আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাশিয়া 1919 (পর্ব 2, স্মোলনি ইন্সটিটিউট)

timursblog@yahoo.com

ছবি 1: স্মোলনি ইন্সটিটিউট ছবি 2: স্মোলনি ইন্সটিটিউটে কর্মরত লেনিন 2. স্মোলনি ইনস্টিটিউট পরদিন চায়ের সাথে একটা রুটির কার্ড পেলাম, যাতে সামান্য পরিমান বাদামী রুটি আমার ভাগে জুটবে, রুটির মান গত গ্রীস্মে মস্কোতে দেয়া রুটির থেকে ভাল । এরপরে লিতভিনভকে খুঁজে বের করে স্মোলনি ইন্সটিটিউটের দিকে রওনা হলাম । স্মোলনি ইন্সটিটইউট একসময়ে অভিজাত শ্রেণীর মেয়েদের স্কুল ছিল, এখানেই বলশেভিক সোভিয়েতের সদরঘাঁটি । পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশাসনই চলত এখান থেকে । ক্রন্সদাত দ্বীপে সরকার সরিয়ে নেবার পর স্মোলনি ইন্সটটিউট, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত, উত্তরাঞ্চলের সদর দফতর ।

দিনের বেলায় পেত্রোগ্রাদকে খানিকটা জনবহুল মনে হচ্ছে । তবে মনে হল যেন কেরেনস্কির 'শহর খালি করে দেয়ার' পরিকল্পনাটা কিছুটা হলেও ফলেছে । এর কারন হচ্ছে দুর্ভিক্ষ, শহরে জ্বালানী ও কাঁচামাল নিয়ে আসার অসুবিধার কারনে শহরের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া । এখানে মনে রাখা দরকার বেশিরভাগ রুশ শ্রমিকই গ্রামের সাথে তাদের সম্পর্ক হারায়নি, শহরের সাথে গ্রামের যাওয়া আসাটা বেশ নিবিড় । বেশির ভাগই শ্রমিক দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবের ধারনা বয়ে নিয়ে গেছে ।

এটাও মনে রাখা দরকার লাল ফৌজের প্রথম দিককার ইউনিটগুলো সব শহরের শ্রমিকশ্রেণী থেকে এসেছিল যারা গ্রামের লোকের থেকে অনেক বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিল । ছ'মাস পরে পেত্রোগ্রাদে আমি আরো একটা জিনিস দেখলাম, রাস্তায় সশস্ত্র মানুষজন নেই বললেই চলে । প্রায় যেন যুদ্ধের আগের শান্তিপুর্ণ পরিবেশ, কোন বিপ্লবী গ্রুপ রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে না, সৈন্যরা যারা বাইরে ঘুরছে তাদেরকারো হাতে রাইফেল নেই । কাঁধে মেশিনগানের গুলির বেল্ট ঝোলানো বিপ্লবের সেই সব জঙ্গী পান্ডারা এখন অদৃশ্য । আরেকটা নতুন দৃশ্য চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে সবসময়ে হালফ্যশনের ধোপদুরস্তে মানুষজনে ভর্তি নেভস্কি প্রোসপেক্তে নতুন পোশাক পরা কোন মানুষের অনুপস্থিতি ।

সবার পরনে অন্তত দু'বছরের পুরনো জামাকাপড় অবশ্য কিছু অফিসার আর সৈনিকের পরনে নতুন উর্দি । পেত্রোগ্রাদের মহিলারা সবসময়ই কেতাদুরস্ত বুটের ভক্ত, আর এখন নতুন বুটের বড়ই অভাব । একজন মাত্র তরুণীকে দেখলাম যার পরনে প্রায় নতুন দামী ফার কোট । কিন্তু তার পায়ে লিনেনের ফালি প্যাঁচানো খড়ের জুতো । আমরা অনেক দেরীতে রওনা দিয়েছি তাই, নেভস্কিতে পৌঁছানোর জন্য ট্রাম নিলাম ।

ট্রামের কন্ডাক্টররা সবাই মহিলা, টিকেটের দাম খেয়াল করলাম এখন এক রুবল । আগে টিকেটের দাম ছিল ছিল দশ কোপেক । স্মোলনি ইন্সটিটিউটের সামনে দাঁড়ানো সাঁজোয়া গাড়িটা অদৃশ্য হয়েছে । সেখানে কার্ল মাক্সের্র একটা বদখত মুর্তি শোভা পাচ্ছে, মার্ক্স সাহেব আঠারো ইঞ্চি কামানের নলের একটা মস্ত টপ হ্যাট ধরে আছেন শরীরের পিছনে । অস্ত্র বলতে দুটো হালকা ফিল্ড গান, এই আবহাওয়ায় খুবই করুন দেখা যাচ্ছে ।

পোর্টিকো পিলারগুলোর মাঝে রাখা, ওগুলো ব্যাবহার করলে আমার বিশ্বাস পিলার সহ গাড়ি বারান্দাটা ধ্বসে পড়বে । ভিতরে সব আগের মতই আছে, কেবল সব ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে । করিডর ধরে ঘুরে বেরানো আর স্টল থেকে পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করতে থাকা মফস্বলের ডেলিগেটদের আর দেখা যাচ্ছে না । এখানেই ত্রতস্কির দরজার বাইরে ভিবর্গ থেকে আসা খুদে শ্রমিকটা পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকত । সামনের কোনাটার জানালায় দাঁড়ালে নীচের বিশাল হল ঘরটা দেখা যেত যেখানে দিনমান পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত বিতর্কে ব্যাস্ত থাকত ।

