আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পণ্য নারী

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

একদম ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি আমার সবচেয়ে বড় খুঁত, আমি 'কালো'। পাঁচ ছয় বছর বয়সেও বুঝতাম, ভীষণ অন্যায় কথা বলছে। তখন কেঁদে ফেলতাম, বা ভীষণ মন খারাপ করতাম। আশে পাশে যদি মা বা বাবা থাকত, তাহলে কারও 'কাল মেয়ে তো' মন্তব্য শোনার সাথে সাথেই আমাকে বুকে টেনে নিত... 'কাল তো কি হয়েছে? গায়ের রং দিয়ে কিছু এসে যায় না, মেয়ে আমার মানুষ হলেই হল।

' এখন ভাবি, কালোকে সুন্দর বলার মত মানসিকতা আমাদের সমাজে এখনও গড়ে ওঠে নি। কেউ কালো হলেই তাকে অন্য গুণ দিয়ে এই ঘাটতি পূরন করতে হয়! সে যাক গে, যা বলছিলাম। একটু বড় হওয়ার পরে, কালো ডাকায় মন খারাপ দেখানো বন্ধ করেছি বটে, কিন্তু তার পিছনে অস্ট্রেলিয়ার সমাজের হাত আছে অনেক। 'ডার্ক' ডাকা তো রীতিমত কমপ্লি্লমেন্ট। অটো ট্যান, কি যে ব্লেসিং! গায়ের রং আমাদের বাঙালী শ্যামলা কালো হওয়া মানে রং, বর্ণহীন, ফ্যাকাশে সাদার চেয়ে অনেকগুণে প্রানবন্ত।

আকর্ষণীয়। কিন্তু এখানে যে অন্য সমস্যা! সেদিন ইশির সাথে শপিঙে গিয়েছিলাম। ওই যে, পুতুলগুলো সাজানো থাকে কাপড় চোপড়ে, ওগুলোর একটা দেখে ইশি বলছে, "উফ, আমি হঠাৎ ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি সত্যি মেয়ে"। আমি বললাম, "হু, কারণটা হচ্ছে, এখনকার মেয়েরা সব দিন দিন পুতুল হয়ে যাচ্ছে। " সত্যি কিন্তু।

চোখ বন্ধ করে ভাবুন বার্বি ডল দেখতে কেমন। সিলকি চুল, উঁচু ভ্রু, পাতলা নাক, সুন্দর ঠোঁট... হাই স্কুল থাকতেই দেখতাম প্রতিটা মেয়ের চুল সিল্কি। প্যান্টিন আর হেয়ার স্ট্রেইটনারের আর্শিবাদ। প্লাক করা একই মাপের ভ্রু। লিপ গ্লস দিয়ে ঠোঁটের রঙ আর আকারও একই রকম করা।

এগুলো তো সস্তা উপায়। কিন্তু কিছু কিছু প্রত্যাশা বড় দামী। শরীরের আকার... আওয়ার গ্লাস ফীগার হল প্রত্যাশিত আকার। কয়টা মেয়ে এই প্রত্যাশিত ফিগার নিয়ে জন্মে? সিলিকন দিয়ে শরীরের মাপ বাড়ানো মেয়ের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে (যা করলে শরীরে অনুভূতি কমে যায়। ফলাফল: নিজেকে 100% সার্ভিস মেশিন বানানো!) ডায়েট করে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও ওই স্বপ্নের হালকা শরীরটুকু চাই।

কারণ সমাজ চায়। হাতের নখ, পায়ের নখ, মুখের ত্বকের, ত্বকের ছিদ্র, লোম, গোটা.... সব খুঁটি নাটি ব্যাপারে প্রত্যাশার পর প্রত্যাশা। এখন যে ঐশ্বরিয়ার পুতুল সৌন্দর্য্যের যুগ, আগা গোড়া পুতুল, নিখুঁত পুতুল। ওরকম নাক নিয়ে জন্মাও নি, তো কি হয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে নাক বদলে ফেল ওই নাক ফুল পরার জন্য! (মজা লাগে, মানুষগুলোর চোখ বদলানোর কথা কেউ যে বলে নি!) হ্যা, এখন আর বিয়ের আগে চুল টেনে, ঘরের এমাথা থেকে ও মাথা হাঁটিয়ে, পায়ের গোড়ালী দেখিয়ে মেয়ে 'পরখ' করা হচ্ছে না, কিন্তু, যুগের পরিবর্তনের সাথে পরখ করার ধরণ ধারন বদলে গিয়েছে। হাজার গুণ কুৎসিত রূপে পুনরোত্থিত হয়েছে।

