আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাশিয়া 1919 (পর্ব 4, মস্কোর প্রথম দিনগুলি)

timursblog@yahoo.com

4. দিনটা ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা । আমি ট্রেন থেকে নেমে মেত্রোপোল হোটেলে যাবার জন্য স্লেজ-চালকদের জিগ্যেস করতেই ওরা একশো রুবল চেয়ে বসল । একবছর আগে আমি যখন কর্নেল রবিন্স এর সাথে এসেছিলাম তখন আমরা সর্বোচ্চ দশ রুবল ভাড়া দিতাম, অধিকংশ সময় আট রুবলেই হয়ে যেত । অনেক কথা কাটাকাটির পরে পঞ্চাশ রুবলে রফা হল, আমার সাথে লাগেজ বলতে ছিল কেবল একটা টাইপরাইটার । রাস্তায় পুরু হয়ে বরফ জমে আছে, পেত্রোগ্রাদের থেকে কম পরিস্কার, তবে গত বছরের মস্কো থেকে বেশি সাফ করা হয়েছে ।

রাস্তায় ট্রাম চলছে, এবং আমার মনে হল প্রায় ততগুলো স্লেজ চলছে রাস্তায় । স্লেজটানা ঘোড়াগুলোর স্বাস্থ্যও গত গ্রীস্মের থেকে সামান্য ভাল বলে মনে হল । আমি স্লেজ-চালককে জিগ্যেস করতে ও বলল এখন মানুষের ঘোড়াদেরও সামন্য যবের রেশন দেয়া হয় । অনেক লোকজন আছে রাস্তায়, কিন্তু বন্ধ দোকানপাটের সংখ্যা দেখলে মন খারাপ হয় । আসলে তখন সমস্ত ব্যাবসা বানিজ্যের জাতীয়করণ চলছিল, আমি যাওয়ার আগেই বেশ অনেক দোকান আবার চালু হয় সমবায় হিসেবে ।

নতুন দোকান গুলোর নাম ছিল অনেকটা এরকম, '5 নম্বর বুটের দোকান, মস্কো সোভিয়েত,' '3 নম্বর কাপড়ের দোকান মস্কো সোভিয়েত,' '11 নম্বর বইয়ের দোকান মস্কো সোভিয়েত' । ফটকাবাজরা যা করত তা হচ্ছে ধরা যাক আধা ডজন ওভারকোট কিনে সবচেয়ে বেশিদাম যে হাঁকছে তার কাছে বিক্রি করে দিল, যে ভাবে টাকা আছে এমন লোকেরাই জিনিস কিনতে পারত । একন কেউ যদি কাপড় পেতে চায় তাকে তার আবাসিক কমিটিতে গিয়ে পুরনো কাপড় দেখিয়ে কমিটকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে তার সত্যিই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন । ফটকাবাজি বন্ধ করার জন্যই এমন করা হয়েছে । মেত্রোপোল হোটেলে আমার জন্য অন্য চমক অপেক্ষা করছিল ।

দেয়ালে গত গ্রীস্মের শেলের গর্ত আর গুলির দাগ মেরামত করা হয়েছে । লিতভিনভ আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশারিয়েটের কারাখানকে দেয়ার জন্য । দাড়ি-গোঁফ সজ্জিত কারাখান (অথবা কারাহান, যেহেতু রুশ ভাষায় 'খ' এর উচ্চারণ হ এর মত হয়) সুপুরুষ আর্মেনিয়ান, রাদেকের ভাষায় 'একজন ক্লাসিকালসৌন্দর্যমন্ডিত গর্দভ' । কারাখান সবসময়ে বহির্বিশ্বের সাথে মানিয়ে চলার পক্ষপাতি, বললেন অভ্যাতদের ক্রেমলিনে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে । আমি যখন বললাম, আমি ক্রেমলিনে থাকার চেয়ে একটা সাধারন হোটেলে থাকাই বেশি পছন্দ করব, তখন তিনি হোটেলের অনুমতি যোগাড় করে দিলেন ।

