'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক দুর্বৃত্তায়নের কারণে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশটাই যে পচে গেছে তা দেখতে কোনো বিশেষজ্ঞ চোখের প্রয়োজন পড়ে না। আমরা আম-জনতা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছি, এই পচন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আমরা জানি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড আর দুর্নীতিতে সিদ্ধ মানুষগুলোই এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় শক্তি। সেই শক্তির দোর্দণ্ড প্রতাপ এতোটাই যে রাজনীতিতে সাচ্চা মানুষের কদর আর নেই। দলগুলো তাদের নিজেদের চরিত্র হারিয়েছে, স্বাধীনতা-বিরোধী মৌলবাদী আর স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই চরিত্র হারানোর প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত করেছে।
আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, এই রাজনৈতিক চর্চা কোনো সুস্থ ভবিষ্যত বয়ে আনতে পারে না। না দেশের জন্য, না জাতির জন্য। কাজেই এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
এ পর্যন্ত আমাদের উপলব্ধি হয়ে গেছে। কিন্তু এই উপলব্ধিটাই কি শেষ? তা কিন্তু না।
বরং বিষয়টি ঠিক উল্টো। আমাদের এই উপলব্ধি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে আগামীতে কী ধরণের পরিবর্তন নিয়ে আসবে- গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই উপলব্ধিটাই। আমাদের দেশে বড়ই বিস্ময়কর কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এখন চলছে সেই উপলব্ধি তৈরিরই নানা কসরত। আমরা দেখছি, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর রাজনীতিবীদদের গণবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ায় অতিষ্ট সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, দেশটা কিছুদিনের জন্য হলেও রাজনৈতিক নেতাদের হাতের বাইরে থাক। এই তো বেশ আছি, হরতাল-অবরোধ-নৈরাজ্য নেই।
সাময়িক স্বস্তিই তো আমাদের বিরাট পাওয়া! আমরা দেখছি, পচে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর উছিলায় পুরো দেশের রাজনীতিকেই পচা হিসেবে তুলে ধরার একটা গুরু দায়িত্ব কেউ কেউ ইতিমধ্যে কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই সুযোগে। বরাবরের মতো জনগণকে আগ-পিছ ভাববার অবকাশ না দিয়েই সাময়িক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগানোর এই কৌশল হয়তো কাজেও দেবে। কিন্তু তারপর? যে গণতন্ত্র অর্জন নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গর্ব, সেই গণতন্ত্র কি এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নিঃশেষ করে ফেলা হবে? না কি গণতন্ত্রের লেবেল দিয়ে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের সাময়িক সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে দেশ একটি অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে এগুবে?
আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। এই অস্থিরতার ধারাবাহিকতায়ই গণতন্ত্রের আগমন 16 বছর আগে। আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল সেই গণতন্ত্র কিন্তু শুরু থেকেই তার প্রকৃত চেহারা নিয়ে ফুটে ওঠার অবকাশ পায়নি।
এই না পাবার পেছনে আমাদের দেশের রাজনীতিবীদদের ভূমিকা তো আছেই। কিন্তু ল্য করার মতো বিষয় হলো দীর্ঘদিনের একটি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের সবগুলো কলকব্জা সুনিপুণভাবে নাড়াচাড়া করে শুরু থেকেই গণতন্ত্রটিকে একটি আস্থাহীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়েছে সুচতুর কৌশলে। গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় কথাই হলো আস্থা। কারণ এখানে যে সরকার নির্বাচিত হবে দেশের সব জনগণ যে তাদেরকেই ভোট দিয়েছে, তা নয়। অধিকাংশের ভোট পেয়ে নির্বাচিত এই সরকার তাই আস্থা অর্জনই মূল ল্য ধরে এগুবে।
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা এখানেই। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। 1991 সালে বিএনপি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার পর থেকেই আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রযাত্রা ধরা হয় কাগজে-কলমে। কিন্তু আমরা যদি তাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই বলি, তাহলে দেখবো সেই প্রক্রিয়ায় বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষ চরম আস্থাহীন হয়ে পড়ে তাদের 5 বছরের শাসনেই। কিন্তু গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের আস্থা পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি তো সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই বোঝা এবং প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