পেত্রোগ্রাদ কমিশারদের সাথে ডিনার করার লিতভিনভের দাওয়াতটা খুশি মনেই গ্রহন করলাম, কারন প্রথমত আমার খিদে পেয়েছিল, দ্বিতীয়তঃ যিনোভিয়েভের (গ্রিগোরি যিনোভিয়েভ) সাথে দেখা করার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায় বলে মনে হল, বিপ্লবের সময় যখন আমাদের দেখা হয় ভারী রুক্ষ ব্যাবহার করেছিলেন তিনি । লম্বা চুল, নিখুঁতভাবে কামানো মুখ, ইহুদী যিনোভিয়েভের ব্যাবহার খুব চাঁছাছোলা । শুরুতে নভেম্বর বিপ্লবের (পুরনো রুশ পঞ্জিকা মতে অক্টোবর বিপ্লব, গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে নভেম্বর বিপ্লব) বিরোধী ছিলেন তিনি । কিন্তু বিপ্লব যখন ঘটেই গেল তখন তিনি লেনিনের দিকে আনুগত্য ঘোষনা করে উত্তরাঞ্চলীয় কমিউনের প্রধান হয়ে বসলেন । তিনি মোটেই মৌলিক চিন্তাশীল ব্যাক্তি বা ভাল বক্তা নন কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে বা তর্ক করতে পারেন চমৎকারভাবে ।

গত বছর তাঁর দুই বন্ধু ভোলোদারস্কি আর উরিৎস্কির হত্যাকান্ডের পর যথেষ্ট ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি আর এ বছর লেনিনের উপর হামলার পর বলা যায় মাথাই খারাপ হয়ে গেছে তাঁর । ঘটনার পর পেত্রোগ্রাদে যেসব প্রতিহিংসা মুলক ঘটনা ঘটে ছিল সেসবের দায় তাঁর উপর চাপানো হয় । তাঁকে কোনভাবেই জার্মানঘেঁষা বলা যাবে না, যদিও অবশ্যই তিনি মার্ক্স-অনুরক্ত । তবে দেখলাম তিনি বেশ ইংরেজ বিদ্বেষী । আমাকে 'বুর্জোয়া সাংবাদিক' বলে আমার অসুবিধা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি আমার আগের সফরে ।

রাদেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতাকেও তিনি খুব ভাল চোখে দেখেন না । টেবিলে আমাকে বসতে দেখে যিনোভিয়েভের মুখের ভঙ্গি দেখে হাসি পেল আমার । লিতভিনভ পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার উপর লকহাটের্র আক্রমনের কথাও সুক্ষভাবে বলতে ভুললেন না । এরপরেই যিনোভিয়েভ অনেক বন্ধুত্বপুর্ণ হয়ে উঠলেন । এও বললেন মস্কো থেকে ফিরে যদি আমি পেত্রোগ্রাদে কয়েকদিন কাটাই, তবে আমি যেসব ঐতিহাসিক দলিল দেখতে চাইছি তা তিনি দেখানোর ব্যাবস্থা করবেন ।

আমি বললাম তাঁকে ক্রন্সতাত দ্বীপে না দেখে এখানে দেখে খুব অবাক হয়েছি, বিদ্রোহ এবং সেমিওনোভস্কি রেজিমেন্টের কথাও বললাম আমি । শুনে হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই । পোৎসার্ন ব্যাখ্যা করলেন যে সেমিওনিভস্কি রেজিমেন্ট বলে আসলে কিছু নেই, পুরোটাই ধাপ্পা । মিথ্যাটাকে সত্যের মোড়ক দেয়ার জন্য সেমিওনোভস্কি রেজিমেন্টের নাম দেয়া হয়েছে । এরকম একটা রেজিমেন্ট সত্যিই চোদ্দ বছর আগে 1905 সালে মস্কোর বিদ্রোহ দমন করেছিল ।

টেবিলের ওপাশে বসে থাকা পোৎসার্ন, চশমা চোখে রোগাপাতলা, দাড়িওয়ালা একজন মানুষ, উত্তরাঞ্চলীয় কমিউনের সামরিক কমিসার । স্মোলনিতে ডিনার আগের মতই ইনফর্মাল ব্যাপার, যদিও খাবার আগের থেকে আনেক কম । মহিলা আর পুরষ কমিসাররা কাজের জায়গা থেকে এসে খেয়ে আবার কাজে চলে যাচ্ছে । খুব শাদামাটা খাবার, স্যুপ-তাতে ঘোড়ার মাংসের ফালি ভাসছে; কাশা (পরিজ) আর একটা স্বাদহীন শাদা জিনিস শেষে একদলা চিনি সহ চা । আমার খাওয়া যখন শেষ, তখন মাদাম ভোরোভস্কি ছোট্ট নিনা, সুইডিশ আর দুই নরওয়েজিয়ান সাংবাদিককে নিয়ে ঢুকলেন ।

জানলাম, দলের অর্ধেক লোক আজ রাতের ট্রেনে মস্কো যাবে । ওদের যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম তাড়াহুড়ো করে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।