[আসিয়া জেবার। উত্তর আফ্রিকার জনপ্রিয় ও সুদূর প্রভাবশালী লেখক। 'আলজেরিয়ান হোয়াইট' ও 'সো ভাস্ট দ্য প্রিজন' বই লিখেছেন। সামাজিক বাধা আর জটিলতর জীবন যাপন থেকে মুক্তির ল্যে ছটফট করা মুসলিম বিশ্বের মেয়েদের জগত নিয়ে বারবার ভেবেছেন তিনি। লিখেছেনও।
2005-এ একাডেমি ফ্রান্সিয়েস পেয়েছেন। 2000-এ জার্মান পিস প্রাইজ, 1996-এ সাহিত্যে নিউস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজসহ আরো অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। কাজ করছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে, ফ্রান্সোফোন লিটারেচার ও সিভিলাইজেশনের সিলভার প্রফেসর হিসেবে। আসিয়া জেবার রচিত তার বই 'দ্য টাঙস ব্লাড ডাজ নট রান ড্রাই'-এর পোস্টস্ক্রিপ্ট থেকে নেওয়া হয়েছে লেখাটি]
এ হলো আলজেরিয়ার মেয়েদের গল্প। আলজেরিয়া যাদের জন্য অশেষ অন্ধকারের জাল বিছিয়ে রেখেছে।
এ মেয়েরা পুরাতন নয়, চলতি আলজেরিয়ার।
আগন্তুক আর প্রস্থানরত মেয়ে পর্যটকদের ভেতর দিয়ে, মেয়ে যাত্রীদের ভেতর দিয়ে আঘাত আর শান্তি ঘুরে ফিরে আসে। রেডিওর রিলে স্টেশন কিংবা রাত কাটানোর জন্য অল্প টাকায় ভাড়া করা কোনো ঘরে তারা তাদের নিশ্বাস নিয়ে খেলা করে। আর ভাবে। আর মনে করার চেষ্টা করে_ মঞ্চ উড়ছে না, তবে নড়ছে।
এ প্রান্তের আলজেরিয় মেয়েদের কথাগুলো, ডায়লগগুলো অন্যপ্রান্তের, অন্যদেশের আলজেরিয় মেয়েদের কাছে পৌঁছে বয়ে আনে প্রতি-উত্তর। জোড়াতালি দেওয়া জীবন হুট কের নড়ে ওঠে, উদ্দিপনায়। আবার ভেঙে পড়ে : কতগুলো ছবি, তারপর পিছু নেওয়া মৃতু্যর উড়াউড়ি। অবশ্য যন্ত্রণাময় এ দীর্ঘরাতের ফাঁকফোঁকরে মাঝে মধ্যে জ্বলে ওঠে আলোর সলতেও।
গল্প থেকে গল্পের ভেতরে চলন্ত সময় বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ায়, প্রতিদিন : ধূসর কিংবা কালো মুক্তোর মতো অধ্যায়ে।
তারপর শুরু হয়। নতুন করে। গল্পকার ভেসে চলে নতুন স্রোতে।
নিজেদের জ্ঞান, নিজেদের চাকরি কিংবা সংহতির জন্য গল্পের মেয়েগুলো উদ্বেগজনক প্রতিপ হয়ে ওঠে। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে, পরীা থেকে যন্ত্রণায়, প্রতারণায়, অবদমন কিংবা দুঃখের ভেতর দিয়ে ধেয়ে চলে গল্প।
কোনো রকম আপত্তি ছাড়াই। এ গল্প নিরবতার নয়। আত্মসমর্পনেরও নয়। শব্দগুলো, সব থাকা সত্ত্বেও, ক্রোধ নিয়ে, ব্যথাকে মুচড়ে দিয়ে কিছু নির্দেশ স্থাপন করে। ভয়ের কালিতে খোঁজ মেলে এক চিলতে আলোর।
এমন সময় মৃতু্য খুলে ফেলে নিজের মুখোশ, সামনে দাঁড়ায়। তারপর বীভৎস দাঁতে হাসতে হাসতে আচমকা নাই হয়ে যায়...
