প্রগিশীল, মুক্তমনা, সমঅধিকার এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে । কতদিনে এবং কীভাবে এ অবস্থার অবসান ঘটবে এখনো তার সুস্পষ্ট কোন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না । এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ এক নাজুক পরিস্থিতে পড়তে পারে বলে সহজেই অনুমেয় । অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হবার পর থেকে জামায়াতের নেতৃত্বে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশে নানা ধরণের বিশৃঙ্খা, অরাজকতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে । তাদের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ষড়যন্ত্রকারীদের এ অপচেষ্টা আাগমী দিনগুলোতে অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
এতে তারা বিশেষ করে বর্তমান সরকারের স্বাভাবিক মেয়াদকাল শেষ হবার পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালের সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। উল্লেখ্য, সংবিধান মোতাবেক আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৯০ দিনের খাড়া শুরু হবে। এ দিন থেকেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচোনত্তর সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চালু থাকবে । কাজেই এই সময়কালে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবন্থা বেশ ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে । এই অবস্থার ঠিক প্রাক্কালে প্রাক্কালে ৪ অক্টোবর রমনা কলী মন্দিরে দেশ-বিদেশের কিছু লোকজন মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী হিন্দুদের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবেন বলে ঘোষণা দিয়ে ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ নামের একটি অদ্ভুত অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজন মূলত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘোষণাপত্র এবং প্রজাতন্ত্রের সংবিধান পরিপন্থী । এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’, ‘বৌদ্ধ’ এবং ‘খ্রীস্টান’ ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজনের পায়তারা চলছে এবং এটি ধর্মের নামে একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক অনুষ্ঠান । জানা গেছে দেশি-বিদেশি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহায়তায় তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তথাপকথিত ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে ।
সম্প্রতি http://www.hindunet.org ওয়েব সাইটে শ্রীনন্দন ব্যাস নামের এক লেখকের লেখা Hindu Genocide in East Pakistan শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে । উক্ত প্রবন্ধে জনমিতি পরিসংখ্যানের অপব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০% হিন্দু, অর্থাