timursblog@yahoo.com
3.
মস্কো যাবার প্রস্তুতি নিয়ে বিরাট হট্টগোল বেঁধে গেল । কিছু দেখা গেল একেবারে শেষ মুহুর্তেও তৈরী হতে পারেনি । আটজন মানুষের জন্য একটা মোটরগাড়ি বরাদ্দ ছিল, ভারী মালপত্রের জন্য একটা ট্রাক । আমি আমার লটবহর নিয়ে ট্রাকে উঠে স্টেশন পর্যন্ত ঝাঁকুনি খেতে খেতে গেলাম । আমার মনে পড়ে গেল বিপ্লবের প্রথম দিককার কথা, যখন এইসব ট্রাকগুলোতে মেশিনগান, সৈনিক, বিপ্লবী, রাজনৈতিক বক্তা বা পথচলতি যেকোনো উৎসাহী ,লোককে তুলে নেয়া হতো ।
নিকোলাই স্টেশনে পৌঁছে মনে হল সবকিছু ঠিকমতই আছে, যতক্ষণ না আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় পা রাখলাম । আমাদের রিজার্ভ কামরায় বিনা অনুমতিতে কতগুলো লোক উঠে বসে আছে । যা হোক, সে সব সমসস্যাও মেটানো গেল, যেটা একবছর, বা এমন কী ছয়মাস আগেও অসম্ভব ছিল ।
ট্রেনের ওয়াগনটার মাঝখানে একটা দরজা কামরাটাকে ভাগ করেছে । খোলা কুপ আর পাশের সিটগুলোকে বিছানা হিসেবে ব্যাবহার করা যায় ।
আমি দ্বিতীয় সারিতে জায়গা পেলাম, আমার মাথার উপরের বাংকটায় শুধু লাগেজ রাখা । আমার পা ঝুলছে নীচের বাচ্চা নিয়ে মা, বলশেভিক আর অন্যান্য হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে । প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামছে, এবং পুরো ট্রেন জুড়ে মানুষ উঠছে আর নামছে । কেটলি, কফিপট বা স্রেফ মাংসের খালি টিন আছে এমন সবাই গরম পানির খোঁজে নেমে যাচ্ছে । দুটো থার্মোস ফ্লাস্ক হাতে আমি ওদের সাথে যোগ দিলাম ।
গরম পানির কলে কেউ খবরদারী করছে না, কিন্তু মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে গরম পানি নিচ্ছে । ট্রে ছাড়া হলে সবাই ট্রেনে উঠে চা খেতে লাগল । সারারাত অসংখ্য স্টেশনে এর পুনরাবৃত্তি হল । মানুষ ঝিমাতে ঝিমাতে জেগে উঠে আলাপ করতে লাগল । উপরে বসে আমি ওদের কথা শুনছিলাম ।
কেউ কেউ খাবারের দাম নিয়ে গজগজ করছে, কেউ বা বুঝে উঠতে পারছে না কেন অন্যান্য দেশ তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায় । যদিও কামরা ভর্তি কমিউনিস্ট, আরখাংগেলের একজন সমবায়ী বেশ খোলাখুলিই সেখানকার অসন্তোষের কথা বলল ।
আরখাংগেলের কিছু রাশিয়ান সৈন্য ফ্রন্টে গিয়ে অন্য রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিল বলে ওদের কমান্ডাররা সব ইস্তফা দেয় । ওদের জায়গায় নতুন কমান্ডাররা সাহায্যের জন্য আবেদন করে । আমেরিকান সৈন্যরা ওদের ব্যারাক ঘিরে ফেলে বলে হয় ওরা ওদের মাথাদের ধরিয়ে দেবে নইলে ওখানে যত সৈন্য আছে তাদের প্রতি দশজনের একজনকে গুলি করে মারা হবে ।
তারপর বিদ্রোহীরা ওদের নেতাদের ধরিয়ে দেয় । তারপর ওদেরকে নিজেদের কবর খুঁড়তে বলে ওদেরকে গুলি করে মারা হয় ।
হতে পারে পুরো ঘটনাটাই আরখাংগেল এলাকার গুজব । প্ল্যাটফমের্র আরেক জায়গায় দুজন লোক পরস্পরকে স্বার্থপর বলে গালাগাল করছে । আমি ভেবেছিলাম মারামারি না লেগেই যায় না, কারন দুজনের গালির মজুদই অফুরন্ত, কিন্তু কিছুই হল না ।
প্ল্যাটফর্মে একদল শ্রোতা জুটে গেল যারা হাততালি দিতে লাগল দু'জনের গালাগাল শুনে ।
শেষ পর্যন্ত আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম । কিন্তু কামরার হট্টগোল, ধোঁয়া, বাচ্চাদের কান্না, ময়লা কাপড়, আর রুশ চাষীদের গা থেকে আসা একটা বিশেষ গন্ধে আমার ঘুম অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল । তাহলেও আমি বেশ আরামেই ছিলাম, লোকজনের গল্পগুজবে অংশ নিচ্ছিলাম, ইংল্যান্ডে মাছধরার কথা ভাবছিলাম আর শক্ত কাঠের উপর এপাশ ওপাশ করছিলাম সামান্য আরামের জন্য ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।