শাহবাগের মোড় দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে গিয়ে ভলভো বাসের কাউন্টার থেকে বাসে ওঠার জন্য এগুচ্ছিল হাসান। রাত দশটা বেজে গেছে কখন টের পায়নি আড্ডা মারতে মারতে, আজিজ মার্কেটে গেলে এখনো কিছু পরিচিত মানুষ পাওয়া যায়। সময় পেলে সেখানেই কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাসায় ফেরে হাসান। অফিস থেকে অফিসের বাসেই ফিরে যায় বাসায়। কয়েকদিন আগে এইরকম আড্ডা মেরে বাসায় ফেরার সময় ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়েছিল হাসান।
এখনও মনের ভেতর আতঙ্কটা কাটেনি।
মোড়টার কাছে খানিকটা অন্ধকার জমে ছিল _ আম গাছের ছায়া পড়েছে লাইট পোস্টের আলো থেকে। আড্ডা ভেঙ্গে খুব তাড়াহুড়া করে হাঁটছিল বাস ধরার জন্য। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে একটা হাত এগিয়ে এলো। একটা মুখ, ঝাপসা, কি যেন বলছে, সেই ছায়া মূর্তির পাশে চার-পাঁচটা যুবকের একটা জটলা : মনে হলো আবার একটা সন্ত্রাসী ছিনতাইকারী দলের পাল্লায় পড়েছে সে _ হাতটা ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে দু'হাত পিছিয়ে গেলো হাসান।
তার যে হাতটা খানিকটা এগিয়েছিল হাত মেলাতে সেটাকে এক ঝটকায় পিছিয়ে নিয়ে গেল শরীর থেকে _ এই সব কিছু ঘটল এক সেকেন্ড সময়ের ভিতর; এই তীব্র অনিয়ন্ত্রিত শারীরিক মানসিক প্রতিবতর্ী ঘটলো মস্তিকের ভেতর নির্মিত হয়ে ওঠা একটা সাযুজ্যের কারণে। তারপরই ভুলটা ধরা পড়লো _ মুখটা চেনা গেলো _ "আরে গণি যে। " প্রচণ্ড লজ্জা পেলো হাসান।
গণিও খুব ভড়কে গিয়েছিল। তারপর ওরা খুব হাসাহাসি করল।
হাসান ব্যাপারটা চাপা দেয়ার চেষ্টা করল। সে যে তাদের সন্ত্রাসী ভেবেছিল সেটা বোঝাতে চেষ্ঠা করল। সে যে ভয়ে সরে যায়নি _ বরং আক্রমণ করতে সরে গিয়েছিল সেটা বলল। কিছুণ দাঁড়িয়ে পড়ে ওদের সাথে কথা বলতে লাগলো হাসান, অস্বস্তিটা দূর করার জন্য _ ওরা যেন বুঝে কেন সে এইরকম করলো সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল। গণির বন্ধু একজন কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ে ঘটনাটা শুনে বললো যে ব্যাপারটা সে বুঝেছে: তার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল।
গণিও বেশ সমঝদার ছেলে _ সেও একটি ভিন্ন বিষয় তুলে প্রসঙ্গান্তর করার চেষ্টা করল। মনকে ছেঁকে বিশ্রী অনুভূতিটা কাটছিল না হাসানের। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসান দ্রুত বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।
বাসে উঠে অত্যন্ত ম্রিয়মাণ বোধ করল হাসান। সন্ত্রাসীর আক্রমণের ঘটনাটা তার মনে এমন একটা স্থায়ী ছাপ ফেলেছে সে আগে বুঝতে পারেনি।
পরীবাগের মোড়ে ঘটেছিল ঘটনাটা। অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই আজিজের আড্ডা ভেঙ্গে গিয়েছিল। পরিচিত কারো তেমন একটা সমাগম হয়নি। আটটা বাজে ঘড়িতে। এই সময় বাসে খুব ভীড় হয়; টায়ার্ড লাগছিল, ভীড় ঠেলে বাসে ওঠার ধৈর্য বা শক্তি কোনটাই ছিল না, তাই একটা সিএনজি ঠিক করে তাতেই উঠে বসল হাসান।
সিগনালে থামতেই হঠাৎ ডান পাশ থেকে একটা হাত মুখ চেপে ধরল, বাম পাশ থেকে একটা কালো, কদম-ছাঁট, স্বাস্থ্যবান লোক উঠে বসল গাড়িতে। হাসান একটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গী করেছিল শরীরটা। কিন্তু লোকটা ধমকাল _ "পা সোজা কর। ছুরি দিয়া প্যাট ফাইড়া ফালামু। " হাসান ম্যানিব্যাগ বের করেছিল, কিন্তু তারপরও তারা কী যেন খুঁজতে লাগলো সারা শরীর অাঁতিপাঁতি করে _ একসময় _ বোঝা গেলো না কেন _ওদের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো প্যান্টের ডান পকেটের দিকে।
