আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোশগল্প- দুই ( আমাদের সেই দিগবিজয়ী ছাগল কালু)

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

এখন থেকে আঠারো বছর আগের এক কোরবানির ঈদের সময়, আমার বন্ধু রাজুর বাবা একটি ছাগল কিনেছিলেন কোরবানি দেবেন বলে। ছাগলটি ছিল আকারে ছোট; প্রায় বাচ্চা। গাঁয়ের রঙ কুচকুচে কালো ছিল বলে কাছে না গেলে ছোট ছোট শিং দুটো তার প্রায় চোখেই পড়ত না। ছাগলটি ছিল অত্যন্ত খেলুড়ে স্বভাবের; উচ্ছ্বল এবং ভীষণ মারকুটে। আর তাই চড়ানোর কথা বলে রাজু সেটাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই সে আমাদের মন জয় করে নিল।

মন জয় করার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, ছাগল আরও অনেকেই কিনেছে কিন্তু সবার ছাগল আমাদের মন জয় করতে পারেনি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। ছাগলটা কেমন হলো, ওটা আমরা বুঝতাম সেটাকে আরেকটি ছাগলের সাথে লড়াই লাগিয়ে দেওয়ার পর; আগে নয়। তাই রাজু ছাগলটিকে আমাদের কাছে নিয়ে আসার প্রায় সাথে সাথেই কোরবানির উদ্দেশ্যে কেনা মাঠে বেঁধে রাখা অন্যান্য ছাগলগুলোর মধ্য থেকে একটাকে আমরা নির্বাচন করলাম এটার সাথে লড়াই লাগিয়ে দেবার জন্য। নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সেখানে ছাগলটির মালিকের অনুপস্থিতির বিষয়টিই প্রাধান্য পেল; ছাগলটির আকার কিংবা স্বাস্থ্য নয়।

রাজুদের ছাগলটির চেয়ে, লড়াইয়ের জন্য বাছাইকৃত নির্বাচিত ছাগলটি আকারে বড়ই হবে। তবে সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত হলাম না মোটেও। ষাঁড়ের চেয়ে ছাগল ব্যতিক্রম, একটাকে আরেকটির কাছে নিয়ে গেলেই কিন্তু ছাগলদের মধ্যে লড়াই বেঁধে যায় না। রীতিমত জোর-জবরদস্তি করে ছাগলদের মধ্যে লড়াই লাগাতে হয়। কিন্তু রাজুদের সেই ছাগলটাকে, মালিকবিহীন ছাগলটির কাছে নিয়ে যেতেই সে পলকেই ওটার সাথে লড়াই করা শুরু করে দিল।

আমাদের উত্তেজনা ছাগলটির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল হয়ত। সে এক দেখার মত দৃশ্য! পেছনের দু পায়ে ভর দিয়ে প্রায় খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, ধা করে একটা আরেকটার শিঙে গুঁতো লাগায়। এইভাবে চলতে থাকে। কি সে উত্তেজনা! প্রতিটি আক্রমণে আমরা চিৎকার করে আমাদের কালু-ছাগলটিকে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। অল্প ক্ষণের মধ্যেই রাজুদের ক্ষুদে ছাগলটি, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মালিকবিহীন মাঝারী আকারের ছাগলটিকে পরাজিত করল।

আর আমরা সকলে খুশিতে, প্রশংসায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের ছাগলটিও (এই পর্যায়ে ছাগলটি আমাদের হয়ে গেল) তার মালিক-পক্ষের লোকজনদের উল্লাসে ফেটে পড়তে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সেখান থেকেই শুরু হল কালু-ছাগলটিকে নিয়ে আমাদের একের পর এক যুদ্ধ জয়ের অভিযান। ঈদ উপলক্ষে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর থেকে রাতদিন যে এলাকাটির রাস্তা-ঘাট, মাঠে আমরা খেলে বেড়াতাম, সেটি চট্টগ্রামের কেন্দ্রে আগ্রাবাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত; শান্ত, পরিচ্ছন্ন ও গোছান। এলাকাটিতে বসবাসকারী মানুষজন কোরবানি দেবার উদ্দেশ্যে সেবার যত ছাগল কিনেছিল, তাদের একটাও আমাদের কালুর হাতে পরাভূত হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি।

আমদেরকে তখন প্রায়শই রাস্তায় দেখা যেত ছাগলটিকে নিয়ে “চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন” বলে স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে যেতে। হর্ষ-ধ্বনিতে ছাগলটিও দারুণ উৎফুল্ল, উচ্ছ্বসিত হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলত আমাদের সাথে। তবে লড়াই লাগাতে গিয়ে আংকেলদের অনাকাঙ্ক্ষিত দাবড়ানিও যে মাঝে-সাঝে খেতে হতো না, তা নয়। তবে ওতে আমরা দমে যেতাম না। আমাদের লড়াকু ছাগলটিও কিছু মনে করত না তাতে।

সে আসলেই প্রতিভাবান ছিল। এত ছোট একটা ছাগল কিভাবে এত বড় বড় ছাগলকে ধরাশায়ী করত, তা যে না দেখেছে, সে বিশ্বাস করবে না। ঈদের আগের দিন আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে এত চমৎকার, উচ্ছ্বল, খেলুড়ে একটি ছাগলকে কোরবানি হয়ে যেতে হবে ঈদের দিন সকালে; যদিও এই অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে নতুন ছিল না। কোরবানির আগের সেই তিন চারটে দিন আমাদের মা-বাবাদের কেনা কত গরু, কত ছাগল আমরা চড়িয়েছি মাঠে; ঘাস, খড়, ভাতের ফ্যান খাইয়েছি আদর করে; স্নেহের সাথে গলার ঝুলন্ত চামড়াটিতে হাত বুলিয়ে দিয়েছি! আর আমাদের যত্নে, আদরে গরুগুলো আকাশের দিকে চেয়ে গলাটি পেতে দিয়েছে আমাদের হাতের তালুতে। সদ্য কেনা গরুটির কাছে ছুটে যেতে সকাল পাঁচটায় উঠতে রাতে পেট ভরে পানি খেয়ে ঘুমতাম (ঘুম থেকে ভোরে ওঠার এই পন্থা এক বন্ধু বাতলে দিয়েছিল) আর ঘরে ফিরতাম চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবার পর, যদিও মাগরিবের আজানের সাথে সাথে ঘরে ফিরে না যাওয়ার শাস্তি ঘরে অপেক্ষা করে থাকত।

আমাদের আদরের সেই গরু-ছাগল গুলোকে প্রতিটি ঈদে চোখের সামনে কোরবানি হয়ে যেতে দেখা আমাদের সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই ছোট্ট, সুন্দর, আমোদী ছাগলটিকে এইভাবে জবাই করা হবে, আমরা কেন যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। রাজুদের বাসা আমাদের বাসার কাছেই হওয়ায় দৃশ্যটি আমাকে দেখতে হতো। তাই যদিও প্রত্যেকটি ঈদে আমরা বন্ধুরা নিষ্ঠুর চোখে পশু জবাই হওয়ার দৃশ্য কতক উপভোগই করতাম (কোরবানি দেখা সওয়াবের কাজ), কিন্তু সেদিন আমি ছুটে চলে গিয়েছিলাম বাসায়। আমাদের দিগবিজয়ী, আদরের ছাগল, কালুকে ওভাবে কোরবানি হয়ে যেতে, আমি দেখতে পারিনি।

http://www.notun-din.com/?p=7708

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।