন কলকাতায় নানা রকমের দাঙ্গা হচ্ছিলো, রাজনৈতিক সঙ্কট চলছিল। তার মধ্য থেকে বাবা একদিন সুফিয়া কামালকে ডাকলেন।

কাছেই পার্ক সার্কাসে থাকতেন তিনি। বাবা বললেন, সুফিয়া বছরের একবার করে মহিলাদের লেখা ছাপা দিয়ে হবে না। তোমাদের একটা সাপ্তাহিক দরকার। সব সময়ই লেখা ছাপা হলে মেয়েদের তাড়াতাড়ি এগিয়ে নেয়া যাবে। তোমাকে আমি সম্পাদক করতে চাই।

তখন সুফিয়া কামাল বললেন, ঠিক আছে আমি যতোটা পারি করবো। তারপর ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক বেগমের প্রথম সংখ্যা বের হয়। যাযাদি : সে সময় আপনি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পত্রিকা বের করতে গিয়ে প্রথম দিককার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? নূরজাহান বেগম : বেগম উপমহাদেশের বাঙালি মহিলাদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক। সে সময়টাতে মহিলাদের সাপ্তাহিক বের করা আজকের মতো সহজ ছিল না।

অনেক রকমের বাধা-বিপত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ ভাগ হয়ে যায়। চার মাস সম্পাদক থাকার পর সুফিয়া কামাল ঢাকায় চলে আসেন। তখন সম্পাদকের দায়িত্বভার আমাকে নিতে হয়। ১৯৪৮ সালে বেগম পৃথিবীতে প্রথম মেয়েদের ছবি দিয়ে ঈদ সংখ্যা বের করে।

এরপর ১৯৪৯ সালে মেয়েদের ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণের জন্য বিশ্বনবী বেগম সংখ্যা বের করা হয়। যাযাদি : প্রথম দিকে বেগম পত্রিকায় কোন কোন বিষয় স্থান পেতো। নূরজাহান বেগম : বেশির ভাগ সময় গল্প ছাপা হতো। তবে অনেক সময় তা স¤পূর্ণ হতো না। কবিতা ছাপা হতো।

বেগমের প্রথম দিককার বিভাগগুলো ছিল গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা, পল্লী উন্নয়ন, মাতৃমঙ্গল, স্বাস্থ্য সৌন্দর্য শিশু মঙ্গল, সেলাই, চিঠিপত্র ছায়াছবির কথা। যাযাদি : নারীদের লেখা সংগ্রহ, ছবি সংগ্রহ করা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই কঠিন কাজ ছিল। সেই কঠিন বাধা-বিপত্তি পার হয়ে কিভাবে পত্রিকা বের করে গেলেন? নূরজাহান বেগম : সে সময় নারী লেখকদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। অনেক কষ্ট করে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। বেশির ভাগ লেখাই আমরা অনুবাদ করে দিতাম।

বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা থেকে দুই-তিনজন মিলে অনুবাদ করে লেখা ছাপাতাম। সওগাত মহিলা সংখ্যা করার জন্য মহিলাদের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল। আমরা সেগুলো ব্যবহার করতাম। সে সময় মুসলমানদের প্রকাশিত পত্রিকায় ছবি পাওয়া যেতো। আমরা অনেক সময় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ইংরেজি পত্রিকা থেকে ছবি দিতাম।

সে সময় ব্লক করে ছবি ছাপাতে হতো। যাযাদি : ১৯৫০ সালে আপনারা ঢাকায় চলে এলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে বেগম পত্রিকার ঢাকার সময় কেমন ছিল? নূরজাহান বেগম : ১৯৫০ সালে আমরা ঢাকায় এসে দেখি কিছুই নেই। সে সময় আমরা ঢাকার বিজয়া প্রেসের সঙ্গে আমাদের প্রেস এক্সচেঞ্জ করি। সে সময় ছিল টাইপের যুগ।

ঢাকায় এসে দেখি টাইপ ভোতা, ব্লক নেই, সব ঘর টিনের। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করে কাজ শুরু করি। ১৯৫০ সালে বেগম প্রকাশিত হতে থাকে ঢাকার ৬৬ নাম্বার পাটুয়াটুলি বেগম কার্যালয় থেকে। যাযাদি : ১৯৫৪ সালে আমেরিকার নারী সাংবাদিক মিসেস আইডা আলসেথ বেগম কার্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি বেগম পত্রিকা অফিস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

সে সম্পর্কে কিছু বলুন। নূরজাহান বেগম : ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মহিলাদের জন্য অন্য কোনো সাপ্তাহিক ছিল না। সে জন্য বাইরে থেকে যারা আসতো তারা বেগম কার্যালয়ের কাজ দেখতে চাইতো। তথ্য বিভাগ একবার আমাদের জানালেন, আমেরিকা থেকে একজন নারী সাংবাদিক এসেছেন। তিনি বেগম কার্যালয় দেখতে চান।

তখন আমরা বললাম ঠিক আছে। মিসেস আইডা আলসেথ তখন বেগম কার্যালয় পরিদর্শনে আসেন। তিনি বেগম পত্রিকার বিভাগগুলো দেখে বলেছিলেন, তোমরা এতো রিডিং ম্যাটারিয়াল দেও। তিনি বেগম পত্রিকা অফিসের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যাযাদি : ১৯৫৪ সালেই আপনার বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগে বেগম কাব গঠিত হয়।

মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানউন্নয়নে কাজ করেছে এটি। বেগম কাবের শুরু কিভাবে হয়েছিল? নূরজাহান বেগম : মিসেস আইডা আলসেথ বেগম কার্যালয় পরিদর্শন শেষে পত্রিকা নিয়ে কথা বলেন। তখন আমরা মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যার কথা বললাম। তখন তিনি বললেন, তোমরা একটা কাব তৈরি করো। যেখানে লেখকরা আসবে, আলাপ-আলোচনা করবে।

এ প্রস্তাবটা তখন বাবাকে বললাম। তিনি তখন ১৯৫৪ সালে নভেম্বরে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।