‘মহাপ্রয়াণ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ মৃত্যু হলেও, সমাজের আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুকে আমরা মৃত্যু বলি, মহাপ্রয়াণ বলি না। মনুষ্য-সমাজে মহাপুরুষ বা মহিয়সী নারীরূপে গণ্যদের মৃত্যুকে আমরা সাধারণের মৃত্যু থেকে সম্মানের সঙ্গে অনেকটাই পৃথক করে দেখি। তাদের মৃত্যুর উদ্দেশ্যে প্রস্থানকেই আমরা মহাপ্রয়াণ বলি।
শিরোনামে মহাপ্রয়াণ শব্দটি ব্যবহার করার ভিতর দিয়ে আমি আমাদের সমাজের তলদেশবাসী ভূমিহীন কৃষকসমাজের একজন সৎ ও সংগ্রামী প্রতিনিধি হিসেবে নেকাব্বরের জীবনসংগ্রামের জলছবি আঁকার চেষ্টা করেছি, এবং তাঁর করুণ মৃত্যুকে মহাপ্রয়াণ হিসেবে চিহ্নিত করে নেকাব্বরকে কবির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করার প্রয়াস পেয়েছি।
কবিতাটি লিখেছিলাম ১৯৭৮-৭৯ সালের কোনো একসময়।
তখন আমি ময়মনসিংহে বাস করতাম। এই কবিতাটি আমার রচিত ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটি চট্টগ্রামের অধুনালুপ্ত প্রকাশনী ‘সম্পাদক’ থেকে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। ঢাকার বাইরের কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এইটিই আমার একমাত্র গ্রন্থ। গ্রন্থের বাইরে ঠিক কোন পত্রিকায় এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিলো, মনে নেই।
তবে কবিতাটি যে ময়মনসিংহের ধোপাখোলার বাসায় বসে লিখেছিলাম, সেকথা আবছা মনে পড়ে।
গ্রামের কৃষকদের মধ্যে আমার জন্ম হয়েছিলো এবং একনাগারে জীবনের প্রথম ষোল বছর আমি তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিলেছি, মিশেছি, খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। তাদের জীবনের প্রণয়লীলা, আনন্দ-বেদনা ও জীবনের জন্য সংগ্রামকে কাছে থেকে, ভিতর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। উপলব্ধি করেছি।
কী এক অজানা কারণে সমাজের নিচু তলার মানুষদের প্রতি আমার পক্ষপাত ছিলো অনেকটাই জন্মসূত্রে পাওয়া।
তবে আমার এই উপলব্ধির কিছুটা রবীন্দ্রনাথ, কিছুটা নজরুল ও কিছুটা সুকান্তের কবিতা থেকেও আমি পেয়েছিলাম। তাই, আমার অনেক কবিতার মধ্যেই আমাদের কৃষকসমাজের জীবনচিত্র উঠে এসেছে। চাষাভুষার কাব্য বা ক্ষেতমজুরের কাব্যটির কথা এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। আমি মনে করি আমার ক্ষেতমজুরের কাব্য নিয়েও একটি চমৎকার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে।
আমার নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ কবিতাটির প্রতি আমার ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন।
তাই, ১৯৮০ সালে খুলনার কবিতা-প্রতিষ্ঠান ‘কবিতালাপ’ আমার ঐ কবিতাটিকে ঐ বছরের সেরা কবিতা হিসেবে পুরস্কৃত করে। এটি যে শুধু ঐ বছরের সেরা কবিতা নয়, আরও অনেক বছরেরই সেরা কবিতা সেটা বুঝতে আমারও বেশ সময় লাগে।
তাই দীর্ঘ নিদ্রাশেষে অতিসম্প্রতি নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ কবিতাটির পুনর্জাগরণ ঘটে।
তরুণ চিত্র পরিচালক কবি মাসুদ পথিক ওর জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এই কবিতাটিকে বেছে নেয়। কবিতাটির চিত্রনাট্য তৈরি করে সরকারী অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তথ্যমন্ত্রণালয়ে ছবিটির স্ক্রিপ্ট জমা দিলে কবিতাটি সরকারী অনুদান লাভে সক্ষম হয়।
এটি আমার কবিতা নিয়ে নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র।
আশির দশকে আমার হুলিয়া কবিতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘের ছবি নির্মাণ করেছিলেন তানভীর মোকাম্মেল। সেটিও ছিলো আজকের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের প্রথম ছবি। হুলিয়া বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা বিশেষ স্থান লাভ করেছে।
আমার বিশ্বাস, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ বাংলাদেশের পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন ছবি হিসেবে সমাদৃত হবে।
ছবিটির ভাগ্যে বিশ্বখ্যাতি জুটলেও আমি অবাক হবো না।
ঐ ছবিতে আমি ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ ক’জন কবি অভিনয় করেছেন। এটাও এই চলচ্চিত্রটির জন্য একটা আলাদা আকর্ষণ।
পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ-- কোথাও এরকম ছবি পূর্বে নির্মিত হয়নি।
মনে হয়, সত্যজিৎসহ অনেক চিত্রপরিচালকই নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।