কালকে পিবিএস-এ একটা প্রোগ্রাম দেখাচ্ছিল কুকুর আর মানুষের সিম্বায়োটিক সম্পর্ক নিয়ে৷ নিকোলাস ওয়েডের “Before the dawn” পড়ার সময়েও এরকম তথ্য দেখেছিলাম যে গত ২০ হাজার বছরে আমাদের সভ্যতার গড়ে ওঠার সাথে কুকুরের একটা গুরুত্বপুর্ন সম্পর্ক আছে৷ আবার উল্টোটাও সত্যি কুকুরের আজকের যে চেহারা আমরা দেখি এটা কিন্তু মানুষের হাতে গড়া৷ এই জায়গাটাই অদ্ভুত মনে হয়, কারন অন্যান্য পোষা প্রানীর চেয়ে বোধ হয় কুকুরের ক্ষেত্রেই মানুষের প্রভাবে সবচেয়ে বেশী বিবর্তন হয়েছে৷
বিবর্তন কেন? কারন কুকুর আসলে এক ধরনের নেকড়ে৷ জংলী নেকড়ের বেশীরভাগ বৈশিষ্ট্যই আছে, কিন্তু কয়েকটা ক্ষেত্রে পার্থক্যও আছে, আর এই পার্থক্যগুলো তৈরীতে মানুষের সরাসরি ভুমিকা আছে, মানে দাড়াচ্ছে এগুলো প্রকৃতি থেকে অটোমেটিক বিবর্তিত হয়ে তৈরী হয় নি বরং মানুষের কৃত্রিম সিলেক্টিভ প্রেশারের কারনে গত ১৫-২০ হাজার বছরে এই পরিবর্তনগুলো হয়েছে৷ ২০ হাজার বছর আসলে বিবর্তনের জন্য খুব কম সময়, বলতে গেলে ২০ হাজার বছর আগের একজন মানুষের চেয়ে আমাদের পার্থক্য খুব কম (যদিও ধরা হয়ে থাকে বর্তমানে মানুষের মধ্যে সাদা-কালো-বাদামি যে বর্ন তৈরী হয়েছে তা মুলত গত ২০-৩০ হাজার বছরের মিউটেশনের ফলাফল)৷
পোষা কুকুরের সাথে নেকড়ের (এক্ষেত্রে Gray Wolf) মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তুলনা করলে দেখা যায় ওদের পার্থক্য মাত্র ০.২%৷ যেখানে নেকড়ের সাথে কায়োটির (Coyote – শেয়ালের মতো দেখতে উত্তর আমেরিকাতে আছে) পার্থক্য ৪%৷ জেনেটিক এভিডেন্স থেকে মনে হয় কুকুর আসলে গ্রে উল্ফ থেকেই এসেছে, শেয়াল/খেক শিয়ালের সাথে তাদের পার্থক্য তুলনামুলক ভাবে বেশী৷
কিন্তু গ্রে উল্ফকে কুকুর বানালো কে? কালকের প্রোগ্রামে দেখাচ্ছিল পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে পোষা কুকুরের ডিএনএ নিয়ে দেখা হচ্ছিল কুকুর পোষা কোথায় প্রথম শুরু হয়৷ অনেকটা ফরেনসিক সায়েন্সের মতো, অতীতে ফিরে গিয়ে যেহেতু সরাসরি দেখে আসার উপায় নেই, সুতরাং এখনকার এভিডেন্সগুলোকেই বিশ্লেষন করে দেখতে হচ্ছে৷ একটা উপায় হচ্ছে কোন এলাকায় পোষা কুকুরের কেমন ডাইভারসিটি হিসেব করে দেখা৷ ডাইভার্সিটি কারন, উত্স বের করার জন্য ডাইভার্সিটি বেশ গুরুত্বপু্র্ন, একটা উদাহরন দেই৷ ধরা যাক ক, খ, গ তিনটি গ্রাম পাশাপাশি৷ এখন আমি যদি ওখানকার মানুষের last name নিয়ে একটা জরীপ চালিয়ে দেখি ক গ্রামে “তালুকদার” ৪০%, খ গ্রামে ২০% আর গ গ্রামে ১৫%৷ তালুকদারদের আদিনিবাস যদি এ তিনটি গ্রামের যে কোন একটা হয় তাহলে কোনটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি? নিশ্চয়ই “ক”৷ যেমন মানুষের ক্ষেত্রে আমাদের জেনেটিক ডাইভার্সিটি সবচেয়ে বেশি আফ্রিকাতে৷ হিসেব করলে বোঝা যায় সবচেয়ে পুরোনো জিন আছে এরকম লোকেরা দক্ষিন পুর্ব আফ্রিকাতে থাকে৷ এরকম একটা গোষ্ঠি হচ্ছে Khoisan-রা ৷ জেনেটিক প্রমান ছাড়া আলাদা ভাবে ফসিল এভিডেন্স থেকেও বোঝা যায় আফ্রিকার রিফ্ট ভ্যালী বা তারপাশের এলাকা আমাদের আদিনিবাস৷
