আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভৌতিক গল্পঃ ~ ~ঢাকা মেট্রো -ভ-৬৬-৬৬-৬৬~ ~ (২)

আমি আমাকে নিয়েই তো এখনও বেচে আছি । একদিনআমাকে নিয়েই চলে যাব । সেদিন খুঁজলেও আর পাবি না..........আমার ভার্চুয়াল ফ্যাক্টরিতে স্বাগতম । আমার মন খারাপের সময়টা এখানে আর ফেসবুকে কাটে । মাঝে মাঝে দু একটা লেখা তৈরি করতে ইচ্ছা হলে চলে আসি এখানে ।

https://www.facebo (৩) সেল ফোনের ককর্শ আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো রুদ্রর । ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলো নীলাও জেগে উঠেছে । নীলার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসলো রুদ্র । নীলাও মুচকি হাসলো । একে অপরের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলো তারা ।

"কি খবর বেগাম । কি অবস্থা আপনার ?" মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো রুদ্র । "এই তো সাহেব চলে আর কি" উজ্জ্বল মুখে জবাব দিলো নীলা । "তা ঘুম থেকে উঠবেন না ? জিজ্ঞেস করে রুদ্র । "না ।

"-"কেন ?"-"আরে ঘুম থেকে উঠে গেলে আপনার মতো এতো সুন্দর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে কে ?"বলেই একটু শব্দ করে হাসলো নীলা । নীলার দিকে তাকিয়ে থাকে রুদ্র । মেয়েটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে , ভাল লাগে তার । ফোনের এলার্ম টোন আবার বেজে উঠায় দুজনেই সম্ভিত ফিরে পেলো । দ্রুত তৈরি হয়ে গেলো বের হবার জন্য ।

মাঝখানে রুম থেকে বের হয়ে নিচে সবার অবস্থা দেখে এলো রুদ্র । সবাই মোটামুটি তৈরি হয়ে গিয়েছে । রুমে এসে দেখলো নীলাও তৈরি হয়ে বসে আছে । "তুমি তৈরি ?" জিজ্ঞেস করলো রুদ্র । মুচকি হেসে সম্মতিসূচক মাথা ঝাকালো নীলা ।

নীলাকে নিচে যেতে বলল রুদ্র , তারপর নিজে তৈরি হলো । রুমের লাইট অফ করে দিতেই বাহিরের ম্লান আলো আর রুমের ভিতরের গুমোট আধাঁরে অবাস্তব একটা জগত্‍ তৈরি করলো একটা ছোট পরিসরে । রুমের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে রুদ্র হটাত্‍ দাড়িয়ে গেলো , অস্পষ্ট আলোয় রুমের ভিতরে প্রচুর মাকড়শার জাল দেখতে পেলো যেন । অবাক হলো সে , রুমে ঢুকে লাইট অন করলো আবার । কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না , আবারও খুব অবাক হলো রুদ্র ।

কয়েকদিন প্রচুর ব্যাস্ততার ফল বোধহয় ভাবলো সে । লাইট অফ করে রুমের দরজা লক করলো সে তারপর দরজাটা ধাক্কা দিল । ক্যাচ ক্যাচ করে প্রতিবাদ করতে করতে বন্ধ হয়ে গেলো দরজা , খুট করে শব্দ করে লক হয়ে গেলো । রুদ্র দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে , একটু আগেও যখন বের হয়েছিল তখনও এমন শব্দটা হয়নি । ঠিক এসময় এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো , কেঁপে উঠলো রুদ্র ।

ভয় পেলো সে , অনেকটা প্রায় দৌড়েই নিচে নেমে এলো । নিচে নামতেই সবাইকে চোখে পড়লো । সবাই প্রায় গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে , নীলাকে দেখা গেলো ডাঃ জাওয়াদের স্ত্রী ডাঃ রুশনার সাথে । তিনটা জীপ দাড়িয়ে আছে হোটেলের সামনে , স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয় চান্দের গাড়ি । ডাঃ আসিফ সবাইকে জীপে উঠতে বলল , প্রত্যেকটা জীপে ১২ জন করে ।

একটা জীপে একজন কম হবে , ওটাতে একটা বেতের বাস্কেট তোলা হবে , ওটার ভিতর খাবার আছে । নীলা এগিয়ে এলো রুদ্রের দিকে , রুদ্রর চেহারা অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে আছে । "কিছু হয়েছে তোমার ?" উদ্দিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো নীলা । কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে রুদ্র জবাব দিল "না , মানে । আমার বোধহয় রাতে ঘুমটা ভাল হয়নি ।

