(১) আমার এই লেখাটি শুরু করতে চাই ডিসিসি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে, কারন তারা জলাতঙ্ক প্রতিরোধের নামে কুকুর নিধনের মতো অমানবিক কাজে এখন আর উৎসাহী নয়। দেরিতে হলেও কুকুর নিধনের মত অমানবিক কাজের পরিবর্তে বন্ধাকরন, পালন এবং টীকা প্রদান এর মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী।
জলাতঙ্ক অবশ্যই একটি মারাত্মক রোগ । জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই । তবে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের নামে ব্যাপক হারে কুকুর নিধন কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথম আলোতেই ১৭ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখলাম, চলতি বছরে প্রায় ২৭৫০০ কুকুর মারা হয়েছে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের নামে । এই সংখ্যাটা ডিসিসি থেকে প্রাপ্ত আর সাধারণ মানুষের হাতে মারা যাওয়া কুকুরের সংখ্যাও আরও বেশি বলেই আমার ধারনা । ২৭৫০০ কুকুর এর সবগুলো রোগাক্রান্ত ছিল না । শুধু মাত্র জলাতঙ্ক রোগাক্রান্ত কুকুর গুলো চিহ্নিত করে মানবিক ভাবে মেরে ফেলা যেতো। প্রায়ই অনেক সচেতন নাগরিক অভিযোগ পাঠান কুকুর নিধনের জন্য ।
বেশির ভাগ চিঠির বিষয়বস্তু প্রায় একই রকম এবং প্রতিটি চিঠিতেই কোমলমতি শিশুদের কামড়ে দিতে পারার emotional blackmailing এর ব্যাপারটা থাকে । যেখানে ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষা , স্বাস্থ্য , বাসস্থান এইরকম মৌলিক অধিকার পূরণেই আমরা অক্ষম সেখানে কুকুর নিধনের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষায় আমরা খুব সচেতন । আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার দায়িত্ব নিশ্চয়ই কুকুর নিধনের মাঝে নিহিত নয় । স্বাভাবিক সুস্থ কুকুর কখনই কাওকে কামড় দেয় না যদি না তাকে বিরক্ত করা হয় । বিদেশে পশুদের উপর অত্যাচার এর জন্য কঠোর আইন আর বিধান রয়েছে ।
বাংলাদেশে যেখানে বিনা অপরাধে ছাত্রদের মেরে ফেলে লোকজন এবং তার কোনও বিচার হয় না, ইচ্ছামতো লোকজন ধরে নিয়ে যায় পুলিশ ডাকাতের আসামী হিসেবে সেখানে কুকুরের জন্য আইন আর কথা বলাই বাহুল্য । এইজন্যই হয়ত রাস্তায় চলতে ফিরতে মানুষের কুকুরের প্রতি হিংস্রতাই বেশি চোখে পড়ে আমার ।
(২) কুকুর সংক্রান্ত আমার জীবনের প্রথম ঘটনাটি ২০০৮ সালের । একদিন নিজ এলাকার রাস্তায় চলার সময় চোখে পড়ে কিছু ছিন্নমূল শিশু ২ টি কুকুর ছানার গলায় রশি পেঁচিয়ে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করছে । এরপর তাদের হাত থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের পর কুকুর ২ টি আমি বাসায় নিয়ে আসি সেবার উদ্দেশ্যে ।
এরপর মায়া হয়ে যাওয়ায় কুকুর ২ টি সুস্থ হবার পরও আমার সাথেই আছে । তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি বেশ কিছু কুকুর বাঁচিয়েছি মানুষের হিংস্রতা থেকে । আবার অনেক কুকুর বাঁচাতেও পারিনি পশু হাসপাতালের অপ্রতুলতা ও দূরত্বের কারনে । একবার হাতিরপুল এলাকায় একটি গাড়ির আঘাতে পা ভাঙ্গা কুকুর পড়ে ছিল রাস্তার মাঝখানে । গাড়িটি ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি যন্ত্রণাকাতর কুকুরটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার ।