আমাদের দেশে তো তা হলো না। আমাদের দেশের গণতন্ত্রে বিএনপির ওপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যাওয়ার সুযোগে নির্বাচনের আগে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করা হয়। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চিন্তাটা এমন যে, পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবচেয়ে অরাজনৈতিক অংশই হলেন এই সরকারের সদস্য। গণতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকেই যেনো উঠে গেলো আস্থা। কাজেই 5 বছর ধরে যারা রাষ্ট্র শাসন করবেন, তাদের ওপর আর নির্বাচনের ভার দিয়ে আস্থা রাখা যাচ্ছে না।
এ কারণেই একটি অরাজনৈতিক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় রাষ্ট্রভার গ্রহণ করবেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর আবার সেই আস্থাহীন রাজনৈতিক দলগুলোরই কোনো এক বা একাধিকের হাতে ক্ষমতা অর্পন করবেন, যারা বিজয়ী হবে নির্বাচনে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফমর্ুলা 1996 সালে দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিলো। আমরা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবো, এই ফমর্ুলার প্রস্তাবকারী হিসেবে জাহির করার জন্য সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কী পরিমাণ স্ট্যান্টবাজি কাজ করেছিলো। জামায়াত তো গোলাম আযমকে এর প্রবক্তা হিসেবে জাহির করেছিলো বেশ জোরেসোরেই। আমরা কিন্তু জানি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই ফমর্ুলা আবিষ্কারের ক্রেডিট নিজ ঘরে নিতে এই লাফালাফি আসলে কাদেরকে দেখানোর জন্য ছিলো।
এমন নয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ইংরেজিতে যাকে কি না বলে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট, সেই ধারণা বাংলাদেশেই প্রথম। বিশ্বের অনেক দেশে অনেক সময়ই এই ধরণের সরকার আসতে হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশেই কেবল এই সরকার একেবারে অরাজনৈতিক সদস্যদের নিয়ে গঠিত হবার কথা বলা হয়েছে এবং তা কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশের অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাদের কাছ থেকে বহুল প্রশংসিত হয়েছে সেই রাষ্ট্রগুলোতেও কিন্তু এই ধরণের সরকার এসেছে। কখনো কখনো পুরো সরকার না হলেও নির্দিষ্ট দায়িত্বের জন্য কাউকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বসানো হয়েছে।
কিন্তু কোনোবারই তাদের এই সরকার অরাজনৈতিক ছিলো না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য 1945 সালের 23 মে থেকে 26 জুলাই ইংল্যান্ডে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করে। রক্ষণশীল দলের নেতা উইনস্টন চার্চিল 1940 সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং সেই সময়ও তিনিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পতনের পর রক্ষণশীল দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জাপান পতন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধকালীন কোয়ালিশন সরকারের কাজ চালিয়ে যাবার প্রস্তাব রাখেন লেবার পার্টির প্রধান কেমেন্ট অ্যাটলি ও লিবারেল পার্টির প্রধান আর্চিবাল্ড সিনকেয়ারের কাছে। প্রথম দিকে চার্চিলের এই প্রস্তাব স্বীকৃত হবে বলে মনে হলেও লেবার পার্টির কার্যকরী বৈঠকে প্রস্তাবটিকে রীতিমতো তুলোধুনো করা হয়।
ফলে অ্যাটলি, চার্চিলকে লিখে দেন, অক্টোবরেই তারা নির্বাচন চান। এদিকে দ্রুত নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী রক্ষণশীল দলে নিজ ঘরেই চাপের মুখে পড়েন চার্চিল। ফলে 1945 সালের 23 মে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে চার্চিল পদত্যাগ করেন। এভাবে যুদ্ধকালীন কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। যুক্তরাজ্যের ষষ্ঠ কিং জর্জ 1945 সালের সাধারণ নির্বাচন স্থগিত করে চার্চিলকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানান।
