গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত বিশ্ব আলোড়িত একটি বাঁধ “ফারাক্কা বাঁধ” । ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে পলি জমা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । এই পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয় । ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় । শেষ হয় ১৯৭৫ সালে ।
সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে এই বাঁধ চালু করা হয় ।
ভারত তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যে বাঁধ তৈরি করে নিয়েছে ঠিকই; কিন্তু আমাদেরকে ঠেলে দিয়েছে সীমাহীন হুমকির মুখে । বাঁধ নির্মাণের পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহুবার ভারতের সাথে পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছে । দুঃখের ব্যাপার হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্যকারী এই মিত্র দেশটিকে আমাদের স্বাধীনতার পরে তাদের মিত্র রূপের চাইতে বৈরী রূপেই বেশি দেখা গেছে ।
ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে সুষম পানি বণ্টনের নিমিত্তে দু’দেশের মধ্যে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৬ মে, ১৯৭৪ সালে ।
চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী । এ চুক্তির মাধ্যমে বাঙলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতকে দেয়া হয়েছিল এবং একই সঙ্গে ভারত পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার প্রশ্নে বাঙলাদেশের সম্মতি । চুক্তি অনুযায়ী, সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্ত পানির ব্যাপারে পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য বণ্টন-সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য ভারত পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে । সে অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালে ৪১ দিনের জন্য (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত) ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল । কথা ছিল, ৪১ দিনের নির্ধারিত সময়ে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেল দিয়ে হুগলী নদীতে নিয়ে যাবে ।
কিন্তু ৪১ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাঙলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যায় । ফলে বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয় । ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়ায় বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সর্বনাশের অধ্যায় সূচীত হয় ।
এহেন সংকটময় মুহূর্তে আরও একবার দিকভ্রান্ত জাতির হাল ধরেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী । ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ৯৬ বছর বয়স্ক এই নেতা ‘ফারাক্কা মিছিল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ।
কতো বড় দেশপ্রেমিক হলে জীবনের সায়াহ্নে এসেও মানুষ এমন কর্মসূচীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণসহ উদাহরণ এই নেতা ! ১৯৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের কন্যা হিসেবে সম্বোধন করে মাওলানা ভাসানী লিখেন – “আমার আন্তরিক আশা, আপনি স্বচক্ষে দেখিলেই ইহার আশু প্রতিকার হইবে এবং বাঙলাদেশ ও হিন্দুস্থানের মধ্যে ঝগড়া-কলহের নিষ্পত্তি হইয়া পুনরায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব কায়েম হইবে । ফারাক্কা বাঁধের দরুণ উত্তরবঙ্গের উর্বর ভূমি কীভাবে শ্মশানে পরিণত হইতেছে তাহাও স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন । ” এই চিঠির উত্তর আসে ৪ মে । ইন্দিরা গান্ধী লিখেন – “এ কথা কল্পনাও করা যায় না যে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাঙলাদেশে নিজের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে দুঃখ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে শরীক হয়েছেন, সেই তিনি এখন কিভাবে এতটা মারাত্মকরূপে আমাদের ভুল বুঝেছেন ! এমনকি প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে । ” ১৫৬ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ পরিত্যাগ করা সম্ভব নয় জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী মাওলানা ভাসানীকে লিখেন – “আমার মনে হয়, বাঙলাদেশের উপর ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনাকে অত্যন্ত অতিরঞ্জিত এবং শুধু একটি দিকের তথ্য জানানো হয়েছে ।
আপনি যদি চান তাহলে আমাদের হাই কমিশনার নিজে গিয়ে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির অন্য পিঠ সম্পর্কে অবহিত করবেন । ” চিঠির শেষাংশে ইন্ধিরা গান্ধী লিখেন – “আমি আপনাকে আশ্বাস দিয়ে বলতে চাই, যে কোনো যুক্তিসঙ্গত আলোচনার জন্য আমাদের দরজা খোলা থাকবে । কিন্তু কারো এ কথা মনে করা উচিৎ নয় যে, ভারত কোনো হুমকি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে । ” এই ছিলো আমাদের মিত্র দেশের জবাব !
জবাবে ইন্দিরা গান্ধীকে মাওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, “পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমি আপনার মনোভাবের প্রশংসা করি । কিন্তু সে সমাধান হতে হবে স্থায়ী ও ব্যাপকভিত্তিক ।
এই সমাধান শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য হলে চলবে না, বছরব্যাপী পানির প্রবাহ একই পরিমাণ হতে হবে । ” ফারাক্কা মিছিলের একটি সমাবেশে ভাসানী বলেন, “ভারত সরকার পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ন্যায্য অধিকারের উপর হামলা চালালে বাঙলাদেশের আট কোটি মানুষ তা জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে । ” মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ মিছিল ফারাক্কা অভিমুখে কানসাট পর্যন্ত গিয়ে থেমেছিল বাঙলাদেশের সীমানার ভেতরেই । এই মিছিলের আতঙ্কে ভারত সরকার রীতিমত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “বাঙলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে, তখন তাদের অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত । ” ভারতপ্রেমীরা তাদের এই ধরণের মনোভাবকে কোন যুক্তিতে বন্ধুসুলভ বলবেন ?