প্রায়ই রাস্তায় কুকুর চোখে পড়ে লেজ জোরপূর্বক কাটা । সর্বশেষ ঘটনাটি এক বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের যিনি ৪ টি কুকুর ছানা পিটিয়েছেন অমানুষিকভাবে লাঠির মাথায় পেরেক গেঁথে ; যাদের অপরাধ ছিল তারা তার বাসার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল আর তাদের গায়ের রঙ ছিল কালো । কালো প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল, আমাদের ধর্মে কালো কুকুর মারতে নির্দেশ দেয়া আছে । এই প্রসঙ্গে আমার বিদ্যা খুব সীমিত বিধায় আমি কোনও মন্তব্য করব না । তবে একজন বিধর্মী মহিলার তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে বেহেশতে নাযিল হওয়ার কাহিনি পড়েছি ।
এই বিষয়ে নির্ভুল জ্ঞান থেকে থাকে তাহলে আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন । কুকুর ঘরে থাকলে রহমতের ফেরেশতা ঘরে প্রবেশ করেন না। ঠিক তেমনি ভাবে দেয়ালে মানুষের ছবি এবং প্রতিকৃতির শো- পিস থাকলেও । আমরা প্রিয়জনের ছবি দেয়ালে স্থান দিলেও এবং প্রতিকৃতির শো- পিস দিয়ে ঘর সাজালেও শুধু মাত্র কুকুর এর ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা অবশ্য পালনীয় । ৪ টি কুকুরের ২ টিকে বাঁচাতে পারিনি ওষুধ দিয়েও।
তবে ধন্যবাদ বন্ধু অভি আর নিশাকে, বাকি ২ টি কুকুরের যাবতীয় খরচ বহন করার জন্য ।
(৩) আজকাল অভিজাত এলাকার অনেকেই সখ করে কুকুর পোষেন। কিন্তু এই পোষার পেছনে কতটুকু কুকুরের প্রতি ভালবাসা , আর কতটুকু আভিজাত্তের প্রকাশ তাই বিবেচ্য বিষয় । দেশি কুকুর অথবা প্রচলিত ভাষার নেড়ি কুত্তা দেখে যারা মারতে উদ্যত হন তারাই আবার বিদেশি কুকুর দেখে আদর করে মাথায় হাত বুলাতে অথবা কোলে নিয়ে ছবি তুলতে উদ্গ্রিব হয়ে পরেন। আমার পরিচিত অনেকেই আমাকে বিদেশী কুকুর পালনের উপদেশ দিয়েছেন দেশি কুকুরের পরিবর্তে ।
একজন প্রকৃত পশুপ্রেমী কখনই একই প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সৌন্দর্যের ভিত্তিতে বৈষম্য করেন না। আমাদের বিদেশি কুকুর প্রীতির জন্যই কাঁটাবন এলাকায় গড়ে উঠেছে পশু পাখি বিক্রির অনেক দোকান যেখানে ছোট ছোট খাঁচার ভিতরে পশু পাখি দের নির্দয় ভাবে আটকে রাখা হয় বিক্রির আশায় । এই দোকান গুলো বিদেশি Pet Shop গুলোর মত animal friendly নয় । কুকুর পালন করতে চাইলে, আমরা সহজেই পারি রাস্তা থেকে দুর্বল এবং মাতৃহীন কুকুর ছানা পালনের জন্য নিয়ে আসতে । কুকুর বাসায় এনে পালন না করলেও আপনারা পারেন আপনাদের এলাকার কুকুর গুলোর দেখাশোনা করতে ।
পারেন তাদের আমাদেরই চারপাশের কিছু মানুষের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে। চা এর দোকানে বসে বন্ধুর সাথে আড্ডার ফাঁকে একটি সিগারেট কম খেয়ে ঐ টাকায় একটি অভুক্ত কুকুর কে খাওয়াতে পারেন। এই ভাবে যেমন দেশি কুকুরদের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান মিলবে তেমনি বিদেশি কুকুরদের বিক্রির জন্য খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে হবে না । যারা দেশী কুকুর এর প্রভু ভক্তি নিয়ে সন্দিহান তাদের বলছি, পশু প্রশিক্ষক না হয়েও sit, jump, go, come এবং sleep এর মত প্রাথমিক প্রশিক্ষণ আমি আমার সবগুলো দেশী কুকুর কে দিয়েছি । চাইলে ঘর পাহারার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দেয়া সম্ভব ।
সুন্দরবন এলাকার প্রতিটি বাড়িতে কুকুর পালন করা হয় বাঘ এলে আগাম সংকেত দেয়ার জন্য । PETA (People for the Ethical Treatment of Animals)
-র নতুন আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সম্প্রতি বিদেশের অনেক সেলেব্রিটি রাস্তার কুকুর পালন করছেন । আমরা যদি আমাদের প্রিয় তারকা কে দেখে তাদের মতো জামা কাপড় পরি, তারা যে সুগন্ধি, ঘড়ি ব্যবহার করেন আমাদের ও তাই চাই, তাদের নিউ হেয়ার স্টাইল আমাদের যদি অনুসরণ করতেই হবে, তবে তারা রাস্তার কুকুর পালতে পারলে আমাদের পক্ষেও সম্ভব । PETA এর recent ethical campaign হল– Buying animal is killing animals. Always adopt, never buy.