1940 সালের জাতীয় সরকারে যারা ছিলেন এবং অধিকাংশ রক্ষণশীল দলের নেতাদের নিয়ে ওইদিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। চার্চিল এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও থাকে তার হাতে। 25 মে সরকারে যুক্ত হন লর্ড চ্যান্সেলর হিসেবে ভিসকাউন্ট সিমন্স, কাউন্সিলের লর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে লর্ড উল্টন, লর্ড প্রিভিসিল হিসেবে লর্ড বেভারব্রুক, চ্যান্সেলর অব এঙ্িেকউর হিসেবে স্যার জন আন্ডারসন, পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি হিসেবে অ্যান্থনি ইডেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে স্যার ডোনাল্ট সামারভেল, অ্যাডমিরাল্টির ফার্স্ট লর্ড হিসেবে ব্রেন্ডান ব্র্যাকেন, কৃষি ও মৎস মন্ত্রী হিসেবে রবার্ট হাডসন, বিমান মন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান, উপনিবেশ সেক্রেটারি হিসেবে অলিভার স্ট্যানলি, ডোমিনিয়ন অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি হিসেবে ভিসকাউন্ট ক্র্যানবোর্ন, শিামন্ত্রী হিসেবে রিচার্ড ল, ভারত ও বার্মা বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে লিও অ্যামেরি, শ্রম মন্ত্রী হিসেবে র্যাব বাটলার, উৎপাদন মন্ত্রী ও ব্যবসায় বোর্ডের প্রধান হিসেবে অলিভার লিটেলটন, স্কটল্যান্ড বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে আর্ল অব রসবেরি ও যুদ্ধ বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে স্যার জেমস গ্রিগ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব সদস্যই ছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
লিবারেল পার্টি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জোরতাল প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তাদের কেউই সে কারণে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অংশ নেননি। 1945 সালের 5 জুলাই এই সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। 26 জুলাই ফল প্রকাশ হয়। ওইদিনই চার্চিল মতা ছেড়ে দেন নয়া প্রধানমন্ত্রী কিমেন্ট অ্যাটলির হাতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) শব্দটি সেইসব ব্যক্তিবিশেষের বেলা ব্যবহৃত হয় যারা সরকারের কোনো পদে অস্থায়ীভাবে বসেন।
অনেক সময় এ ধরণের অনেককে গভর্ণর সিনেটর হিসেবে নিয়োগ করেন। সাময়িক এই ব্যবস্থা করা হয় কোনো সিনেটরের মৃতু্য অথবা পদত্যাগের কারণে শূন্যতা তৈরি হলে। এছাড়া 1974 থেকে 1977 সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নেলসন রকফেলারকে তত্ত্বাধায়ক বলা হয়ে থাকে। তিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর সৃষ্ট জটিলতাকালে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি 1976 সালের নির্বাচনের পর 1977 সালে তার দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে 1996 সালের এই প্রক্রিয়াটিকে আসলে অনেকে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমের সঙ্গে মেলাতে পছন্দ করেন। 1975 সালে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচিত গফ হুইটলাম সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠে। সমঝোতার সব রকম চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর দেশটি অস্থিতিশীলতার দিকে এগুতে থাকে। গভর্নর জেনারেল স্যার জন ক্যার 11 নভেম্বর হুইটলামকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। তিনি সেই পরামর্শ গ্রহণ করেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করেন ওইদিন বিকেলে বিরোধী নেতা ম্যালকম ফ্রেজারের কাছে। দুটি হাউজ বিলুপ্ত হয়ে যায় সিনেট এ সংক্রান্ত বিল অনুমোদনের পর। ফ্রেজারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত সরকার না হবার কারণে ক্যাবিনেট বৈঠকে তাদের জন্য সুর্নিদিষ্ট কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করে দেয়া হয়। ফ্রেজারের সাময়িক সরকার সেই নীতিমালা অনুসরণ করেছিলেন। ক্যাবিনেটের 4 নম্বর সিদ্ধান্ত ছিলো, তারা কোনো নতুন পলিসি নির্ধারণ করতে পারবে না এবং পারতপ েনিয়োগ এড়িয়ে চলবে।
10 নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিলো, নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলাকালে আগের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত চালানো যাবে না। যদিও রাষ্ট্র জুড়ে অস্থিরতা চলছিলো, তারপরেও ফ্রেজারের লিবারেল-ন্যাশনাল পার্টি কোয়ালিশন আগের সরকারে দায়িত্ব পালনকারী নেতাদের পরাজিত করে 13 ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়। 22 ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেয়ার পর ফ্রেজার সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