" নীলাকে চিন্তিত হতে দেখে রুদ্র আবার হেসে বলল "বেপার না । চলো জীপে উঠি । " নীলার হাত ধরলো রুদ্র , দুজনেই একটা সাদা রং করা জীপের দিকে এগিয়ে গেলো । জীপ তিনটা বেশ পুরোনো , তিনটের শরীরই তোবড়ানো জায়গায় জায়গায় , রং চটে গিয়েছে অনেক জায়গায় । যানবাহনগুলোর অবস্থা দেখে যে কেউ এতে চড়ার আগ্রহ হারাবে ।

তবুও কিছু করার নেই , কারন আশেপাশে নাকি হোটেল ম্যানেজার আর কোন চান্দের গাড়ি পাননি । ঠিক করা হয়েছে এখান থেকে তারা যাবে নীলগিরি , বান্দরবানের মূল আকর্ষন । মাঝখানে সম্ভব হলে শৈল প্রপাত সহ চিম্বুক ঘুড়তে যাবে । যদি নীলগিরি যেতে খুব বেশি দেরি হয়ে যায় এবং যদি দেখা যায় ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে তাহলে নীলগিরি থেকে বগা লেকের দিকে যাবে সবাই । সেখানে একটা আর্মি ক্যাম্প রয়েছে ।

থাকা খাওয়ার একটা ব্যাবস্থা করা যাবে সেখানে । বান্দরবান মূল শহর থেকে নীলগিরি ৪৫ কিঃমিঃ দূরে , এটা মূলত একটা পাহাড় । যেখানে মেঘেরা নিজ থেকেই ছুঁয়ে যায় মানুষকে । নীলগিরির চূড়া থেকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, প্রাকৃতিক আশ্চর্য বগালেক, কক্সবাজারের সমুদ্র, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের আলো-আঁধারি বাতি এবং চোখ জুড়ানো পাহাড়ের সারিও দেখতে পাওয়া যায় । নীলগিরির কাছাকাছি রয়েছে বেশ কয়েকটি ম্রো উপজাতীয় গ্রাম ।

নীলগিরির একদম কাছে কাপ্রু পাড়া, যেখানে সহজেই পরিদর্শন করে ম্রো আদিবাসী সম্পর্কে জানা যায় । নীলগিরিতে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প । ফলে এখানে নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই । যাওয়ার পথে প্রথমে পরবে শৈল প্রপাত এবং তারপর পরই চোখে পড়বে স্বপ্নচূড়া । স্বপ্নচূড়া থেকেও বান্দরবানের অবাক করা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ।

স্বপ্নচূড়ার পরই বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুকে পৌঁছে যাওয়া যায় । চিম্বুকের সুনাম সারা দেশব্যাপী । এখানে রয়েছে টি এন্ড টির বিশাল টাওয়ার, উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করেছে সকল সুবিধা সম্বলিত রেস্ট হাউস । সড়ক ও জনপথ বিভাগের পুরনো একটি রেস্ট হাউসও রয়েছে এখানে । চিম্বুকের পরই নীলগিরি হিল রিসোর্ট ।

এ কথাগুলো ডাঃ রিজভি সবাইকে জানিয়ে দিলো । একটু পর এক এক করে তিনটা জীপই স্টার্ট দিলো , হুল্লোড় করে উঠলো সবাই । রাস্তায় বের হয়ে এলো জীপগুলো , মাঝারি গতিতে চলতে শুরু করলো পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে । হোটেলটার দিকে তাকিয়ে রইলো রুদ্র । কুয়াশার ঘন চাদরে মোড়ানো সকাল বেলার অস্পষ্ট আলোয় অধিভৌতিক আর পরিত্যাক্ত লাগলো হোটেলটাকে ।

হোটেলের প্রধান ফটকের কাছে দাড়িয়ে আছে ম্যানেজার , গতকাল রাতের মতোই রহস্যময় লাগলো তাকে । লোকটা এখনো সারা গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে দাড়িয়ে আছে , কেন যেন রুদ্রর মনে হলো লোকটা হাসছে । জীপ বাক ঘুড়তেই বাকের আড়ালে অদৃশ্য হলো হোটেলটা । সামনে ফিরলো রুদ্র , তাদের জীপটা সবার পরে । এর আগের দুটো জীপ তাদের চেয়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছে ।

