হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই
বিভিন্ন বইপত্র ঘাটাঘাটি করে দেখা যায় প্রথম বাংলা মুভেবল বা বিচল হরফ তৈরীর কৃতিত্ব দেয়া হয় চার্লস উইলসকিনসকে। কিন্ত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় উইলসকিনসের ও আগে বাংলা ব্যাঞ্জনবর্নের বিচল হরফ তৈরী করেছিলেন উইলিয়াম বোলটস। বিচিত্রমুখী প্রতিভার অধিকারী উইলিয়াম বোলটসের জন্ম ১৭৪০ সালে হল্যান্ডে।
হল্যান্ডে জন্ম হলেও তিনি জাতিতে ছিলেন জার্মান। ইংরেজ লেখকরা ভূলবশত তাকে ডাচ হিসাবে অভিহিত করেছেন। ১৭৫৫ সালে তথাকথিত অন্ধকূপ হত্যাকান্ডের পর ভাগ্যন্বেষনে কলকতা এলেন বোলটস।
সেই সময় কোলকাতায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘোর দুর্দিন। নবাবের ভয়ে ইংরেজরা এদেশে আসা এক রকম বন্ধ করে দিয়েছে।
কোম্পানীতে উপযুক্ত কর্মীর অভাব। সাথে সাথে চাকুরী পেয়ে গেলেন বোলটস। ১৭৬২ সালে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে গেলেন একটি বানিজ্য কুটির অধিকর্তা। তিন বছর পর আবার পদোন্নতি এবার বেনারস কাউন্সিলের উপপ্রধান। কিন্ত পরের বছর চাকুরী হারালেন, অভিযোগ গুরুতর কোম্পানির স্বার্থ না দেখে নিজের স্বার্থে ব্যাবসা শুরু করেন।
এরপর কোম্পানী তাকে নতুন পদে চাকুরী দিল। বেনারস কোর্টের অলডারম্যান বা বিচারপতি। কিন্তু আবার ও তার বিরুদ্বে অভিযোগ, দেশীয় রাজ রাজরাদের কোম্পানীর বিরুদ্বে খেপিয়ে তুলছেন। কোম্পানী তাকে গ্রেফতার করতে চাইলে তিনি পালিয়ে জান ডাচ অধিকৃত চুচুঁড়ায়। সেখান থেকেই কলকাঠি নাড়তে থাকেন কোম্পানীর বিরুদ্বে।
অবশেষে ১৭৬৮ সালে কোম্পানী তাকে গ্রেফতার করে লন্ডনে পাঠাতে সক্ষম হয়।
এবার বোলটস লন্ডনে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদুতের সাথে দেখা করে প্রস্তাব দিলেন প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যাবসা করার। বোলটস তার অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগানোর আগ্রহ দেখালেন। রাষ্ট্রদুতের উদ্যেগে অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী মারিয়া টেরেস তার সাথে দেখা করার স্মমতি দিলেন। তাকে অস্ট্রিয়ার নাগরিকত্ব দেয়া হল আর দেয়া হল লেঃ কর্নেল পদমর্যদা।
কুঠি স্থাপন করলেন মালাবার ও করমন্ডল উপকূলে। কিন্তু বানিজ্যে লাভ করতে পারলেন না। ১৭৮১ সাল নাগাদ কুঠিগুলো ফতুর হয়ে যায়।
এরপর বোল্টস গেলেন ফ্রান্সে, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে না পেরে চলে এলেন সুইডেনে এখানে তিনি একটি পরিকল্পনা পেশ করলেন। পরিকল্পনার দুটি অংশ।
