আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
আন্তঃনগর সুবর্ণ এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রাম ফেরার সেদিন আমাদের পাশাপাশি তিনটি আসনের পাশের আসনটিতে বসেছিলেন একজন ভদ্রমহিলা। তরুণী তিনি নন; আবার মধ্য বয়স্কাও বলা যাবে না। মহিলা একা যাত্রা করছিলেন। নিজেদের সাথে ভারী এবং বিভিন্ন আকারের একাধিক ব্যাগ থাকায়, এখানে ওখানে পায়ের কাছে ব্যাগ-জিনিষপত্র বিছিয়ে নিয়ে বসে থাকা ভদ্রমহিলার উপর বিরক্তি হচ্ছিল। যদিও কিছু বলিনি! হয়ত তিনি আসার আগেই উপরের লম্বা তাকটার এই অংশটা অন্যান্য যাত্রীদের ব্যাগে ভরে গিয়েছিল কিংবা ভদ্রমহিলা একলা হওয়ায় উঁচু তাকটিতে মালামাল উঠিয়ে রাখতে পারেননি বলেই আমাদের পা রাখার স্থানেও ব্যাগ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এখন সে গুলো কোন-উপায়েই আর তাকটিতে উঠিয়ে রাখার সুযোগ নেই। আমাকেও ধান ছিটানোর মত করে আমাদের ব্যাগ গুলোকে কামরার অনুদৈঘ্র্য দুটো তাকের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতে হল। সে যাই হোক, আমার আসনটি তফাতে হওয়ায় ভদ্রমহিলার পাশে আমাদের ঘরের কাজে সাহায্যকারী মেয়েটিকে বসতে দিয়ে এ নিয়ে আর চিন্তা করিনি। যদিও নিশ্চিন্ত হবার পূর্বে তাকে (মেয়েটিকে) একাধিক বার জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলাম, তার বসতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা। আবার নিজেও মহিলার ব্যাগ গুলো অনুমতি নিয়ে সিটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।
তো শুরু হল যাত্রা।
একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কি এক হট্টগোলে ঘুম ভেঙে দেখি সেই ভদ্রমহিলা বগির মেঝেতে হামাগুড়ি দেবার মত করে বসে সামনের দিকের একটি সিটের নিচে কি যেন খুঁজছেন আর তাকে ঘিরে লোকজন উৎসুক দাঁড়িয়ে আছে! তাদের চেহারায় কৌতুকও লক্ষ্য করলাম। অবাক কাণ্ড! একজন ভদ্রমহিলা ট্রেনের কামড়ার মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আরেকজনের আসনের নিচে হাতড়ে কি খুঁজছেন? আর কেনই বা একজন পূর্ণ বয়স্ক ভদ্রলোক সেই সিটের উপরে পা তুলে বসে আছেন? তাও আবার জুতা সহ! খানিক বাদেই বুঝা গেল ব্যাপারটা। মহিলা যেটা খুঁজছিলেন সেটা পেয়ে তড়িৎ গতিতে কিছুটা অপ্রতিভ এবং লাজুক ভঙ্গিতে আমাদের দিকে আসতে শুরু করলেন।
খেয়াল করে দেখি তার হাতে একটা জীবন্ত কচ্ছপ। তার পোষা বোধহয়; না হলে আর সঙ্গে নিয়ে চলবেন কেন? তার অলক্ষ্যে কচ্ছপটি পালিয়ে যেতে চেয়ে সামনের আসনে বসে থাকা যাত্রীদের পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। ধীর গতির অবুঝ প্রাণীটি বুঝতে পারেনি- শরতের বিকালের রোদে ঝলমল করতে থাকা জলাধার গুলোর পাশ ঘেঁষে চলছে সে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর একটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হারিয়ে যেতে হলে নিজের থাকার পাত্রটি থেকেই শুধু নয়, মুক্তি পেতে হবে ট্রেন নামক এই বিশালাকারের চলমান খাঁচাটি থেকেও। সবাই খুব মজা পেল এই কাণ্ডে। পাশের চ্যাংরা মত একটি ছেলে আবার আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “কচ্ছপ খায় বোধহয়?”।
অদ্ভুত প্রশ্ন! কচ্ছপ খাবে কেন? আর খেলেও জীবন্ত অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চলবে কেন?
কিছুক্ষণ বাদে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলে ভেতরের ম্লান সাদা বাতি গুলো জ্বলে ট্রেনের কামরাটা একঘেয়েমিতে ভরে গেল। যে জানালা গুলোর স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে কিছুক্ষণ আগেও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, জলাভূমি আর তাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবুজ গ্রাম গুলো চোখে পড়ছিল, সেগুলোর কাঁচে এখন নিজের চেহারার অস্পষ্ট ভুতুড়ে প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তাই ঘুম এবং জানালার পালা শেষ করে সকলে এবার সহযাত্রীদের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হল। ফলশ্রুতিতে এক সময় আমার সাড়ে দশ মাসের বাচ্চাটাকে আমি সেই কচ্ছপ-মহিলার কোলে দেখতে পেলাম এবং আতঙ্কের সাথে খেয়াল করলাম মহিলার যে আঙ্গুল গুলো আমার বাচ্চাটার গাল দুটোকে টিপে টিপে আদরে ব্যস্ত, ঘণ্টা দেড়েক আগেও সে আঙ্গুল গুলোই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও একটা কচ্ছপকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল! আমি নিশ্চিত নই, তবে মনে হয় না ভদ্রমহিলা এর মধ্যে হাত ধোঁয়ার তাগিদে বেসিনের দিকে গিয়েছিলেন! নিজের পোষা প্রাণীদের কেউ ঘেন্না করেননা। তিনিও করেননি! কিন্তু মাদাম, এইটা আপনি কি করলেন? কথাটা অবশ্যই আমি পাড়তে পারিনি।
পরে আমার স্ত্রীকে বলে আমার বাচ্চাটার গাল দুটোয় (মহিলার অলক্ষ্যে নিশ্চয়ই) বোতল-জাত জীবাণুমুক্ত-কারি ক্রিম ঘষে জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করব বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেটাও আবার ভুলে গেলাম! শুধু ভুলেই যাইনি, আমার বাচ্চার সেই গাল দুটোতে একাধিক চুম্বনও দিয়েছি বলে এখন আমি মনে করতে না চাইলেও মনে পড়ছে। সব দোষ ঐ ট্রেনে মালপত্র বোঝাই করে বসে থাকা কম বয়সী ভদ্রমহিলার বোঁচকা গ'লে পালিয়ে যেতে চাওয়া কচ্ছপ বেটার। তুই বেটা পালালি কেন?
http://www.notun-din.com/?p=7613
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।