রুদ্রদের জীপে মোট এগারোজন , ডাঃ আসিফ , ডাঃ জাওয়াদ ও তার স্ত্রী ডাঃ রুশান , ডাঃ এনামুল আর তার পরিবারের তিন সদস্য , রুদ্র , নীলা , ডাঃ এশা , ডাঃ রিজভি । সব কটা জীপই হুডখোলা , সবাই তারা দাড়িয়ে আছে । প্রচন্ড বাতাসে সবার চুল উড়ছে অবাধ্যের মতো , ঠান্ডা বাতাস প্রায় সূঁচের মতো গিয়ে বিধছে শরীরে । একটু পর পর জীপ বিপদজনকভাবে কাত হয়ে যাচ্ছে । পাহাড়ি রাস্তা একে বেকে চলে গিয়েছে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ।

মাত্র ৪০০-৫০০ গজ পর পরই প্রায় ইংরেজি অক্ষর U অথবা L আকৃতির বাক পরে । আর এমন প্রায় প্রতিটা বাকই ড্রাইভার বিপদজনক গতিতে পাড় হয়ে যাচ্ছে । প্রতিবার বাক পাড় হতে হতে যাত্রীরা আতংক আর রোমান্চ মেশানো আর্তচিত্‍কার করে উঠছে । আশে পাশের পাহাড়ে কোটি কোটি বছর পুরোনো আগ্নেয় শিলার উপস্থিতি দেখা যায় । গাছ পালার ঘন আস্তরনের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা ।

ঘন কুয়াশা আর গাছপালার ছায়া পুরো জায়গাটাকে ভয়ানক ঠান্ডা আর অধিভৌতিক করে রেখেছে । জীপের গতির কোন হের ফের হচ্ছে না , প্রতিটি বাক এখন আরো বিপদজনক । বাক ঘুরেই রাস্তা প্রায় খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে , ভয়ানক বাকটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে প্রায় রাস্তার কিনারে চলে যাচ্ছে জীপ । রাস্তার দুপাশে ঝপ করে প্রায় এক দেড় হাজার ফিট গভীর খাদ নেমে গিয়েছে । বার বার মনে হচ্ছে এই বুঝি জীপ সোজা গিয়ে খাদে পরবে , কিন্তু প্রতিবারই ড্রাইভার আশ্চর্য দক্ষতায় জীপ সামলে ফেলছে ।

হটাত্‍ করেই জীপের গতি কমে গেলো , সামনে বাম পাশে চুলের কাঁটার মতো তীক্ষ বাক , বাক পাড় হয়ে রাস্তা প্রায় ৫০ ডিগ্রি কোনে পাহাড়ের বুক চিড়ে উপরে উঠে গিয়েছে । জীপের গতি ১০-১৫ এ নেমে এলো , ইন্জিনের গর্জন ম্লান হয়ে গেলো হটাত্‍ । বাক সামান্য ঘুরতেই ইন্জিন পুরোপুরো বন্ধ হয়ে গেলো । জীপ মধ্যাকর্ষনের সূত্র মেনে পিছনের দিকে গড়ানো শুরু করলো , পিছনে গভীর খাদ । আতংকে যাত্রীদের চিত্‍কার পর্যন্ত থেমে গেলো , রুদ্র রিভারভিউ মিররে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ড্রাইভারের দিকে ।

মুখে কালো মাংকি মাস্ক পরা লোকটা আপ্রান প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে স্টিয়ারিং আর ব্রেক প্যাডেল চেপে ধরে । কিন্তু গাড়ির অবাধ্য চাকা তার কথা শুনছে না , পিছনের দিকে গড়িয়ে চলছে । ব্রেক খুব সামান্যই কাজ করলো , সামান্য কমলো জীপের গতি । কিন্তু তবুও গতি অনেক বেশি , ভয়াবহ ধাক্কা লাগলো রাস্তার পাশে একটা গাছে । ধাক্কা লেগে সবাই প্রথমে সামনে ডান দিকে সরে গিয়েছিল , পরক্ষনই পিছনের অর্থাত্‍ বাম দিকে হেলে পড়লো সবার শরীর ।

জীপের পিছনে বসে ছিল ডাঃ এশা , জীপের পিছনের দিক দিয়ে প্রায় উড়ে চলে গেলো তার শরীরটা । অন্যান্য যাত্রীরা তার গোলাপি সোয়েটারটার একটা ঝলক দেখতে পেলো শুধু , রওনা হয়ে গেলো সে প্রায় ১০০০ ফুট নিচে গাছপালা আর শক্ত জমিনকে আলিঙ্গন করতে । আর্তচিত্‍কার বের হয়ে এলো এশার মুখ দিয়ে । নিঃস্তব্ধতার মাঝে অনেক বেশি করে শোনা গেলো তার মরণ চিত্‍কার । (৪) হতভম্ব হয়ে বসে আছে সবাই ।