এখন যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিন্তু শুরু থেকেই অরাজনৈতিক। আমাদের দেশের রাজনীতিবীদরা সেই অরাজনৈতিক সরকারের হাতে 90 দিনের জন্য মতা ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত থেকেছেন।
কিন্তু এই 90 দিনের অরাজনৈতিক সরকার এটাই প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্রে যে আস্থার বিষয়টি ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়, সেটি বাংলাদেশের 16 বছরের গণতন্ত্রে একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে গোড়াতেই এই আস্থাহীনতার মন্ত্র জপে সেই মতে দীক্ষিত করে তোলা গণতন্ত্র আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবার পথে এখানেই বড় বাধার মুখে পড়ে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই আস্থাহীনতার প্রকাশ এতোটা প্রকট সেখানে জনগণ তার ওপর আস্থা রাখবে কী করে? কাজেই চিন্তাগত ভিত্তি নয়, কেবলমাত্র দলীয় সেন্টিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে গণতন্ত্র এবং দেশটা সেই সেন্টিমেন্টের ওপর ভিত্তি করেই পরিষ্কার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এখানে ভেবে দেখার বিষয় আছে, বাইরের দেশগুলোতে যে পেক্ষ্রাপটে তত্ত্বাবধায়কদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের বাস্তবতার মিল আসলে কতোখানি ছিলো।
আস্থাহীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত গণতন্ত্রের কারণে যখন দেশজুড়ে নৈরাজ্য আর অস্বাভাবিক অস্থিরতা, তখন আমরা আঁচ করতে পারলাম, এমন ধারা অব্যাহত থাকলে 'তৃতীয় পক্ষ' সুযোগ নেবে।
পরিষ্কার নয় কে এই তৃতীয় পক্ষ। তবু আমাদের দেশের অনেকে এবং বাইরের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেন ভালোমতোই। এখন দেশটির এই পরিস্থিতিতে ভাবা যেতেই পারে তৃতীয় পক্ষ আসলে কারা? গণতন্ত্রকে আটকে দেবার অনেক পুরানো পন্থার একটি সামরিক শাসন। কিন্তু যদি সেই বাস্তবতা না মেলে তাহলে রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প কোনো 'তৃতীয় পক্ষ' অবশ্যই একটি অরাজনৈতিক সরকার। আমাদের দেশের রাজনীতিবীদদের ওপর মানুষের আস্থা উঠে যাবার সেন্টিমেন্ট এই পর্যায়ে যে, যেকোনো শক্তিশালী মিডিয়া যদি বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এখন একটি অরাজনৈতিক সরকারই উত্তরণের পথ, তাহলেই কেল্লা ফতে।
কিন্তু সেই অরাজনৈতিক সরকার কি সাময়িক স্বস্তির বাইরে কোনোকিছু দিতে পারবে?
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের মধ্যে মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দিনে দিনে একটি অরাজনৈতিক সরকারের টেস্ট কেস হিসেবে ভালোই উতরে গেছে। রাজনীতিবীদদের আস্থাহীনতার রোগ সারাতে গিয়ে মাঝের 90 দিন এই অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের ব্যাপক আস্থাও অর্জন করেছে। মানুষ দেখেছে, অন্যভাবে বললে, মানুষকে দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, এদের আমলে কোনো পক্ষপাত নেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জননিরাপত্তা সবকিছুই স্বাভাবিক থাকে। কাজেই সেই টেস্ট কেস কাজে লাগিয়ে অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সাময়িক স্বস্তির সেন্টিমেন্ট থেকে মানুষের পক্ষপাতও রয়েছে।
সুতরাং আস্থাহীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত গণতন্ত্র আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
আগেই বলেছি, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অজস্র প্রশ্নের কথা। কিন্তু কোনো অরাজনৈতিক সরকার কি সেই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারে কি না- তা ভেবে দেখাটাও জরুরি। যে ব্যবস্থার আওতায় গণতন্ত্রেও আস্থাহীনতার মন্ত্র জপ চলছে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থেকে দীর্ঘমেয়াদী সরকার পরিচালনায় কি কারো সফল হবার উপায় আছে? যে রাষ্ট্র সমষ্টিকভাবে সম্পদশালী নয়, অথচ অনেক মানুষ কোটি কোটি টাকা কামিয়ে বিশ্বধনীদের সারিতে স্থান করে নিয়েছে, সেই রাষ্ট্র কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখবে না বারবার? এই সংকটের মোকাবেলা কি সংগঠিত রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কোনো পথে করা সম্ভব? একটি সর্বব্যাপী বিস্তৃত রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আসলে একটি সর্বব্যাপী জনগণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। কাজেই আমাদের ভাবতে হবে সেই পথেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।