কাজটা মোটেই সহজ ছিল না, কারন এজন্য নির্বাহী কমিটির স্ভের্দলভের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হল আমি মেত্রোপোল হোটেল বা ন্যাশনাল হোটেল, এ দুটোর কোন একটাতে আমি থাকতে পারি । প্রথমটা সাধারনত সরকারী ডেলিগেটদের জন্য, তবে দেখা গেল দুটো হোটেলই একেবারে ভর্তি । অতএব আমাকে লোসকুৎনায়া হোটেলে জায়গা দেয়া হল, যেটা তখন নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের থাকার জায়গা ছিল । থাকার জায়গা কাপড়ের মতই বরাদ্দ করা হত, জরিপ চালিয়ে মানুষে চাহিদা মাপা হচ্ছিল । আবাসিক কমিটিতে গিয়ে সবাই থাকার জায়গার জন্য আবেদন করতে হবে ।

প্রত্যেকের একটা করে কামরা থাকবে যতক্ষণ না সবার জন্য দুটো কামরা পাওয়া যায় এই নীতিতে বিশ্বাসী কর্তৃপক্ষ । মস্কোর কাছের এক কারখানা ম্যানেজার বললেন তাঁর বাড়ির একট অংশ কারখানার শ্রমিকদের থাকবার জন্য দিয়ে দেয়া হয়েছে । এই আইন অবশ্যই বাড়ির মালিকদের ভীষন কষ্টকর, এবং অনেক নতুন লোক এসে বাড়ির অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দেয় । কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর পররাষ্ট্র কমিশারিয়েটের চিচেরিনের সাথে কথা বললাম । কারখানের চেয়ে অনেক কম বন্ধুত্বপুর্ণ চিচেরিন, বয়স আনেক বেড়ে তাঁর ।

ইংল্যান্ডের কথা জানতে চাইলেন তিনি । আমি বললাম লিতভিনভ এ ব্যাপারে আমার থেকে ভাল জানেন । আজকেই লিতভিনভের একটা সাক্ষাৎকার টেলিগ্রাফ করে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি । আমি ব্যাক্তিগতভাবে বললাম যে, রাশিয়ার মত একটা বিশাল দেশকে অবরোধ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না । এরপরে প্রাচ্য বিষয়ক কমিসার ভোযনেসেনস্কির সাথে আলাপ হলো আমার ।

মেত্রোপোলে খাবার জন্য একটা টিকেট দিলেন তিনি আমাকে । টিকেটটা ন্যাশনালে জায়গা পাবার পরে আমাকে ছাড়তে হয়েছিল । ডিনারে ছিল একপ্লেট স্যুপের সাথে অন্য একটা কিছু । প্রতি গ্লাস পাতলা চা ত্রিশ কোপেক করে বিক্রি হচ্ছে । আমার বোন আমাকে এক প্যাকেট স্যাকারিন দিয়েছিলেন ।

আমার বন্ধুরা যেভাবে স্যাকারিনে মিষ্টি করা চায়ের উপর বাচ্চাদের মত হামলে পড়লেন দেখে মায়াই লাগছিল আমার । মেত্রোপোল থেকে লোস্কুৎনায়া হোটেলে গেলাম আমি । ছ'মাস আগে এই হোটেলের পরিবেশ অনেকটা পরিচ্ছন্ন ছিল । কিন্তু নাবিকরা হোটেলটাকে কী রকম নোংরা করে ফেলেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । ঘর গরম করার কোন ব্যাবস্থা নেই আর খুব সামান্য আলোর ব্যাবস্থা হোটেলে ।