আমরা নিজেরা যখন ব্যর্থ, তখন এই বিষয়টির আশু সুরাহার জন্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পেশ করা হয় ।
জাতিসংঘের আদেশক্রমে বেশ কয়েকবার মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন পর ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’ । আংশিকভাবে হলেও স্বীকৃত হয়েছিল গঙ্গার পানির ওপর বাঙলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও অধিকার । বাঙলাদেশের অনুকূলে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল চুক্তিটির উল্লেখযোগ্য বিষয় । চুক্তি অনুসারে বাঙলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে । ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের জন্যে আরও একটি চুক্তি করে ।
১৯৮৫ সালের নভেম্বরে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয় । কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাঙলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি । কোনো চুক্তি না থাকায় ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়, ফলশ্রুতিতে বাঙলাদেশের নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে । ১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ভারত বাঙলাদেশকে সমান পরিমাণ পানি দেবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে । ফলে এরপর দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে আর কোনো বৈঠক হয়নি ।
১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে বাঙলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রীজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো । ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাঙলাদেশেকে দেওয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন । অবশেষে, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের হায়দারাবাদ হাউজে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেব গৌড়া এবং বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ নিজ দেশের পক্ষে ৩০ বছর মেয়াদি ‘গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি’ সই করেন ।
পানি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত কোন বছরেই বাঙলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি । ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত এই চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন বাঙলাদেশের পানির হিস্যা হচ্ছে ৬৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক, দ্বিতীয় ১০ দিন ৫৭ হাজার ৬৭৩ কিউসেক এবং শেষ ১০ দিন ৫০ হাজার ১৫৪ কিউসেক ।
কিন্তু এই সময়ে বাঙলাদেশ পেয়েছে যথাক্রমে ৪৬ হাজার ৭২০ কিউসেক, ৩৭ হাজার ২০৪ এবং ৩৫ হাজার ৪৮ কিউসেক । গঙ্গা চুক্তির সংলগ্নি-১ এর পানি বণ্টন ফর্মূলা অনুযায়ী ফারাক্কায় ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি প্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি এবং অবশিষ্ট পানি বাঙলাদেশ পাবে । প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে উভয় দেশ সমান সমান পানি পাবে । প্রবাহ ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক হলে বাঙলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক এবং অবশিষ্ট পানি ভারত পাবে । এছাড়া ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রবাহ যাই থাকুক উভয় দেশ ১০ দিন পর পর গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে ।
অর্থাৎ বাঙলাদেশ ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল এবং ২১-৩০ এপ্রিল গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫ হাজার পানি পাবে । ভারত ২১-৩১ মার্চ, ১১-২০ এপ্রিল এবং ১-১০ মে গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫ হাজার কিউসেক পানি নেবে । এতো কিছুর পরও ভারত আমাদের কখনোই প্রাপ্য পানিটুকু দেয়নি ।
এর ফলে পদ্মা নদীবেষ্টিত ৬টি জেলার অন্তত ২ কোটি মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনার সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ।
এদিকে পদ্মার অবস্থা খুবই করুণ । ন্যূনতম পানির প্রবাহ নেই । হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১১টি পিলারই শুকনো চরে দন্ডায়মান । যে ৪টি পিলার পানিতে রয়েছে তার আশপাশে চিনা বাদামসহ বিভিন্ন মওসুমী ফসল মানুষ চাষাবাদ করছে । ব্রীজের নিচে এখন ভ্রমণ পিপাসুদের পিকনিক স্পট ! এছাড়া পানি না থাকায় নদীতে মাছ নেই ।
জেলেরা নৌকা দিয়ে জাল টেনে নিজেদের খাবারের মাছও যোগাড় করতে পারছে না । ফারাক্কার প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ৫৪টি নদী শুকিয়ে গেছে । শুষ্ক মওসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে । হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পথে বসে গেছে । বৃষ্টিপাতের অপ্রতুলতার কারণে প্রতি বছরই নলকূপে বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে ।
এইভাবে চলতে থাকলে একদিন নলকূপে পানি ওঠাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে; উত্তরাঞ্চল হয়ে যেতে পারে ‘বাঙলার মরুভূমি’ !