কাজে যাবার কালে, স্কুলে, হাসপাতালে, অফিসে কিংবা প্রাত্যহিক কেনাকাটার জন্য মার্কেটে গেলে শিশু থেকে বৃদ্ধ মহিলারা কী আশা করে? তারা তাদের হৃদয়কে গিঁট বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যায়। সাদা কিংবা কালো কাপড়ের ন্যাকড়ায় মুখ ঢেকে দাঁতে দাঁত পিষে। কারো কারো আবার মাথা খোলা থাকে। তাদের চুল পতপত করে উড়ে বাতাসে।
তাদের চোখ কোনো বিপদকেই তোয়াক্কা করে না।
আমি, এই গল্পগুলোতে যাদের ছায়াশরীর নির্মাণ করেছি, তাদের হাঁটাচলাকে স্থায়ী করে, তাদের ঘরের বাইরে রেখে, যদি প্রয়োজন পড়ে, সূর্যের শরীরে কলঙ্কের ছোঁয়া লাগলেও, আমি তাদের ঘিরে স্বপ্নবান হয়ে উঠেছি। এই বইয়ে তাদের মনে রেখেছি আমি।
বেশিরভাগ েেত্র তারা তাদের নায়িকা হিসেবে ভাবে না। ভাবে না ভিকটিম হিসেবেও।
তারা শিউরে ওঠে। কেউ নেকাব পড়ে। কেউ পড়ে না। কেউ শেকল পড়ে হাতে। কেউ না পড়ে বিপদের পাশ দিয়ে দেদারছে হেঁটে যায়।
তারা বাঁচে ছেলে কিংবা ভাইয়ের জীবনের উপর দাঁড়িয়ে। কখনো কখনো নিজেদের শরীর উপরেও দাঁড়াতে শেখে কেউ কেউ।
এক সময় আমি নিজেকে বলেছিলাম : 'তুমি তো তাদের দূর থেকে দেখেছ। তারপর তাদের শরীর ও মনের খুব কাছাকাছি নিজেকে কল্পনা করে লিখতে চেয়েছ...'। যে মরে গেছে, অথবা যে আশ্রয় খুঁজছে, অথবা যে নিরবতাকে সঙ্গী করে নিয়েছে, যে চোখ লাল করে ফেলেছে উত্তরণের পথ খুঁজে_ তাদের নিচু করে লেখা কতো সোজা?
সব মিলিয়ে তাদের ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠার দৃশ্য অাঁকতে গিয়ে জেনেছি, রক্ত_ তাদের রক্ত_ কোনো কথার তাপেই শুকোবে না।
নামটি বাছাই করেছি সে চিন্তা থেকেই।
আমার েেত্র আলজেরিয়ান বাস্তবতা আমাকে ঠেলে দিয়েছে সন্ত্রাসী ও বিদেশী কিছু ঘাতকের বিকলাঙ্গ শরীর, বিকৃত মুখ, আঘাত, কোয়ারসেনিস বন থেকে ণিক দেখা তাদের তী্নতার ভয়ে। আমি এমন একজনকে জানি, যে খুব কষ্ট করে সবাইকে আগুনের বোমা থেকে বাঁচিয়ে একতাবদ্ধ রেখেছে গত তিরিশ বছর ধরে। আলজেরিয়া, অগি্ন প্রোপটের বিপরীতে তুমি একটা দাফনের মুখোশ!
হঠাৎ করেই লেখক ফ্রান্সিস পঙের কথা মনে পড়ল। জার্মান দখলদারিত্বের সময় মাইকেল বুটর তাকে 'দ্য মাস্টার অব স্টিল লাইফ পোয়েট্রি' বলে ডাকত।
সে তখন একটি উদ্বাস্তু শিবিরে তার ফ্যামিলির সাথে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। 1942-এ লিখতে শুরু করে সে...।
'সোপ' আখ্যানকে স্মরণ করে সে বলেছে : 'আমরা যুদ্ধের ভেতরে ছিলাম। তার মানে, অনটন ও রেশন সংক্রান্ত সকল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। অভাব ছিল সোপের, মানে প্রকৃত সাবানের।
' বোধ করি অবচেতনভাবে এ বিষয়টা আমার ভেতরে কাজ করেছে। ফলে অনেকে বলতে পারে আমি 'সোপ' থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি'!
পোঙ তার 'সোপ' সংক্রান্ত টেঙ্টগুলো ক্যামাসকে পাঠিয়েছিল, জেলিমার্ড পাবলিশিং হাউসে। উত্তরে ক্যামাস লিখেছিল : 'সোপ নিয়ে আপনার ভাবনা আমার কাছে পুরো পরিষ্কার নয়... বোধ করি টেঙ্টগুলোতে কিছু শব্দ বাদ পড়ে গেছে!'
পরে জার্মানদের কানে 'সোপ' রেডিও নাটক হিসেবে বেজে ওঠেছে। আর বইয়ে ছাপা হয়েছে 1967-এ। 1942 থেকে এ সময়ের মধ্যবর্তীতে যেকোনো চরিত্রের আর্তনাদ নিয়ে ছড়িয়েছে 'সোপ' : 'মেধাকে পবিত্রকরণে, সোপ একটুখানি ব্যবহৃত হতে পারে।
সমান্তরাল তীব্র জলধারা কোনোকিছুতে থেকে ময়লা সরাতে পারে না। পারে না নিরবতাও। পারে না কালো জলে তোমার সুইসাইড, ও প্রকৃত পাঠক!'