তো কুকুরদের ক্ষেত্রে এরকম ডাইভার্সিটি স্টাডি করে দেখা গেল যে পোষা কুকুরদের ডাইভার্সিটি চীনে সবচেয়ে বেশী৷ মোটামুটি ধারনা করা যায় বর্তমান চীন বা সাইবেরিয়াতে কুকুর পোষা সবার আগে শুরু হয়েছিল৷ সম্ভবত হঠাত্ করেই বিচ্ছিন্নভাবে, কোন ধরনের প্ল্যান ছাড়া৷ এমনিতেই মানুষের বসতির আশে পাশে অনেক প্রানী ঘুরঘুর করে৷ ২০ হাজার বছর আগে শিকার নির্ভর যাযাবর মানুষের আশে পাশে গ্রে উল্ফ থাকা খুব স্বাভাবিক৷ কারন উল্ফ অনেক ক্ষেত্রেই opportunistic scavenger এর ভুমিকা নেয়৷ হয়তো কোন এক ক্ল্যানের মানুষ উল্ফের মধ্যে যেগুলো একটু tame সেরকম দু একটা কাছে রাখা শুরু করে৷
এবং নেকড়ে থেকে কুকুর এর পরে বেশ দ্রুত৷ নেকড়ে এমনিতে বন্য এবং হিংস্র প্রানী৷ কিন্তু নেকড়ে আবার গোষ্ঠিবদ্ধ প্রানী, দলের আলফা নেকড়েকে মেনে চলে৷ মানুষ যেটা করেছে প্রতি জেনারেশনে সেই সব নেকড়েকে বেছে নিয়েছে যেগুলোর হিংস্রতা কম, অথচ মানুষকে আলফা নেকড়ে হিসেবে মেনে চলে৷ এভাবে প্রতি জেনারেশনে বাছাই করতে করতে কয়েক হাজার বছরে শুধু সেই নেকড়ে গুলোই সুযোগ পেয়েছে যারা মানুষের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে৷ এমনিতে প্রকৃতি লম্বা সময়ে এ ধরনের সিলেকশন করে (যেটা বিবর্তনের কারন), এক্ষেত্রে মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবে সিলেক্ট করে গ্রে উল্ফকে কুকুর বানিয়ে ছেড়েছে৷
আরো অদ্ভুত হচ্ছে এখন যে এত ধরনের/আকারের কুকুর আমরা দেখি এগুলোর সবগুলোই মানুষের হাতে বানানো৷ অনেকগুলো আছে যেগুলো গত কয়েকশ বছরে বানানো হয়েছে৷ যেমন বুলডগ, গত একশ বছরে এরকম চেহারা পেয়েছে৷ কুইন ভিক্টোরিয়ার আমলেও এখনকার চেহারার বুলডগ ছিল না৷ উনবিংশ শতাব্দির শেষ থেকে শুরু করে সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে বুলডগের আপাত হিংস্র চেহারা বানানো হয়েছে৷ আবার যেমন টেরিয়ার তৈরী করা হয়েছিল টুকটাক শিকারের জন্য৷ পিকিং এর লায়ন ডগ তৈরী করেছিল চিনের রাজারা, পরে ভিক্টোরিয়ান যুগে ইউরোপে ব্যপক জনপ্রিয় হয় ছোট সাইজের এই কুকুরগুলো৷
তবে মানুষ আর কুকুরের ২০ হাজার বছরের সম্পর্কের একটা ক্রান্তিকাল যাচ্ছে এখন৷ যেসব কারনে মানুষের জন্য কুকুর এত প্রয়োজনীয় ছিল সেগুলো বেশীরভাগই আর নেই এখন৷ আবার অতিরিক্ত ব্রিডিং এ এখন এমন কুকুর তৈরী করা হচ্ছে/হয়েছে যেগুলো বায়োলজিকালী আনফিট৷ এজন্য মনে হয় যেহেতু আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে কুকুরকে তার নিজের রাস্তায় যেতে দেয়াই ভাল৷
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।