নারীকে এখন আর অনিচ্ছায়, মাথা নিঁচু করে কপালের দোষ দিয়ে শুধু মেনে নিতে বলা হচ্ছে না বস্তু হিসেবে 'পরিক্ষীত' হওয়ার ব্যাপারটা.... উপরন্তু, নারীকে সামাজিক উৎসাহ দেয়া হচ্ছে এই 'পরিক্ষীত' হওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে। এখন যে, মডেল: প্রতিটা নারী বিউটি প্যারেডের স্থান: কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট, শপিংসেন্টার এবং যেখানেই একজন দর্শক আছে বিচারক: সমগ্র সমাজ! কি ভীষণ নোংরা এই মানসিকতার বর্তমান বিবর্তিত রূপ! আমার খুব বিচ্ছিরি লেগেছে যখন কয়েক মাস আগে একজন সনামধন্য, ভীষণ ট্যালেন্টেড 'পুরুষ' ব্লগারের পুরো একটা গবেষণাধর্মী পোস্ট ছাড়লেন মেয়েদের শরীরের মাপ নিয়ে। এবং তাতে সব পুরুষের উৎসাহী অংশগ্রহন। নারী এখন 'পণ্য'। খোলস সর্বস্র।

মাপামাপির যোগ্য 'বস্তু'। ডা ভিঞ্চি কোডসহ ড্যান ব্রাউনের বইগুলো পড়ে খুব মজা পাচ্ছিলাম। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, নারীকে তার বুদ্ধির ব্যবহার এবং জ্ঞানের জন্য সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে... কিন্তু আরেকবার ভাবুন! সেই নারী সহযোগীদের কারো যে খুঁতালো ফিগার নেই সেটা কিন্তু একদম পরিষ্কার করে বলা সাথে সাথেই! উহু, হিপোক্রিট হবো না। সৌন্দর্যের দরকার নেই, তা বলব না কখনও। কিন্তু এতটুকু জানি, কেউ শারিরীক ভাবে একটু বেশি সুন্দর।

কেউ একটু কম। কারো নাক সুন্দর তো কারো চোখ সুন্দর। সব সুন্দরই নিজের মধ্যে আনতে চাইলে মানুষ হওয়ার যেই ভীষণ আনন্দময় অভিজ্ঞতার একটা হলো বৈচিত্র্য দেখা, বৈচিত্রময় হওয়া, অন্যের চেয়ে আলাদা হওয়া, তা কোথা থেকে পাবো? মনোবিজ্ঞানীরা জানেন, বিড়াল, কুকুর আয়নার নিজের চেহারা দেখে চিনে না। সেই দিন চাই না, যখন মানুষ বউ গুলিয়ে ফেলবে। সবগুলো ঐশ্বরিয়া রায়ের ভিড়ে।

এই সচেতনতাটা কেবল নারীর ইচ্ছায় হবে না, পুরুষের সবটুকু ইচ্ছা, সহযোগিতা থাকা লাগবে! আমাদের প্রত্যেকের অনেক ঐশ্বর্য আছে। শারিরীক সৌন্দর্যকে যেমন স্বাস্থ্যকর জীবন পদ্ধতির মাধ্যমে ঠিক রাখা যায়, তেমনি ব্যক্তিত্ব শারিরীক সৌন্দর্য্য ছাপিয়ে উঠে প্রায়শই... আমাদের ভালবাসা বাড়াতে হবে 'সুস্থতার' প্রতি, অসুস্থ, কৃত্রিম, অসম্ভব সৌন্দয্যর্ের প্রতি নয়। কৃতজ্ঞতা: এসব ভাবনা ভাবতাম অনেক আগে থেকেই। কিন্তু যেই ভিডিওটা দেখে সত্যিই মন খারাপ হলো, তা হলো কিলিং আস সফটলি মিডিয়া কি করে নারীর মানুষ রূপ প্রতিদিন একটু এবং আরেকটু করে ধ্বংস করছে। নারীকে নেহায়েত বস্তু বানিয়ে ছাড়ছে।

খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা ভিডিও। একটু সময় বের করে প্লীজ দেখে ফেলুন লিংকে ক্লীক করে... ভিডিওটা পেয়ে গেলাম একটা আপুর ব্লগে অনেক দিন পরে গিয়ে। থ্যাঙ্ক য়ু আপু, ইফ য়ু আর রিডিং দিস।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.