ফলে মেধাকে পবিত্রকরণে সোপ বা সাবানের শুকনো জিহ্বা খুঁজে পেতে পারে ফ্র্যান্সিস পোঙ। কারণ এ কবি আলজেরিয়ায় এসেছিল 1945-এ, আলজেরিয় যুদ্ধের পর। একদিন বি্লডা'র কাছে, এটলাস পাহাড়ের কাছে ধ্যানীর মতো মিটিজার সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে, গোলাপী রঙকে বর্ণনা করার জন্য সে শব্দ খুঁজছিল আকাশে, 'অগি্নগর্ভ, সুতী্ন...' কোন শব্দটা যে যথার্থ, সে খুঁজছিল আর খুঁজছিল।
ভাবছিল_ 'মনে হচ্ছিল এ যেন আলজেরিয় মেয়েদের গোঁড়ালির গিঁটের মতো গোলাপী রঙ! এ তাদের শরীরের একমাত্র ভাঁজ, যা তুমি প্রকাশ্যে দেখতে পারো। '
পোশাকে ঢেকে রাখার বাইরে আলজেরিয় মেয়েদের শরীরের যে অংশগুলো দেখা যায়, তা নিজদেশের মেয়েদের ছায়াশরীরের সঙ্গে মিলিয়ে তী্নভাবে পাঠ করার মতা আছে ভীনদেশী ফ্র্যান্সি পোঙের। [নেকাব সম্বন্ধে সে নোট করেছে, মেয়েটির সারা শরীর ঢাকা। মুখও। 'শুধু একটা চোখের চাহনি টের পাওয়া যায়, যদিও চোখ নেকাবের পাতলা আবরণের গভীরে ঢাকা পড়েছে'] ফলে গোঁড়াালির গিঁট নিয়ে বলেছে, 'তাদের শরীরের কেবল এই অংশটাই তুমি প্রকাশ্যে দেখতে পাবে'।
ফলে সেই গোলাপী রঙকে ধন্যবাদ, যাকে রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্য দেখলেও আরব ছেলেরা বুঝে নিতে পারে নাম না জানা এ মেয়েটার ব্যক্তিত্ববোধ কেমন!
তো, এই হলো আলজেরিয়া, যেখানে বোরকা ঢাকা মেয়েদের গোঁড়ালির গিঁটের মতো গোলাপী রঙের সূর্য ডুবে। আর পোঙ তাকে 'গর্দভ গোলাপী' বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
তার চিন্তার বিচণতায় সে তার ভেতরটা আর স্বজাতি স্বরকে পবিত্র করেছে, যেখানে সে বাস্তবের ভেতরের অন্ধকারটা সংগ্রহ করেছে কেবল! উপসংহারে সে বলেছে : 'থমকে থাকা জগতটা আমার দেশ। '
আলজেরিয়া প্রসঙ্গে 'থমকে থাকা জগত'_ এই বিশেষণটা কেবল বাহ্যিক জিনিসগুলোকেই [বামন মানুষ, কমলা, ডুমুর...] বোঝায় না, বরং একই সঙ্গে প্রজন্ম, নারীদের গণ্ডি, মুখোশ, চোখ ভরে দেখার ইচ্ছেতে বাধ সাধা বা দেখলেও কিছু করতে না পারা_ এসবও এর মধ্যে আছে।
বর্তমানের সকল যন্ত্রণা ও প্রবাহের মধ্যে মেয়েরা একটা ভাষা খুঁজছে : এমন স্বর চাই যাতে অনিশ্চিত পরিবেষ্টনের তাদের জীবনকে তারা গচ্ছিত রাখতে পারবে, লুকাতে পারবে, বিদ্রোহের বাসা বানাতে পারবে।
'সমান্তরাল তীব্র জলধারা কোনোকিছুতে থেকে ময়লা সরাতে পারে না'_ পোঙ তার 'সোপ'-এ বলেছে। আর আমি তার টেঙ্ট থেকে সে শব্দগুলো ধার করব বলে ভাবছি, যে শব্দগুলো বিনয়কে গোপন করতে শেখায় আর আমার নিজের ভাবনার জগতের অপর্যাপ্ততা কমাতে পারে! এই ফরাসি কবির :
'পারে না নিরবতাও। পারে না কালো জলে তোমার সুইসাইড, ও প্রকৃত পাঠক!'
এই লেখাগুলোতে আছে [এখানে একটি উপন্যাসিকা ও একটি গল্পও আছে] আলজেরিয়া আর ফ্রান্স_ এই দুই দেশের মধ্যে আমি যা খুঁজে বেরিয়েছি তা আর শুধু আকাঙ্খা ও মৃতু্যর মধ্যে আলজেরিয়ার খণ্ড বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া। আমার প্রেরণাকে এগিয়ে যেতে কী গাইড করেছে_ ভিত্তিহীন, ব্যবহারহীন, আমার অগুণতি বোনের ঠোঁটে সন্ত্রাসী ভয়ের কলুপ, সঙ্কেত, দেশত্যাগ করা বা বিপদগ্রস্থ হওয়া? কিছুই না, শুধু 'প্রকৃত পাঠক'কে পেতে, যে নিরবতায় আর সংহতিতে লেখাকে অনুসরণ আর খুন করবে, অন্তত ছায়া যেন দিগন্তের পানে যেতে ডানা ঝাপটায়...
কিন্তু আমি ভাবি : এতো রক্তয়ের পর, এখনো কি সূর্যাস্তের কালে আলজেরিয়ার আকাশ মেয়েদের গোঁড়ালির গিঁটের মতো গোলাপী হয়ে ওঠে?
[অনুবাদ : রুদ্র আরিফ। খিলক্ষেত, ঢাকা।
এপ্রিল 2007]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।