২০১১ সালের জুন মাসে একটি এবং ডিসেম্বর মাসে আরও একটি লকগেট ভেঙে যাওয়ার ফলে বাঙলাদেশে চুক্তির চাইতে কিছু বেশি পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় । ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাথে এই ব্যাপার নিয়ে বৈঠকও করেন । বৈঠকে মমতা ব্যানার্জী অভিযোগ করেন, ফারাক্কা বাঁধের দুটি লকগেট ভেঙ্গে যাওয়ায় চুক্তির থেকেও বেশী পরিমানে পানি বাঙলাদেশে প্রবাহিত হচ্ছে এবং তাতে পশ্চিমবঙ্গের সমূহ(!) ক্ষতি হচ্ছে । বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেছেন বাঙলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির ফলে ভারত আর তার রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে । কিন্তু, তিনি বলেন, ভারত-বাঙলাদেশ সম্পর্কের কথা ভেবে তিনি মেনে নিয়েছেন ।
বিদ্যুৎ দপ্তরের একটি রিপোর্টে বলা হয়, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ফারাক্কা আর সাগরদিঘীর দুটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভাগীরথীতে নৌচলাচল, পানীয় জল সরবরাহ সহ বিভিন্ন পরিসেবা ব্যাহত হবে । কলকাতা বন্দরেও নাব্যতার সমস্যা হবে । রিপোর্টে আরও মন্তব্য করা হয়, “শুধুমাত্র বাঙলাদেশকে জল উপহার দিতে পরিকল্পনা মাফিক ম্যানমেড ডিজাস্টারের দিকে পশ্চিমবঙ্গকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে !” ‘ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি’ অর্থাৎ অপরাধী চক্রান্তের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি ঐ রিপোর্টে । এই না হলে ভারত আমাদের বন্ধু ! অন্যদিকে, বাঙলাদেশ নদী কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, ফারাক্কা দিয়ে চুক্তির বেশি পানি এলেও জলাধার না থাকায় তাতে বাঙলাদেশের কোন লাভ হচ্ছে নাহ ।
ভেবে অবাক হই, আমাদের প্রাপ্য পানিকে তারা ‘উপহার’ হিসেবে অবহিত করেছে ! এটা কি উপহার ? না, প্রাকৃতিক এবং আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী এই পানি আমাদের প্রাপ্য ।
আরও একটা কথা ভেবে অবাক হই, তারা শুধুমাত্র একটি মৌসুমে অল্প কিছু পরিমাণ পানি কম পেয়েছে বলে এই নিয়ে এতো হা-হুতাশ শুরু করে দিয়েছে । এমনকি আমাদেরকে দোষারোপ করার সুযোগটাও হাতছাড়া করছে নাহ । অপরদিকে আমরা যে সেই ১৯৭৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ন্যায্য পানিটুকু পাইনি, সেটা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই !
আমরা ভাত খাওয়ার সময় পেঁয়াজ/মরিচ খাই । এইগুলো অত্যাবশ্যকীয় কিছু নয়, না খেলেও চলে । ভারত হচ্ছে ঠিক এই পেঁয়াজ/মরিচের মতোই ।
১৯৭১ সালে তাদের সাহায্য অত্যবশ্যকীয় ছিলো নাহ । তাদের সাহায্য না পেলে যে আমরা কখনোই স্বাধীন হতে পারতাম নাহ এই কথা ভাবার কোনো অবকাশ নেই । আমরা ঠিকই স্বাধীন হতাম; হয়তো আরও একটু দেরিতে হতাম । কিন্তু ঐ যে, পেঁয়াজ/মরিচে কামড় দেয়া আমাদের জাতিগত স্বভাব ! সেই যে কামড় বসিয়েছি, আজও তার ঝাঁঝ আমাদের কাবু করে চলছে ।
একদিন রাস্তা দিয়ে চলার সময় এক লোক একটি হাতিকে দেখতে পেলো যা একটি নামমাত্র দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো ।
লোকটি খুব অবাক হলো । মাহুতকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ঠুনকো দড়িটা হাতির জন্যে কিছুই নাহ । তারপরও হাতিটি দড়িটা ছিড়ছে না কেনো ?” মাহুত জবাব দিলো, “ হাতিটা যখন ছোট ছিলো, তখন এই দড়িটাই তার জন্যে যথেষ্ঠ ছিলো । অনেক চেষ্টা করতো দড়িটা ছেড়ার জন্যে, কিন্তু পারতো নাহ । একদিন নিজে থেকেই দড়ি ছেড়ার চেষ্টা বন্ধ করে দিলো ।
সে বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে সে কখনোই এই দড়িটা ছিড়তে পারবে নাহ । তার ঐ বিশ্বাসই তাকে এই দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে । অথচ সে চাইলে এখনই দড়িটা ছিড়ে ফেলতে পারে । ” এই গল্পটা আমরা সবাই জানি, অথচ জানি না, গল্পের এই হাতিটার সাথে আমাদের প্রচণ্ড রকমের মিল রয়েছে । যারা বিশ্বাস করেন, ভারত ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারবো নাহ, যারা বিশ্বাস করেন, ভারতের সাথে আপোষ না করে চললে আমরা হুমকির মুখে পড়বো, এই গল্পটা তাদের জন্যে ।
তাদেরকে বলছি, আপনারা ঠুনকো বিশ্বাস বলয়ের মাঝে বাস করছেন । এই বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসুন । দেখিয়ে দিন, তাদের ছাড়াও আমরা পারি । আমাদের সদিচ্ছা, একাগ্রতা এবং চেষ্টা থাকলে একদিন আমরা এই ভারত-বলয় থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসতে পারবো ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।