ঘরের কোন একটা পুরনো সামোভার আর ঘরভর্তি নানান আবর্জনা । বেয়ারাকে ডাকিয়ে এনে ঘরটাকে কিছুটা সাফ করলাম । একটা নতুন সামোভার আনানো গেল, কিন্তু কোন কাঁটাচামচ, চামচ বা ছুরি দিতে পারল না ও । অনেক কষ্টে পানি খাবার গ্লাস আদায় করা গেল ওর কাছ থেকে । টেলিফোনটা অবশ্য ভাল আছে এবং চা কাবার পরে আমি মাদাম রাদেকের সাথে কথা বললাম, উনি মেত্রোপোল থেকে ক্রেমলিনে চলে গেছেন ।

এখনো ক্রেমলিনে যাবার পাস পাইনি আমি । উনি বললেন কমান্ডান্টের কাছ থেকে পাস যোগাড় করে দিতে পারবেন তিনি । তুষার ঢাকা রাস্তা ধরে পার্কটার পাশ দিয়ে, সেতু পার হয়ে ক্রেমলিনের ফটকে এসে হাজির হলাম আমি । গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে কয়েকজন সৈন্য । মাদাম রাদেক সেখানে হাত গরম করছিলেন, আমাকে তিনি ক্রেমলিনের ভিতরে নিয়ে গেলেন ।

ক্রেমলিনে তখন কমিসারদের একটা সন্মেলন চলছিল । প্রাচীন গির্জাগুলোর নীচে অনেকগুলো কালো রঙের মোটরগাড়ি বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল । আমরা ডানদিকে মোড় নিয়েক্যাভালরি হাউজ আর পোতিশনি প্রাসাদের মধ্যে দিয়ে দ্ভোর্তযোভায়া স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগলাম । একটা খিলানের নীচের ফটক দিয়ে খুব সম্ভবত প্লেজার প্যালেসে পা রাখলাম । এখানে বিপ্লবের ধ্বংস থেকে জমকালো বেঁচে যাওয়া গোবেলিন ট্যাপেস্ট্রি ঘেরা একটা কামরায় সুইস আন্তর্জাতিক আন্দোলনের নেতা কার্ল মুরকে দেখতে পেলাম ।

স্কটিশ নেতা কেইর হার্ডি আর হাইন্ডম্যানের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন ওঁরা সত্যিকারের সমাজতন্ত্রী ছিলেন । আমি এ দু'জন সম্বন্ধে কিছূ জানি না দেখে ভারী হতাশ হলেন তিনি । মাদাম রাদেক অবশ্যই রাদেক (কার্ল রাদেক) সম্বন্ধে জানতে চাইলেন । আমি বললাম স্টকহোমের কাগজে আমি পড়েছি ব্রুন্সইউকের প্রাসাদে আছেন । অনেক পরে আমরা জেনেছিলাম তিনি বার্লিনে আটক হয়ে জেলে গেছেন ।

গত ছয়মাসে কী কী পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি সেটাও তিনি জানতে চাইলেন । পুরনো চেনাজানাদের খবর জানতে চাইলেন আমি । পিয়াতাকভ মিত্রপক্ষের কাছ থেকে উক্রাইনে জার্মানদের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য মেশিনগান চাইছিলেন । শুনলাম এখন রাকোভস্কি পিয়াতাকভের জায়গা নিয়েছেন । খার্কভ স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে, কিন্তু কিয়েভ এখনো মস্কোর নিয়ন্ত্রণে ।

সে রাতে হোটেলে ফিরে আমার এত ঠান্ডা লাগল যে আমি ভেড়ার চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে উপরে সমস্ত কাপড়চোপড় আর তোষক চাপিয়ে শুলাম, তবু শীত গেল না । খুব খারাপ ঘুম হল আমার । আরেকটা ভাল জায়গা পাওয়ার জন্য তদবির আরম্ভ করে দিলাম । পথ চলতে চলতে দেখলাম মস্কোর রাস্তাগুলো নানান বিপ্লবী ভাস্কর্যে ভরে গেছে । কোনোটা খুব বদখত দেখতে, কোনোটা বেশ ইন্টারেস্টিং, দেয়ালের বিজ্ঞাপনগুলো স্থানীয় শিল্পীরা ছবি এঁকে ঢেকে দিয়েছে ।