আতংকে সাদা হয়ে গেছে মেয়েদের মুখ । কেউ নড়ছে না । এশার চিত্‍কার বহু আগেই থেমে গিয়েছে , থেমে গিয়েছে তাদের জীপের পতনও । যে গাছটার সাথে জীপটা ঠেস দিয়ে আছে , সেটা বেশ শক্ত , সহজে ভাঙ্গবে না । সবার প্রথমে নড়ে উঠলো রুদ্র ।

সবাইকে পাশ কাটিয়ে নেমে এলো জীপ থেকে । তার দেখাদেখি অন্যান্য সবাইও নেমে এলো । খাদের কিনারে দাড়িয়ে উকি দিলো সবাই , এশার লাসের চিন্হও নেই । গ্রাস করে নিয়েছে তাকে নির্মম প্রকৃতি । "কো...কোত্থায় এশার লাস ?" আতংকিতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ডাঃ রুশান ।

সবাই ফিরে তাকালো তার দিকে , সবার চোখের দৃষ্টিতেই অদ্ভুত বিষাদ আর শূন্যতা লক্ষ্য করলো রুশান । নীলা শক্ত করে রুদ্রকে ধরে আছে , মেয়েটা এই প্রথম চোখের সামনে এধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছে , ভীষন ভয় পাচ্ছে সে । জীপের ইন্জিন শব্দ করে চালু হলো আবার । ড্রাইভার জীপ থেকে বেরই হয়নি , ব্যাপারটাকে এতো সহজভাবে নিলো সে যে এটা এখানে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার । অসহ্য নিরবতার মাঝে জীপের আয়োয়াজটায় কেমন যেন অস্বস্থিতে ভুগতে লাগলো সবাই ।

ডাঃ আসিফ নিজেকে প্রথম সামলে নিলো । সবাইকে জীপে উঠতে বলল , কিন্তু কেউ নড়লো না , আগের মতোই দাড়িয়ে রইলো । আসিফ রুন্দ্রর কাছে গিয়ে তার কাধ দুহাতে ধরে ঝাকালো , রুন্দ্র হতভম্বের মতো তাকালো আসিফের দিকে । "রুদ্র কাম অন , উই হ্যাব টু ক্যাচ আদার্স , দ্যান উই হ্যাব টু রেসকিউ দ্য ডেড বডি অব এশা । " কথাটা বলে তাকে আবারও কাধ ধরে ঝাকালো আসিফ ।

ধাক্কা খেয়ে যেন বাস্তবে ফিরে এলো রুদ্র । সবাইকে প্রায় ঠেলে , ধাক্কা দিয়ে জীপে উঠালো । তারপর সে আর আসিফ চেপে বসলো জীপে , চলতে শুরু করলো জীপ । আগের চেয়েও ভয়ানক গতিতে বাক ঘুড়তে লাগলো , কেউ কিছু বললো না । আসলে বলার কিছু নেই , এই কিছুক্ষন আগেও একজন মানুষ তাদের সাথেই ছিল , এখন হটাত্‍ করেই নেই ।

ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে সবার , জীপের মেঝেতে পাতা গদীর উপর বসে আছে সবাই । রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠে গিয়েছে , সেই সাথে কুয়াশার ঘনত্বও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে । জীপের হেডলাইট জ্বলছে এখন , হেডলাইটের হলদেটে আলোর সামনে ঘন কুয়াশার স্তর পাক খাচ্ছে । জীপের ইন্জিন এখন ভয়াবহ আর্তনাদ করছে , রাস্তা এখন প্রায় ৬৫ ডিগ্রি কোনে উপরে উঠেছে । সবাই এবার শক্ত করে জীপের পাশে লোহা ধরে রইলো , এশার নিয়তি বরন করতে রাজী না কেউ ।

রুদ্রর মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে , কিন্তু কি ভুল তা সে ধরতে পারছে না । তার অবচেতন মন বার বার তাকে বিপদ সংকেত শোনাচ্ছে । হুড খোলা জীপের পাশ দিয়ে নিচের প্রায় অন্ধকার , কয়েক হাজার ফুট নিচের খাদের দিকে তাকালো সে । অনেক দূরে ক্ষুদ্র ফিতার মতো একটা অবয়ব একে বেকে চলে গিয়েছে পাহাড়ের গা বেয়ে । কি যেন একটা মনে পরি পরি করেও পরছে না ।

