দাদা,
একবার সেই রথের মেলায় নিয়ে যাবে? লুকুমদানা (নকুলদানা) খাব। কতদিন যে খাইনা! উফফ্ খুউব খেতে ইচ্ছে করছে। সেই যে কবে- ছোটবেলায়, যতীন কাকুর ডালি থেকে একপাটা লুকুমদানা হাতে নিয়ে বলতে- কাকু, এটা ঠোঙ্গায় ভরে শ্যাজাকে দিয়ে দিও। দুআনার লুকুমদানা পেয়ে খুশীতে ডগমগ সেই আমি, বেণী দেলোতে দোলাতে এক দৌড়ে বাড়ী ফিরতাম।
শুনতে পেতাম যতীন কাকু পিছন থেকে বলছে, পাগলী মেয়ে! দাঁতে পোকা হবে সে ভয় নেই! লুকুমদানা, কদমা, প্যারা, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই সবই তার চাই।
দাদাবাবু আমায় কত নিষেধ করে, বকা দেয়। দুষ্টু মেয়ে ওসব কথা কী কানে তোলে! আমি কাকুর দিকে তাকিয়ে কখনও চোখ পাকাতাম, কখনও খিলখিলিয়ে হাসতাম। বলতাম, ডালিতে ওসব সাজিয়ে রেখেছো কেন তবে! দেবে না মানে! পয়সা দিইনা বুঝি! যতীন কাকু অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাত। বিড় বিড় করে বলতো, না দিয়ে কী উপায় আছে! দাদাবাবু শুধু শধু আমাকে শাসায়! আদরের বোনকে কিচ্ছু বলবে না।
দেখতে দেখতে সেই আমি একদিন বড় হয়ে গেলাম।
বিয়ে দিয়ে দিল দাদা তার এক পছন্দের ছেলের সাথে। দেশের বাড়ী এপাড়ে হলেও থাকে কোলকাতা। বিয়ের পর চলে এলাম ওপাড় ছেড়ে এপাড়ে। যতীন কাকু আজ হয়তো বেঁচে নেই। হারিয়ে গ্যাছে তার সেই লুকুমদানা।
চিনির গাঁদে বাদাম দেয়া বরফি আর পাপড়ির মত কী যেন সব পাওয়া যায় লুকুমদানার মত। তবে স্বাদটা অন্যরকম। যতীন কাকুর সেই লুকুমদানা কোথাও খুঁজে পাই না।
সেই যে পঞ্চবটির মাঠ। ছড়ানো ছিটানো পাঁচটা বট গাছ ছিল মাঠ জুড়ে।
তাইতো লোকে বলতো পঞ্চবটির মাঠ। সেই মাঠের একপাশে নদীর গা ঘেঁষে ছিল একটা শশ্মানঘাট। আজকাল ওটা নাকি ঈদগাহ্ মাঠ হয়ে গ্যাছে। সেখানে আর আগের মত রথের মেলা বসেনা। আলুপট্টির মোড়ে আজকাল আর ভাজেনা সেই কালিজিরা দেয়া মুচমুচে পাঁপড়।
পদ্মার সেই বাঁধে শ্যাজা আর দৌড়ে আসেনা, যায়না যতীন কাকার খোঁজে। আজ আর শ্যাজার পিঠে সেই দোলানো বেণী নেই। শ্যাজার দাঁতে এখনও পোকা ধরেনি বটে, তবে আজকাল পান খায় সে ঠেসে, সখ করে। চিঠির পরে চিঠি লিখি প্রতি মাসে মাসে। অভিযোগ করে দাদা, তুমি আগের মত উত্তর দাওনা নিয়মিত।
দাদা, এবার দেশে ফিরলে আমায় কোন মেলায় নিয়ে যাবে? যতীন কাকুর সেই লুকুমদানা আজও আমার খেতে সাধ হয়। আর কী তা কোথাও যায়না পাওয়া, কোনখানেই? দেখবে খুঁজে? পেলে জানিও। স্বামী সংসার নিয়ে দিব্বি সুখে আছি। পাল্কীতে করে সব সুখতো সেই কবেই একজনের সাথে করে দিয়ে দিয়েছিলে। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তোমাদের ছেড়ে আসার কষ্ট, রক্তের বাঁধন ছিঁড়ে চলে যাবার কষ্ট।
সব মিলিয়ে বুকে এক ধরণের হাহাকার নিয়ে চলে এসেছিলাম। এসব কষ্ট থিতু হতে অনেক সময় লেগেছিল। জীবনের প্রথম পাল্কীতে চড়ার অনুভূতি আজও একবিন্দু ভুলতে পারিনি। পাল্কীতে চড়ার স্মৃতি আমার জন্য মোটেও সুখকর কিছু নয়। সবরকম পিছুটান জলাঞ্জলী দিয়ে চলে এসেছিলাম তোমাদের ফেলে।
কিন্তু কী আশ্চর্য তোমার সেই লুকুমদানা কিনে দেবার স্মৃতিটা কেন জানি ভুলতে পারিনা। বেঁচে আছি ওই স্মৃতিটুকু বুকে নিয়েই। ইতি।
-শ্যাজা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।