এই আবহাওয়াতে অবশ্য এর বেশীরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় কী দারুন গ্যালারি ছিল সে সব । একটা দালানের সামনের পুরোটা জুড়ে ছিল বিজ্ঞাপন, সেখানে এখন বিপ্লবের নানান মোটিফ নিয়ে বিশাল সব ছবি এঁকে ভরে দিয়েছে । ৎভেরস্কায়ার পুরো একটা ব্লক জুড়ে শোভা পাচ্ছে ফিউচারিস্ট শিল্পীদের পেইন্টিং । সব মিলিয়ে আগের মস্কোর একঘেয়ে হলুদ রঙের জায়গায় নানান ঝকমকে রঙের বাহার । কিন্তু ছবিগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভেড়ার চামড়ার কোট আর মাথায় রুমাল বাঁধা মহিলাদের দেখে মনে হচ্ছে মধ্যযুগের সাথে আধুনিক মস্কোর মেলবন্ধন ঘটেছে ।

বেশ কিছু প্রাচীনপন্থী লোক এসব অতি আধুনিক শিল্পীদের কার্যকলাপে বিরক্ত । সাধারন মানুষ বুঝতে পারএ এমন জিনিস আঁকা উচিৎ দাবী করে ওরা । সে সন্ধ্যায় ন্যাশনাল হোটেলে, বুড়ো রাইনস্টাইনের সাথে আলাপ হল আমার । রাইনস্টাইন, আমেরিকান সোশ্যালিস্ট লেবার পাটির্র সদস্য, বিপ্লবের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন । কম করে হলেও রাইনস্টাইনের বয়স সত্তর, কিন্তু এখনো মস্কো সোভিয়েত বা নির্বাহী কমিটির কোন মিটিং মিস করেন না তিনি ।

সকাল সাতটায় মস্কোর এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ান, নতুন সোভিয়েত বাহিনীর অফিসারদের উদ্দেশ্যে লেকচার দেন । ইংরেজ যুদ্ধবন্দীদের ভাগ্য তাঁরই হাতে বলা চলে । ওদের বলশেভিক হবার কোন আশা তিনি দেখেন না । আমার সাথে করে কোন আমেরিকান পত্রিকা আনিনি দেখে তিনি দুঃখ করলেন । মস্কোতে যোগাযোগ বিভ্রাট নিয়ে তিনি অভিযোগ করলেন, বোধহয় সেদিন তিনি তৃতীয় ব্যাক্তি যে ওই প্রসঙ্গ তুলল ।

রাজনৈতিকভাবে সরকার তার অবস্থান শক্ত করতে পেরেছে বলেই তিনি মনে করেন, যদিও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ । ট্রেনের অভাবে খাদ্যশস্য শহরে এসে পৌঁছাতে পারছে না । এসব ব্যাপার রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে । ইংরেজ বন্দীদের প্রসঙ্গ তুললেন তিনি এরপরে । মস্কোতে যেসব বন্দী আছে, তাদের বিশেষ পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে, তারা শহরের যে কোনো জায়গায় আসতে বা যেতে পারে ।

আমি অফিসারদের কথা জিগ্যেস করতে তিনি বললেন ওরা কারাগারে বন্দী আছে, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধিরা ওদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে পারে । একবার রাইনস্টাইন আরখাংজগেল ফ্রন্টে একজন আমেরিকান আর একজন ব্রিটিশ বন্দী অফিসারকে নিয়ে গেছিলেন ওখানকার কোনো ফ্রন্টে একটা বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য । একটা সেতুর মাঝখানে তাদের কথা হলো, রাইনস্টাইনের সাথে দু'জন রাশিয়ানও ছিল । ওদিকের আমেরিকানটা রাইনস্টাইনকে বলল তাদের এলাকায় যেতে । ও একটা হলফনামাও লিখে দিলো যে রাইনস্টআইনের কোন ক্ষতি হবে না (একজন রুশ সৈন্যের তার পিঠটা টেবিল হিসেবে ব্যাবহার করতে দিল) ।

সন্ধ্যায় যখন যাবার সময় হলো তখন আমেরিকানটা দুই বন্দী (আমেরিকান আর ব্রিটিশ) কে থেকে যেতে বলেছিল । কিন্তু ওরা রাইনস্টাইনের সাথে সেতু পার হয়ে রুশ এলাকায় চলে এল । হলফনামাটা আমাকে দেখালেন রাইনস্টাইন । শুনলাম পরদিন নাকি ন্যাশনাল হোটেলের এক গেস্ট চলে যাবে, মানে আমার একটা কামরা পাওয়ার আশা আছে । রাইনস্টাইনের কাছ থেকে ফিরে, কাপড়চোপড়ের পাহাড় বানিয়ে তার ভিতরে সেঁধিয়ে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলাম আমি ।

পরদিন ন্যাশনাল হোটেলে গিয়ে খোঁজ নিতেই কামরা পেয়ে গেলাম আমি । রুমটা চমৎকার, কিচেনের ঠিক পাশে বলে বেশ আরামদায়কভাবে গরম । তবে একশো গজ দূরের পুরনো হোটেল থেকে আমার জিনিসপত্র আনতে চলি্লশ রুবল গুনতে হলো । কিছ বই কিনলাম, যে সব মানুষে রসাথে দেখা হওয়া দরকার তাদের একটা তালিকা বানালাম । ঘরটা চমৎকারভাবে পরিচ্ছন্ন ।

সকালবেলা যে পরিচারিকা এখানে ঘর পরিস্কা করে সে যে কাজে ফাঁকি দেয় না, বোঝাই যায় । মেঝেতে দেশলাইয়ের কাঠি ফেলতে আমাকে বকা দিল সে । নতুন সরকার কেমন কাজ করছে জানতে চাইলাম আমি, মেয়েটা বলল খাবারের অভাব খুব বেশি, তবে পরিস্থিতি আগের থেকে ভাল । বিকালবেলায় নীচতলায় হোটেলের মুল কিচেনে নামলাম আমি, সেখানে গরম পানির ঢালাও বন্দোবস্ত আছে । একটা কিচেন শুধুমাত্র হোটেলের লোকজনের ব্যাবহারের জন্য ।

একদল লোক স্টোভ ঘিরে দাঁড়িয়ে । ওদের মধ্যে একজন ধুসরচুল কসাককে দেখলাম আমি । কসাক কেতায় বুলেটখচিত লম্বা ঝুলের সরু কোমরের কাল কোটের নীচে লাল টিউনিক পরে আছে সে । সু্যুপের বাটি গরম করছে সে, পাশে এক চশমা পরা সোভিয়েত সদস্যও খাবার গরম করছেন । দুটো ছোট মেয়ে পুরনো কৌটার মত্যে আলু সিদ্ধ করছে ।

চুলে নীল রুমাল বাঁধা একজন মহিলা কাপড় ইস্ত্রি করছেন । কেউ সম্ভবত বড় কড়াইটাতে কাপড় সিদ্ধ করছে । সারা হোটেল থেকেই মানুষ, কেটলি, জগ এমন কী কৌটা নিয়ে আসছে গরম পানি নেবার জন্য । কিচেনে এক পাশে খাটো একটা কাউন্টার মত রাখা, সেখান থেক সবাই টিকেট দেখিয়ে খাবার নিচ্ছে পাত্রে । রেঁস্তোরায় না গিয়ে সবাই নিজের কামরায় গিয়ে খাবে ।

হতে পারে ওদের ধারনা এভাবে ওরা বেশি খাবার পাবে । আমার সেরকম কিছু মনে হলো না । তাছাড়া আমার কাছে কোন সসপ্যান ছিল না । আমাকে তাতে সপ্তাহের দিনগুলো ছাপানো একটা কার্ড দেয়া হয়েছিল । দিনে একটা করে ডিনার পাবো আমি ।