হটাত্‍ বিদ্যুত্‍ এর চমকের মতো সে ধরে ফেলল ব্যাপারটা । জীপ চলছে প্রায় দেড় ঘন্টার মতো হয়ে গেলো অথচ তারা এখনো শৈল প্রপাতের কাছেই পৌছায়নি । ব্যাপারটা খুব বেশি অস্বাভাবিক লাগলো তার কাছে । পাশ ফিরে নীলার দিকে তাকালো রুদ্র , আতংকে মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে । জীপে পুরুষ মানুষ আছে মোটে পাঁচজন , মেয়েদের সামনে কথাটা না বলার সিদ্ধান্ত নিলো সে , অযথাই ভয় পাবে তাহলে ।

তার চেয়ে সামনের জীপগুলোর নাগাল পেলেই বরং তাদের সাথে পরামর্শ করে কিছু একটা করা যাবে । সামনে তীক্ষ বাক , প্রচন্ড গতিতে বাক ঘুড়লো জীপ । কিন্তু হটাত্‍ করেই কড়া ব্রেক করলো ড্রাইভার , রাস্তার সাথে চাকা ঘষা খাওয়ার বিশ্রি কিইচচচ শব্দ হলো । টায়ার পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো বাতাসে , পিচ ঢালা রাস্তায় স্পষ্ট হয়ে বসে গেলো টায়ারের দাগ । কেন জীপ থেমেছে দেখতে উঠে দাড়ালো সবাই , আরেকবার স্তব্ধ হলো ।

সামনেই তাদের আরেকটা জীপ দাড়ানো , তবে এখন আর ওটাকে জীপ না বলে জীপের ধ্বংসাবসেশ বলাই ভাল । জীপটা প্রায় অর্ধেটাই তুবড়ে গিয়েছে , তুবড়ে গিয়ে পাহাড়ের সাথে আটকে আছে । রাস্তার এখান থেকে বাম দিকে শক্ত আগ্নেয় শিলার পাহাড়ের কঠিন ভিত শুরু হয়েছিল । জীপের বাম পাশটার সামনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই পাহাড়কে ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে । ড্রাইভার কম্পার্টমেন্ট বাদামের খোসার মতো চ্যাপ্টা করে দিয়েছে একটা বড় পাথর ।

এখনো সেটা স্বগর্বে নিজের অস্তিত্ব ঘোষনা করে যাচ্ছে । পাথরটা উচ্চতায় প্রায় দশ থেকে এগারো ফুট উচু আর প্রস্থে প্রায় পাঁচ ফুটের মতো । একবার দেখেই বলে দেওয়া যায় ড্রাইভারের হাড় পাওয়ার সম্ভাবনাও খুব অল্প , বহু আগেই হাড় মাংস দলা পাকিয়ে গিয়েছে । অবশিষ্ট এগারো যাত্রীর মধ্যে প্রথম দিকে যে তিনজন ছিল তারা সবাই পাথর চাপা পরেছে । দুজনের মাথা তরমুজের মতো থেতলে গিয়েছে , ধরটা অসহায় ভঙ্গীতে জীপের উপরের দিকের ফ্রেমে ঝুলছে ।

অপর লাসটার প্রায় অর্ধেকটাই পাথরের নিচে । বাকি আটজনের মধ্যে তিনজন মহিলা আর পাঁচজন পুরুষ ছিল । জীপটার ঠিক মাঝামাঝি কয়েকটা বাঁশ সটান হয়ে প্রায় ইংরেজি U আকৃতিতে আটকে আছে । অস্পষ্ট হলেও বুঝা যায় প্রত্যেকটা বাঁশ একজন একজন করে মানুষকে বর্শাতে বিধানো মাছের মতো আটকে ফেলেছে । বাঁশের অপরপ্রান্ত পাহাড়ের প্রায় কিনার ঘেসে জন্মানো বাঁশ ঝাড়ের সাথে আটকে আছে ।