প্রথমত এশিয়ার সঙ্গে বানিজ্য আর দ্বিতীয়ত একটি নতুন দ্বীপ যেখানে কোন বসতি নেই সেই দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করা। এই দ্বীপের অস্তিত্ব তার জানা ছিল কিন্তু অবস্থান প্রকাশ করেননি। রাজা তৃতীয় গুস্তাফ অনুমোদন করলেন তার প্রস্তাব, সবকিছু ঠিকঠাক হলেও উইলিয়াম বোলটসের অভিযান পরিচালিত হতে পারেনি। কারন ঐ সময় রাশিয়ার সাথে সুইডেনের যুদ্ব বেজে যায়। ফালে চিরতরে স্থগিত হয়ে যায় বোলটসের অভিযান।
ইতিমধ্যে লন্ডনে বসে তিনি বাংলায় মুদ্রন যন্ত্র স্থাপনের কথা ভাবলেন। কলকাতায় চাকুরী করার সময়ই তিনি উপলদ্বি করছিলেন ছাপাখানার অভাবের কথা। অথচ ইউরোপে তিনশ বছর আগেই ছাপাখানার আবিস্কার হয়ে যুগান্তরের সূচনা হয়েছে। বোলটস অনুভব করলেন ছাপাখানা স্থাপনের জন্য বাংলাই সবচেয়ে ভাল জায়গা, পশ্চিম ভারতে ছাপাখান এসেছে অনেক আগে। কিন্তু সেখানকার ছাপার কাজ প্রধানত ধর্মভিত্তিক।
লন্ডনে বসে বাংলা হরফ তৈরীর কাজ শুরু করলেন। এই কাজে কেউ তাকে আর্থিক সহযোগিতা বা উৎসাহ দেয়নি। সম্পূর্ন একক উদ্যেগেই তিনি একাজ শুরু করেন। কেউ কেউ বলেন বোলটস নিজেকে প্রাচ্যবিদ হিসাবে জাহির করার জন্য এই উদ্যেগ নিয়েছিল। তিনি সম্পূর্ন বাংলা ব্যঞ্জনবর্ন হরফ তৈরী করেছিলেন।
বোলটস যে ব্যঞ্জনবর্নের পর আর অগ্রসর হতে পারেননি তার মানে এই নয়যে তার অক্ষমতা, আসলে কারন ছিল পৃষ্ঠপোষতার অভাব এবং অর্থ।
তখন একটি পাঞ্চ তৈরীর খরচ ছিল এক পাউন্ড। বাংলা একপ্রস্থ ছাপার অক্ষর তৈরী করতে প্রায় ছয়শো পাঞ্চের দরকার ছিল। তার ওপর ঢালাইয়ের ধাতুর দাম, কুশলী কর্মীর মজুরী ইত্যাদি যোগ করতে হবে। বোলটসের এত টাকা ছিল না।
এই কাজে আর্থিক সহায়তা লাভের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে আবেদন জানালেন ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৭৭৩ সালে এক চিঠির মাধ্যমে। সঙ্গে পাঠালেন তার তৈরী একসেট বাংলা বিচল হরফের প্রতিকৃতি। চিঠিতে তিনি জানালেন বাংলা মুদ্রন প্রচলিত হলে কোম্পানীর প্রশাসন উপকৃত হবে, যুক্তি সঙ্গত শর্তে তিনি একসেট টাইপ কোম্পানী দেবেন, যা দিয়ে অতি সহজে বাংলা বইপত্র ছাপানো যাবে।
কোম্পানীর পক্ষ থেকে বোলটসকে কোন সহায়তা দেয়া হল না। নিজের সামর্থ না থাকায় নিজের স্বপ্ন পূরন করতে পারলেন না।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৭৭৮ সালে নিকোবর দ্বীপে বোলটস যখন অস্ট্রিয়ার বানিজ্য কুঠির অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত সেই সময় উইলকিনসনের কাটা বাংলা হরফের সাহায্যে হুগলি প্রেসে ছাপা হল হ্যালহেডর “এ গ্রামার অভ দি বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ”।
সুত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/William_Bolts
কৃতজ্ঞতাঃ জাকির তালুকদারের একটি নিবন্ধ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।