বাইরে আরো তিনটা ছেলে দাঁড়িয়েছিল _ তাদের মধ্যে পাতলা করে একটা ছেলে, তার মুখ দেখা যাচ্ছিল _ 22/23 বছর বয়স হবে, সে বলছিল ছুরি মারস না কেন ? গুলি্ল কর হালারে। মনে পড়ল হাসানের তাকে নিয়ে এই টানা-হেঁচড়ার মধ্যেই সে অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়েছিল। আর ছেলেটা যেন লজ্জা পেয়ে সিএনজির পেছন দিকে চলে গেল। লজ্জা ?!! মোটা লোকটা হাসানের কোলের ওপর বসে পড়ল, বেল্ট খুললো _ প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকালো। নুনুটা কী ধরবে, একদম নাগালের ভেতরেই সেটা।
নুনুটা কী টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে, নাকি কচ করে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলবে। হাসান ভাবে। না _ তেমন কিছু ঘটে না। হাসানের নুনুর ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় না লোকটা। এই সময় সিগন্যালটা উঠে গেলে সিএনজিটা নড়ে চড়ে ওঠে _ টান দিয়ে পকেটটা বের করে ছুরি পকেটটা কেটে নিমেষেই উধাও হয়ে যায়।
যাওয়ার সময় আতঙ্ক হলো ছুরি মারবে নাতো _ না ছুরি না মেরেই চলে গেলো ওরা। দেখলো হাসান প্যান্টের ডানপাশটা কেটে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ফেলেছে উরুটা। কখন কাটলো এদিকটা ?! শার্টটা টেনে নামালো। চারিদিকে যারা বিভিন্ন গাড়িতে ছিল, তাদের কৌতুহলী চোখগুলি খেয়াল করছিল হাসান _ কী দেখছে ওরা ? বাংলা ছবির রেইপ সীন ? তীব্র একটা ঘৃণা বোধ হলো কৌতুহলী মানুষগুলোর ওপর। ধর্ষিত নারীর বোধ হয় এমনই অনুভূতি হয় হাসানের মনে হলো।
যখন জোর করে কেউ তোমাকে, তোমার অস্তিত্বকে অতিক্রম করে তখন যে অনুভূতি হয়, সেটা বোধ হয় জড়ত্বের বোধ _ সেই জড়ত্বের বোধটা নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকে হাসান সিএনজিতে। ড্রাইভারটাকে সন্দেহ হয়। সে ভেবেছিল এই সিএনজিতে বাসা পর্যন্ত না গিয়ে সে ফার্মগেট নেমে যাবে _ তারপর নামে না ফার্মগেট _ ফার্মগেটের ওভার ব্রীজের সামনে একজন পুলিশ অফিসার দেখে সিএনজিটা থামায় _ উদ্দেশ্য ছিল দু'টি _ ড্রাইভারটাকে যাচাই করা আর ছিনতাইয়ের কথাটা বলা; ড্রাইভারটা নিঃসঙ্কোচে গাড়িটা থামানোতে সন্দেহ খানিকটা কমে হাসানের আর পুলিশ অফিসার ছিনতাইয়ের কথাটা শুনে _ ভাবলেশহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন _ কোন এলাকায় ঘটনাটা ঘটলো? হাসান পরীবাগের কথা বললে _ পুলিশ অফিসার সম্পূর্ণ মনোযোগ হারিয়ে বলেন _ ওটা আমার এরিয়াতে পড়ে নাই। হাসান পুলিশ অফিসারের হাতের ওয়াকিটকি/ওয়্যারল্যাস দেখিয়ে তীব্র স্বরে বলে ওঠে _ ঐ জিনিসটা কেন দিসে সরকার আপনাকে। আপনি ফোন করে ঐ এরিয়াতে বলেন, যেখানে একদল বদমাইশের বাচ্চা মানুষের সৎ উপার্জন শকুনের মত ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হাসান তার ছেঁড়া প্যান্ট জামা দেখাতে থাকে। কৌতুহলে দর্শকের ভীড় জমে যায় _ তারা ভদ্রলোকের বাচ্চার দুষপ্রাপ্য নগ্নতা দেখে। এ্যাতে পুলিশ অফিসারটা বোধহয় খানিকটা বিচলিত হয়। সে বলে "আমি ঐ এরিয়াতে কথা বলছি ...... আমরা ইয়ং অফিসাররা চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী ধরতে। " হাসান খেয়াল করে ভাবলেশহীন পুলিশ অফিসারটার শীতল নি:সার চোখদুটো কর্তব্য নিষ্ঠার তেজে একটুখানি যেন জ্বলে উঠতে চায়।
হাসান যেন একটু ভরসা পায়, সব পুলিশ তো আর বেখেয়াল আর অসৎ নয় _ কেউ কেউ তো জীবন দিয়েও লড়ে। অাঁচল ছেঁড়া বিশ্বাস আর আস্থার নিরাপদ বিশ্বটার আভাস যেন আবার দেখা দিতে থাকে। সেই সিএনজিতেই হাসান বাসায় ফিরে আসে।