(৪) কুকুর কে প্রায়ই বলা হয় মানুষের সব থেকে প্রাচীন এবং অকৃত্রিম বন্ধু । কুকুরের সাহসিকতার বহু সত্য কাহিনির কথা হয়ত অনেকেই শুনেছেন ।
যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তারা পড়ে দেখতে পারেন Brave Tales of Real Dogs(Author: Eleanor Fairchild Pease) । নোবেল বিজয়ী পক্ষীবিশেষজ্ঞ জীববিদ কনরাড লোরেঞ্জের Man meets Dog বইটিও পড়ে দেখতে পারেন। দেখে নিতে পারেন সত্য কাহিনীর উপর নির্মিত Hachi: A Dog's Tale
সিনেমা টিও । হাচিকো সম্পর্কে আরো জানতে হলে, পড়ে দেখবেন ব্লগার সজল শর্মা এর অসম্ভব সুন্দর একটি লেখা
হাচিকো- এক মহান কুকুর
দুঃখজনক হলেও আমি বাংলাদেশে প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা কোনও প্রতিষ্ঠানের খোঁজ এখনো পাইনি । বাংলাদেশের প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করে এসব প্রতিষ্ঠানের (যদি থেকে থাকে) উচিত, তাদের কার্যক্রম গুলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরা।
জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে তাদের কার্যক্রম এর আরও প্রসার প্রয়োজন । শেষ করছি Marley & Me
সিনেমা এর একটি উক্তি দিয়ে –“A dog has no use for fancy cars, big homes, or designer clothes. A dog doesn't care if you're rich or poor, educated or illiterate, clever or dull. Give him your heart and he will give you his.”
Also Prothom Alo have published one of my letters -
View this link
আপডেট ঃ বাংলাদেশের প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান - Obhoyaronno - Bangladesh Animal Welfare Society
এই ছবিতে দুটি কুকুর এক সঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায়ই প্রাণ হারায় নারী কুকুরটি। সঙ্গীর আকস্মিক নির্মম এ মৃত্যু পুরুষ কুকুরটাকে ভীষণ আহত করে। ভালবাসার সঙ্গিনী হারিয়ে নির্বাক কুকুর।
রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত সঙ্গিনীর আবার জেগে উঠার আশায় গত তিনদিন শিউরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। কখনও তার গা শুকছে,কখনও পাশে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে, কখনওবা পাশে গিয়ে বসে থাকছে। এই ক’দিন জীবিত কুকুর কিছুই মুখে দেয়নি। প্রাণীদের মধ্যে এই ভালবাসা দেখে মানুষের হৃদয়কেও নাড়া দিচ্ছে। খাবার দিচ্ছেন কেউ কেউ।
কিন্তু কারও খাবার নিচ্ছে না সে। তাড়িয়ে দিলেও আবার চলে আসছে মৃত কুকুরের পাশে। ঘটনাটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-মৌলভীবাজার সড়কের ব্রাহ্মণবাজারে ঘটেছে।
আশার কথা মানবতা এখন ও হারিয়ে যায়নি -
প্রথম ছবিটি অস্ট্রেলিয়া ও পরেরটি শ্রীলঙ্কা এর। আমরা কি পেরেছি এমন কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে?
এই ছবিটি সাম্প্রতিক চীনে ঘটে যাওয়া একটি চমকপ্রদ কাহিনী।
গাড়ির আঘাতে একটি শিশু রাস্তায় পড়ে ছিল অনেকক্ষণ। একে একে তার পাশ দিয়ে চলে যায় ১৪ জন, কেও ফিরেও তাকায়নি । শেষে এক ভিখারি তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর বামের ছবিতে গাড়ির আঘাতে মুমূর্ষু একটি কুকুর কে আরেকটি কুকুর ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। মানুষ কি আসলেই সৃষ্টির সেরা জীব ?
আমার এই লেখাটি ইতিপূর্বে অন্য ২ টি ব্লগে প্রকাশিত।
সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পুনরায় প্রকাশ করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।