অবাক করা ব্যাপায় হলো বাঁশ কখনো নিচু হয়ে থাকে না সাধারনত । কিন্তু যেভাবে বাঁশগুলো বেঁকে আছে তাতে মনে হচ্ছে ইচ্ছা করেই কেও এমনটা করেছে । অথবা বাঁশগুলোই নিচে নেমে এসেছে । আর দুজনের মধ্যে ডাঃ ইমরানের কন্ঠনালী এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে বের হয়েছে একটা গাছের ঢাল । ডাঃ ইমরানের শরীরটা জীপ থেকে দু ফুট পিছনে গাছের ডালটার সাথে অসহায় ভঙ্গিতে দুলছে ।

মুখ হা হয়ে আছে লোকটার , মুখের দুপাশ আর কন্ঠার ছিদ্রটা দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে , শরীর বেয়ে টপ টপ করে পরছে রাস্তার উপর । সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে ডাঃ পিযূষ । তার শরীরের অর্ধেকটা জীপের ভিতরের দিকে আর বাকি অর্ধেক রাস্তার উপরে পরে আছে , তার ঠিক পেট বরাবর এসে পড়েছে জীপ থেকে খুলে আসা দুটো শিক , পা থেকে দেহের উপরের অংশ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে । আরেকটা শিক সোজা ঢুকে গেছে তার মাথার পিছন দিক দিয়ে , বাম চোখ ভেদ করে রাস্তায় গেথে আছে সেটা । ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সবাই , হুশ ফিরতেই চিত্‍কার করে উঠলো মেয়েরা ।

ভয়ে , আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে সবার মুখ । জীপ থেকে নামলো সবাই । ডাঃ আসিফ আর ডাঃ জাওয়াদ এগিয়ে গেলো সামনে , মৃতদেহগুলো পরিক্ষা করলো । ডাঃ ইমরানের মৃতদেহটা নামানোর কোন ব্যাবস্থাই নেই , রাস্তা থেকে প্রায় ১০ ফুট উচুতে তার দেহ । বিস্ফোরিত চোখে এখনো লেগে আছে আতংক ।

নীলাকে এক হাতে আগলে ধরে আছে রুদ্র , মেয়েটা ফোপাচ্ছে তার বুকে মুখ গুজে । হটাত্‍ কি মনে হওয়াতে নীলাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো রুদ্র । মৃতদেহগুলো পরিক্ষা করলো । ডাঃ পিযূষের পায়ে একটা গভীর ক্ষত দেখতে পেলো , খুব চোখা কিন্তু ধারালো নয় এমন কিছু ঢুকেছিল এখানে । ঝট করে বাঁশঝাড়টার দিকে তাকালো সে ।

একটা বাঁশের চূড়ায় লাল একটা আভা দেখতে পেলো । ঢোক গিললো রুদ্র , গলা ভীষন শুকনো লাগলো হটাত্‍ । কেন যেন মনে হলো সমগ্র ব্যাপারটাই কেউ ইচ্ছে করে ঘটিয়েছে । মনে পরলো ডাঃ ইমরান ছাড়া সবাই জীপের মেঝেতে পেতে রাখা সিটে বসে ছিল । ডাঃ ইমরানের গলায় ডালটা ঢুকে যাওয়ায় সবার চিত্‍কারে সম্ভবত ড্রাইভার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে ।

পাহাড়ের গায়ে সজোরে ধাক্কা দেয়ার ফলে হয়তো পাথরটা এসে পরে জীপটার উপর । বাকি যেসব আরোহী বেচে ছিল , তারা জীবন নিয়ে বাচার চেষ্টা করে কিন্তু বাঁশগুলো কোনভাবে নিচে নেমে আসে এবং তাদেরকে গেঁথে ফেলে । ডাঃ পিযূয ভাগ্যবান ছিল যার কারনে তার পায়ে লাগে বাঁশের আগা । কিন্তু জীপ থেকে নামার আগেই বিভত্‍সভাবে খুন করা হয় তাকে । যেন কেউ একজন খুব সতর্কভাবে একে একে মেরেছে সব সাক্ষীকে ।

হটাত্‍ জীপটার নাম্বারপ্লেটের দিকে নজর গেলো রুদ্রর , ধূলোর আস্তরন পরে তার অর্ধেকটা ঝাপসা হয়ে এসেছে , সেখানে লেখা "ঢাকা মেট্রো -ম-৬৬-৬" বাকি তিনটা সংখ্যা বালুতে ঢাকা । কিন্তু রুদ্র জানে বাকি তিনটা সংখ্যা ৬৬৬ । দ্য ডেভিল নাম্বার । এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো হটাত্‍ , খস খস করে কুতসিত শব্দ করলো বাঁশপাতাগুলো , আর নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো রুদ্র । (চলবে) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।