খাবার দেয়ার সাথে সেদিনের নাম লেখা কাডের্র অংশটুকু ছিঁড়ে নেয়া হলো । ছিল একবাটি স্যুপের সাথে মাংস বা মাছের একটা পদ । খাবারের দাম পাঁচ থেকে সাত রুবলের মধ্যে । খাবার পাওয়া যেত দুপুর দুটো থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে । সকাল বেলাটা ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাটিয়ে দুপুরে আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতাম যে যেকোনো আমি খেতে পারি ।

এই আশ্বাসের বশবর্তী হবে আমি খাবারে সময় পিছিয়ে দিতাম এবং প্রায় সন্ধ্যা ছয়টায় সময় ডিনার সারতাম । বাইরের লঙ্গরখানাগুলিতে খোঁজ নিয়ে দেখলাম ঠিক একই খাবার একই পরিমানে দেয়া হয় সেখানে । একধরনের সহজ সমবায় ব্যাবস্থা গড়ে উঠেছিল সেখানে । একদিন সিঁড়ির উপর নোটিশ দেখা গেল, সবাইকে হোটেল কমিটি থেকে এক বয়াম জ্যাম দেয়া হবে । আমিও জ্যাম পেলাম, আরেকদিন মিলল খানিকটা উক্রাইনিয়ান সসেজ ।

কার্ড ছাড়াও রাস্তায় গলা কাটা দামে খাবার পাওয়া যায় । খাবারের দামের পার্থক্যটা বোঝার জন্য নীচের তুলনাটাই যথেষ্ট হবে । কার্ড অনুযায়ী এক পাউন্ড রুটি এক রুবল বিশ কোপেক, বাইরে 15-20 রুবল । চিনি কার্ডে বারো রুবল, বাইরে পঞ্চাশ রুবল । এর মানে হচ্ছে কার্ড পদ্ধতি তুলে দিলে ধনীরা জিনিস পাবে, তবে গরিবের ভাগ্যে কিছুই জুটবে না ।

তবে একজন আমাকে বলেছিল কার্ড অনুযায়ী যদি যথেষ্ট জিনিসের সরবরাহ থাকে তাহলেই ফটকাবাজি কমে যাবে । কেউ যদি 1.2 রুবল দিয়ে রুটি কিনতে পারে তাহলে সে কেনব আরো চোদ্দ রুবল বেশী খরচ করে বাইরে থেকে রুটি কিনবে ? যুদ্ধ শেষ হলে আশা করা যায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে । মস্কোতে যে দুর্ভিক্ষ চলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । এখানে আশার তৃতীয় দিনে আমি একজন লোককে স্লেজভর্তি করে ঘোড়ার মাংস নিয়ে যেতে দেখেছি । মাংসের চেয়ে হাড়ের পরিমানই বেশি, খুব সম্ভবত মরে যাওয়া স্লেজটানা ঘোড়া থেকে নেয়া হয়েছে ।

ও যখন স্লেজট আচালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল একদঙ্গলো কালো কাক স্লেজটাকে অনুসরণ করছিল । কাকেদের এমনই দুরবস্থা এখন যে কিছু কাক আমার ঘরের সরু ভেন্টিলেটর ঠেলে ঢুকে পড়ত কিছু খাবার আশায় । যুদ্ধের আগে অসংখ্য কবুতর চড়ে বেড়াতো, ধর্মীয় কারনে মানুষ মারত না ওদের; এখন সম্পুর্ন অদৃশ্য । ঠান্ডার ব্যাপারেও কিছু বলবার নেই । যখন দেখলাম পররাষ্ট্র দফতরের লোকেরাও আমার মতই কষ্টে আছে তখন ক্ষোভটা একটু কমল ।

এমন কী ক্রেমলিনের আরকাইভ রক্ষককেও দেখতাম ভেড়ার চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে মাঝে মাঝে প্রায় জমে হাত চাপড়ে গরম করতে । যেমনটা আগেকার দিনে লন্ডনের ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের করতে দেখতাম ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।