কিন্তু এই ছিনতাইয়ের ঘটনাটা দু'সপ্তাহ আগের ঃ তারই প্রতিবতর্ীতে আজ যে ঘটনাটা ঘটলো তা যেন ক্রমাগত: ছোট করে দিতে থাকে হাসানকে। সে এ্যাত ভীত হয়ে পড়েছে।
ভেতরে ভেতরে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এ্যাত আতংক।
ছিনতাইয়ের পর হাসানের মনে হয়েছিল _ একটা লোহার শক্ত রড যদি থাকত! ছিনতাইকারীগুলিকে জান-প্রাণ দিয়ে পিটিয়ে ছেঁচে ফেললে মনে শান্তি আসতো। ভয়ানক প্রতিহিংসা জেগেছিল মনে। এরপর জুডো-কারাতে শেখার কথা মনে এসেছিল ঃ অর্থাৎ আত্মরক্ষার একটা পথ ভাবছিল হাসান। আক্রমণ প্রতিহত করার কোন হাতিয়ারই নেই তার।
সম্পূর্ণ বর্মহীন সে ঘুরছে এই শহরে। ছিনতাইয়ের ঘটনাটা তাকে যেন তীব্র শৈত্য প্রবাহে ন্যাংটা করে দাঁড়িয়ে দিয়েছে। তার চেতনার মধ্যে তৈরী হলো শীত-প্রতিরোধী উষ্ণ পোষাক সংগ্রহের আকূলতা।
আত্মরক্ষা একটা জৈবিক চেতনা। জগতের সব প্রাণীর মধ্যেই আছে _ কেউ আত্মরক্ষার জন্য সুনিপুণ অস্ত্র তৈরী করেছে বিবর্তনের পথে ঃ থাবা আছে, ধারালো দাঁত আছে কারো।
আবার এক রকম মাছ আছে যার আছে বিদু্যতের চাবুক। কারো আছে বিশ্রী গন্ধ। আবার কেউ পালায় দ্রুত _ কেউ রং বদলায়। হাসান এইসব প্রাণীদের মত কী অস্ত্র ধারণ করবে? মহিষকে যখন সিংহ আক্রমণ করে _ মহিষ শিং বাগিয়ে প্রতিআক্রমণ করে আর হরিণ ধুলো ছুটিয়ে পালায়। হাসানের আক্রমণের কোন হাতিয়ার নেই _ ভীত হয়ে পালানো ছাড়া হাসানের মনে হয় তার কাছে কোন অস্ত্র নেই।
সে পালাবে। গণি বলছিল, হাসান ভাই তুমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাও। গণি সেদিন এই কথাটা কী এইজন্যই বলছিল ?
হাসান বাসে যেতে যেতে মনে মনে ঠিক করে _ সে পালাবে। কানাডায় ইমিগ্রেশনের অনেক কাগজ সে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছে। সেই কাগজগুলি দিনে দিনে গুছাতে হবে _ সিংহের রাজ্যে মুষিক হয়ে বাঁচা, ভীত ইঁদুর ছানা হয়ে বাঁচা তার প েকঠিন।
এই দেশে বাঁচতে হলে অস্ত্র ধারণ করে, লক্ষবেধের ট্রেনিং নিয়ে বাঁচতে হবে। অথবা ঈশ্বরচন্দ্রের বাবার মত মানুষ সমান উঁচু পাকা লাঠি নিয়ে ঘুরতে হবে, হাসান শুনেছে তিনি সেই লাঠি নিয়ে ডাকাতের রাজ্যে নিঃসংকোচে হেঁটে বেড়াতেন, একবার হিঃস্র এক ভালুককে নাকি পিটিয়ে খতম করে দিয়েছিলেন _ ইছামতীর তীরে। তেমন লাঠি চাই, তেমন লাঠি ঘুরানো চাই। অথবা পালানো চাই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে হাসান।
আর সেই সাথে মনে মনে প্রগতিশীল রাজনীতি করা বন্ধুদের অট্টহাসিও শুনতে পায়। "হেসোনা বন্ধুরা _ আমি বলছি শোন _ আমি একটু পুশি ক্যাট, আমি সর্বংসহা উট নই, এভাবেই আমাকে বড় করা হয়েছে," হাসান মনে মনে বলে। হাসান ভাবে _ কিন্তু ওরা কী পারবে সিংহের সাথে লড়তে _ ওদের তৃণভোজী স্বভাবে কী ধারালো শিং-এর লড়াকু চেতনা তৈরী হবে। লড়তে লড়তে মরার মত ধারালো শিং কী আছে ওদের অথবা বানরের মত সংঘ শক্তি। হাসানের মনে হয় _ একা যারা তারা পারবে না _ যারা প্রতিদিন নিরাপদ চাকরি করে নিরাপদ বাড়ি ফেরে তারা পারবে না, যারা দল বাঁধে _ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে টিয়ারগ্যাস খায়, তারা ঘৃণ্যকে শালা বলে লাথি মারতে পারে, যারা নিরাপদ ছিঁড়ে বিপদগ্রস্ত হতে পারে, যারা ইট-পাটকেল নিয়ে দাঁড়াতে পারে অটোমেটিক মেশিনগানের সামনে, তারা পারবে _ যারা শেখেনি সংঘবদ্ধ হয়ে লড়তে তাদের পালাতে হবে; এ-ও আত্মরক্ষারই একটা কৌশল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।