আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আস্থাহীনতার বেড়াজালে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক।

সততায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ভাষ্যমতে ভারত আমাদের পরম মিত্র। ঐতিহাসিকভাবেই ভারত আমাদের মিত্র হবার কথা। কেননা বাংলাদেশের সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে এই দেশটি আমাদের ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল। তাদের সহায়তার জন্যই আমরা অল্প সময়ে স্বাধীনতার মুখ দেখতে পেয়েছিলাম। তবে ভারতের সহায়তার পেছনে তার কৌশলগত স্বার্থ জড়িত ছিল বলে অনেক তাত্ত্বিক দাবি করে থাকেন।

কিন্তু তারপরেও আমরা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের সহায়তার বিষয়টিকে অস্বীকার করতে পারবনা। যাহোক স্বাধীনতা পরবর্তীতে ভারত আমাদের সাথে যেমন আচরণ করছে তা লক্ষ্য করে অনেকে ভারতকে বাংলাদেশের জন্য বৈরি ভাবাপন্ন রাষ্ট্র ভাবলেও আসলে তা ঠিক নয়। সাধারনত আমরা বর্তমান বাস্তববাদী বিশ্বব্যবস্থায় অনেক রাষ্ট্রের মাঝেই এমন উপাদানর খুঁজে পাই। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো সর্বদাই নিকটবর্তী ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণও অনেকটা সেরকমই।

ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ। তিন দিক হতেই দেশটি বাংলাদেশকে বেষ্টন করে আছে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করে। বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তি, ভৌগোলিক বাস্তবতা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমরা ভারতের এ প্রভাবকে মেনে নিতে বাধ্য। শুধু বাংলাদেশই নয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও ভারতের প্রচ্ছন্ন আধিপত্য রয়েছে।

আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারত প্রতিবেশি দেশগুলো হতে এক ধরনের অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশির ন্যূনতম স্বার্থকেও ভারত মাঝে মাঝে ছাড় দিতে রাজি হয়না। বাণিজ্য, অর্থনীতি সকল দিক থেকেই ভারত আঞ্চলিক সংহতি ও বৃহৎ আঞ্চলিক স্বার্থকে প্রধান্য না দিয়ে নিজ দেশের স্বার্থের কথা সবচেয়ে চিন্তা করে বেশি। এ কারণেই প্রতিবেশি বৃহৎ শক্তি সম্পর্কে দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশ এক ধরনের আস্থাহীনতায় ভোগে। এই আস্থাহীনতা বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ককেও ব্যাপক মাত্রায় প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম একটা সমস্যা হল ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনা বললেই চলে। আবার বিভিন্ন সময়ে স্বাক্ষরিত চুক্তির সঠিক বাস্তবায়নেও ভারতের অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে ভারত যাতে প্রতিশ্রুতি ও চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন করে সে জন্য সরকারি ও কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সবসময়ই ভারতের সাথে যথাযথ দরকষাকষিতে ব্যর্থ হয়। কূটনেতিক অদক্ষতা, আমলাদের অনভিজ্ঞতাই এর জন্য মূলত দায়ি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে SAPTA (South Asian Preferential Trade Agreement) স্বাক্ষর করে। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপক বাণিজ্য উদারীকরণ এবং একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের লক্ষ্যে SAFTA (South Asian Free Trade Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছিলো ২০০৪ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১২তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে। ২০০৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। সাফটা চুক্তি অনুযায়ী সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপকে গণ্য করা হয় এলডিসি হিসেবে এবং ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে ধরা হয় অপেক্ষাকৃত উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলো শুল্কের পরিমাণ কমিয়ে এনে ২০১৩ সালের মধ্যে শুন্যের কোঠায় নামানোর কথা।

কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে আরো তিন বছর বেশি সময় দেয়া হয়। অর্থাৎ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক আদায় করতে পারবে কিন্তু রপ্তানির সময় ভারতকে কোন কর দিতে হবেনা। কিন্তু প্রত্যেকটা দেশের স্থানীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য কিছু স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৪৮০টি পণ্যকে “স্পর্শকাতর” তালিকায় রেখেছে ভারত। ধীরে ধীরে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা কমানোর কথা বলা হলেও তা কমানো হচ্ছেনা।

