পুরো নাম কি আপনার? লেখেন মোঃ লাবু মিয়া। এই সব নাম লেইখা আর কাগজে ছাপায়া কি হইবো? কেন কি হয়েছে আপনার? যার জমি জিরত বাপ-দাদার ভিটে মাটি সরকার কাইর্যা নেয়, হের কথা শুইনা মানুষের কি লাভ? দ্যাশের সরকারই তো আমার কোন কথা হুনছে না। আমি মইরা যাবো ভাই, মইরা যাবো। এই শিল্পীরে আর পাইবেন না।
চারুকলা ইন্সটিটিউটের ঠিক পাশেই ফুটপাতের দেয়াল ঘেষে কয়েকটা বাঁশি।
তার পাশেই চটের বস্তার উপর বসেন মোঃ লাবু মিয়। এটিই তাঁর দোকান। বাড়িতে বসে বাঁশি বানান আর এখানে এসে সেই বাঁশি বিক্রি করেন লাবু মিয়া। একেকটা বাঁশি ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। আর টিউনিং করা বাঁশি গুলো একটু চড়া দামেই বেচেন।
জানেন ভাই আমার এই হাতে বানানো বাঁশি বারী সিদ্দিকীও বাজায়। কিন্তু অহন আর পারি না ভাই। কেন এখন আর পারেন না? পাশে জড়ো হওয়া মানুষদের মাঝ থেকে একজন গলা বাড়িয়ে উঠেন। তিনি আর কেউ নন। চিত্র শিল্পী গৌতম ঘোষ।
লাবু মিয়ার বন্ধু তিনি। গৌতম ঘোষ বলেন, ‘ যখন বাপ-দাদার ভিটে মাটি সরে যায় তখন আর কিছুই করার থাকেনা। একজন শিল্পীর ঘর হলো তার সাধনার জায়গা। বিগত জোট সরকারের আমলে তাঁর সব সম্পত্তি সরকার খাস জমি হিসেবে দখল করে নেয়। এখন অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকে সে।
সেখানে বাড়িওয়ালা বাঁশি বানাতে দেয়না। তাই তাঁর উপার্জনের পথটুকুও এখন প্রায় বন্ধ। মামলা চলছে। টাকার অভাবে মনে হয় তাতেও হেরে যাবে। ’
আবার লাবু মিয়াকে প্রশ্ন করি।
বাসায় কে কে আছে? ‘বুড়া বাপ আছে, মোঃ ফেকু মিয়া। ১১১ বত্সর বয়স। পরথম বিশ্ব যুদ্ধের ছোলজার আছিল, মুক্তিযুদ্ধও করছে। ’ এছাড়াও স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে, ভাই-ভাবী ও ভাগ্নিকে নিয়ে তাঁর বিশাল সংসার। লাবু মিয়ার ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা করছে।
একমাত্র ভাগ্নিকেও তিনি লালন পালন করেন। ভাগ্নিকে ঢাকা ভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজীতে পড়ান লাবু মিয়া।
৮৮’র বন্যার পর থেকেই চারুকলার এই ফুটপাতে বসেন লাবু মিয়া। সাত সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে বসে দু’একটা বাঁশি বানান। এর ফাঁকে এক ছাত্রকেও বাঁশি বাজানো শেখান তিনি।
তারপর সোজা এই চারুকলার ফুটপাত। রাত ১০ টায় বাড়িতে ফিরে বৃদ্ধ বাবা ও সন্তানদের নিয়ে ভাগ্যে যা ডাল ভাত জোটে তাই খান লাবু মিয়া।
আপনার স্ত্রী কি এসব কারণে রাগ করে? ‘নারে ভাই। বউডা খুব ভালা। কিছুই চায়না আমার কাছে।
আমার জন্যে খোদার কাছে দোয়া করে। যাতে কইরা আমার কামাই বাড়ে, সুখ হয়। তারপরও সারা রাইত ঘুম অয় না ভাই। খালি আজগুবি চিন্তা মাথার মইধ্যে ঘুরপাক খায়। ক্যামনে এ সংসার চালামু, বাচ্চাদের খাওয়ামু পড়ামু এইসব চিন্তা।
ভাইবা কূল পাইনা। একবার ভাবি মইরা যাই। কিন্তু তহন বাচ্চাদের দেখব কেডা?’
১৯৭৫ সালের পর থেকে বাবা ফেকু মিয়ার কষ্ট লাবু মিয়াকে বেশ ভাবাতে থাকে। তাঁর বাবাও বাঁশি বানাত। তারপর দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়েই হাতে তুলে নেন বাবার দেয়া বাঁশি।
সেই থেকে আজ অবধি এই বাঁশি নিয়েই আছেন তিনি। এই বাঁশিই যেন তাঁর নেশা, ধ্যান জ্ঞান সব কিছু। এর মাঝেই লাবু মিয়া প্রকৃত সুখ খুঁজে পান।
‘এক সময় ট্যাকনাফ থেইকা তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বাঁশি বাজায়া বেড়াইতাম। সারা দেশের ম্যালায় ম্যালায় বাঁশি ব্যাচতাম।
বিদ্যাশও গেইছি কয়েকবার। ’
বিদেশ যাওয়ার টাকা পেলেন কোথায়?
‘কি যে বলেন ভাই। শিল্পীর আবার ট্যাকা লাগে নাকি? বিএসএফ’রা আমার বাঁশি শুইনা ভারতে পাঠায় দিছিল। তারপর এই ভাবেই সেই খান থাইকা কাশ্মির আর পাকিস্তান। সেই হানে ওসতাদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লগে কথা কইছি।
তাছাড়াও সেই খানে ওসতাদ সালামত হোসেন খানের কাছে বাঁশি বাজাইনা শিখছি। ’
এখন মুধু আগের বানানো বাঁশি গুলোই বিক্রি করেন লাবু মিয়া। মাঝে সাঝে দু’একটা বাঁশি বানান। তাঁর আর এখন কিছুই ভালো লাগে না। বাঁশিও বাজান না আর আগের মতো।
‘আমি মনে অয় আর বাঁচতে পারমু না ভাই। ট্যাকার অভাবে বাচ্চাদেরও মনে অয় মানুষ করতে পারমু না। আমার ব্যবসাটাও তো নষ্ট হইয়া যাইতাছে। সরকারের কাছে কি ভাই আমার বাপের ঐ ভিটে মাটি চাওয়াটা অন্যায়? আমারে তো আপনেরা ভালোবাসেন, তয় আমার এই সাধনার জায়গাটা কাইর্যা নিলেন ক্যান? এই দ্যাশে কি আমার কোন অধিকার নাই?’ লাবু মিয়ার এই আর্তনাদ যেন বার বার প্রতিধ্বনি হয়ে কানে এসে ধাক্কা লাগে।
‘বাঁশি শুনবেন ভাই? আইজ অনেক দিন পর বাঁশি বাজামু।
’
না করতে পারি নি। ঠিক আছে শোনান।
লাবু মিয়া চোখ বন্ধ করে বাঁশি বাজায়-
‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে,
ওগো বন্ধু সুখে থেকো সুখে থেকো। ’
বুঝতে পারি লাবু মিয়ার চোখের কোণে জল ছলছল করে উঠে। ভাবতে থাকি।
যদি নগরীর এই বংশীবাদকটির জীবনও সোনার আলোয় ভরে উঠতো! ভাবতে ভাবতে সামনে এগোতে থাকি। জল চোখে লাবু মিয়া ছোট্ট শিশুর মতোন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।