বুলু মিয়া। পাগলা একজন বংশীবাদক। বাঁশী বাজানো ছাড়া তাঁর জীবনের আর অন্য কোন লক্ষ নাই। কখনো ছিলও না। ছোটবেলা থেকে দেখছি বুলু মিয়ার এক হাতে বাঁশী অন্য হতে আধখাওয়া বিড়ি।
বিড় বিড় করতে করতে আপন মনে হেটে বেড়াচ্ছে। কোন একটা চা দোকানের সামনে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় যদি তার চায়ের তৃষ্ণা পেত তাহলে সেখানেই দাড়িয়ে পড়ত। দোকানের ভিতরে উকি দিয়ে দেখতো বহিরাগত কোন নতুন মানুষ আছে কিনা। থাকলে তার পাশে গিয়ে বসে সালাম দিত। তারপর কোন কথা না বলে বাঁশী বাজানো শুরু করত।
বুলু মিয়ার বাঁশী শুনে অপরিচিত ভদ্রলোক মুগ্ধ হলেও দোকানদার বড়ই বিরক্ত হত। বাঁশি বাজানো শেষ হলে বুলু মিয়াই আগে কথা শুরু করত।
'মিয়া ভাই কী চা খান? আরেকটা চায়ের অর্ডার দেনতো দেখি। গলাটা শুকাইয়া গেছে। চা খাইয়া আরেকটা সুন্দর দেইখা গান বাজাবো।
চায়ের লগে দুই টেহার বিড়িও দিতে কইয়েন। '
চা- বিড়ি পাওয়ার পর বুলু মিয়া আর এক মূহুর্ত সেখানে দাড়াতো না। চা খাওয়ার পর যে একটা গান বাজানোর কথা সেটা সে ভুলে যেত। কেউ কেউ তাঁর চালাকি ধরে ফেলে বলত। ' আগে বাঁশীর বাজনা শেষ কর তারপর চা-বিড়ি পাইবা।
' চায়ের আশায় বাধ্য হয়ে বুলু মিয়া আবারো বাঁশীতে ফুক দেয়।
এভাবেই চলে যায় বুলু মিয়ার জীবন। জীবনে কোন কিছু করতে হবে সেই ভাবনা কোন কালেই তাঁর ছিলনা। কষ্ট করে টাকা-পয়সা উপার্জন করার কোন মানে হয়? সবই হবে একদিন। টাকা হবে।
বাড়ি হবে। গাড়ি হবে। এখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।
বুলু মিয়া যেদিন থেকে বাঁশী বাজানো শুরু করেছে সেদিন থেকে সে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে কোন একদিন তাঁর বাঁশীর সুর শুনে পরীস্থান থেকে পরী নেমে আসবে। পরীকে কোন রকমে বাঁশী শুনিয়ে খুশি করতে পারলেই হল।
পরীরাই তাকে টাকা-পয়সা, সোনা-জহরত দিয়ে যাবে।
কৈশোর যৌবন পেড়িয়ে বুলু মিয়া এখন বার্ধক্যের কাছাকাছি। এখনো সে তাঁর বাঁশীর সাধনা করে যাচ্ছে। এখনো সে বিশ্বাস করে- কোন একদিন তাঁর বাঁশীর যাদুকরী সুর এই পৃথিবী ছাড়িয়ে পরীস্থানে গিয়ে পৌছবে। পরীরাজকন্যা অপূর্ব সেই সুর শুনে পাগল হয়ে যাবে।
তারপর তার সখীদের নিয়ে উড়াল দেবে পৃথিবীর পানে।
দীর্ঘদিন পর বুলু মিয়ার সাথে দেখা। কয়েকজন বন্ধু মিলে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় বুলু মিয়া পাশে এসে দাড়াল। এক হাতে বাঁশী অন্য হাতে আধাখাওয়া বিড়ি। হাত ইশারায় সালাম দিয়েই পাশে বসে পড়ল।
বলল ' মিয়া ভাই কী বিদেশ থাইকা আইছেন?'
'হুম। কী করে বুঝলেন?'
'বুঝা যায়। বুঝা যায়। কত বিদেশি দেখলাম!'
বুলু মিয়া আমার সামনে রাখা চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে বলল 'মিয়া ভাই কী চা খাইতাছেন?'
'হ্যা। আপনি খাবেন এক কাপ?'
'দেন অর্ডার এক কাপ।
দুই টেকার বিড়িও দিতে কইয়েন। '
বুলু মিয়া হাতের বাঁশিটা মুছতে মুছতে বলল 'বাঁশী হুনবেন?'
'হুম শুনব। '
বুলু বাঁশী বাজাতে শুরু করল।
"আমায় এতো রাতে- কেন ডাক দিলি
প্রান কোকিলারে.....। "
আমি হাত ইশারায় থামতে বললাম।
'কি বাজাচ্ছেন এসব! এতো দারুন একটা গানের কি করুন অবস্থা!'
বুলু মিয়া লজ্জিত কণ্ঠে বলল ' বয়স অইছে না মিয়া ভাই। অহন আর আগের মত বাজাইতে পারিনা। তিনটা দাতও পইড়া গেছে। '
বুলু মিয়া তার দাত দেখাল। আসলেই তাঁর দাত পড়ে গেছে।
'মিয়া ভাই এই জীবনে কিছুই আর চাওয়ার নাই। একটাই আপসোস সরাডা জীবন বাঁশী বাজাইলাম একটা পরী নামাইতে পারলাম না! মরনের পর আমার উস্তাদ যদি জিগায় পরী নামাইছস কয়বার? তহন কী জবাব দিব চিন্তায় আছি। '
আমি কৌতোহল নিয়ে বুলু মিয়ার দিকে তাকালাম। সে আসলেই চিন্তাযুক্ত। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বুলু আবারো বলতে শুরু করল ' উস্তাদ একটা কথা কইছিল- বুলু।
জীবনে কোনদিন লোভ করবিনা। লোভের কথা চিন্তাও করবিনা। পরীগো কাছে কিছু চাইবিনা। তেনারা যদি খুশি হইয়া কিছু দেয় নিবি। '
বুলু দীর্ঘশ্বাষ ফেলে একটা বিড়ি ধরালো।
তারপর কাউকে কিছু না বলে দোকান থেকে বের হয়ে গেল। আমি তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। সেদিন তাঁর চোখে আমি তীব্র অপরাধ বোধের ছায়া দেখেছিলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।