আবার ২০০৬ সালে সাফটা কার্যকর হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশগুলোর মাঝে অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষত সাফটা বাস্তবায়নে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে অনেকেই দাবি করেছেন। তাই সাফটাকে নিয়ে আজ নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। সাফটা কার্যকর হলেও বাংলাদেশ-ভারত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতি বছরই ঘাটতি বাড়ছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানির তালিকা এবং পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু ভারত থেকে আমদানি পণ্যের পরিমাণ আমাদের রপ্তানির তুলনায় অনেক বেশি।

২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে ২০১০-১১ অর্থবছর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে মোট পণ্য আমদানি করেছে ১৮৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার সমমূল্যের। যার বিপরীতে বাংলাদেশ ভারতে পণ্য রপ্তানি করেছে মাত্র ২৪ কোটি ২১ লাখ ডলারের। সুতরাং ওই অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ১৬০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ২২২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য। এ সময় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ১৫৩ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময় বাণিজ্য ভারসাম্য দাঁড়ায় ৩০২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ২৮৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য।

সেই বছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৯০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। ২০১০-২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক বৈষম্য এ যাবতকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌছে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১০-২০১১ সালে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করে ৪৫৭ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যসামগ্রী এবং পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সেদেশে রপ্তানি করে মাত্র ৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের সঙ্গে চোরাই পথে আসা পণ্যের হিসাব করলে ঘাটতির পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যাবে। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ভারত থেকে আসা ৮৩ শতাংশ পণ্য আসে চোরাই পথে।

এর পরিমাণ ৬৩১ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে এটা সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক কতটা বৈষম্যমূলক। মূলত ভারতের রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির কারণেই ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। সাফটা চুক্তিতে বেশ কিছু পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাসের কথা বলা হলেও ভারত তা কার্যকর করছেনা। বাংলাদেশের সাথে ভারতের এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

তবে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্যে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ও বাংলাদেশের আখাউড়ার মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনে সম্মত হয়েছে ঢাকা ও দিল্লী। নতুন এই সংযোগ আন্তঃসীমান্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যে গত দুই বছরে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সনের ২৩ অক্টোবর ভারতে ‘সীমান্ত হাট’ স্থাপনে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

দু’দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী সীমান্ত হাট উদ্বোধন করেছেন। সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ প্রতি বুধবারে হাটটি বসবে। এই সীমান্ত হাট দু’দেশের সম্পর্ককে আরো উন্নয়ন করবে এবং আন্তঃবাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে। আগে উভয় দেশের ট্রাক জিড়ো পয়েন্ট থেকে মালামাল লোড ও আনলোড করত। কিন্তু এখন ভারতের ট্রাক বাংলাদেশের ২শ মিটার পর্যন্ত গুদামে প্রবেশ করতে পারে।

আবার বাংলাদেশের ট্রাক ভারতের দুইশ মিটার পর্যন্ত পণ্য নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। ভারতে যে সমস্ত কারণে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ব্যাহত হয় তা হলো প্রতিটি চালানের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল পেতে বিলম্ব, বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব শুল্ক, এন্টি ডাম্পিং, কাউন্টারভেইলিং ডিউটি ইত্যাদি। এর বাইরে রয়েছে স্থলপথে পণ্য রপ্তানির বাধাসমূহ, যেমন গুদাম ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, রাস্তাঘাটের দুরাবস্থা, ভারতীয় কাস্টমস এর স্বেচ্ছাচারিতা, পণ্যবাহী যানবাহনের পার্কিং এর অসুবিধা, ট্রানশিপমেন্ট ইয়ার্ডের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। তাই ভারত বাংলাদেশের উচিৎ এই সমস্ত সমস্যা মোকাবেলায় যৌথভাবে কাজ করা। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভারতের সাথে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি নিরসন করা।

ভারতে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা সম্প্রসারিত হলে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য আরো গতিশীল হবে। ভৌগোলিক সুবিধা, উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত শ্রম সরবরাহের কারণে প্রতিবেশি দেশ দু’টির মধ্যে বাণিজ্য বাড়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই অমিত সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই দেশদু’টির এগিয়ে যাওয়া উচিৎ এবং পারস্পারিক বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যৌথভাবে কাজ করা উচিৎ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।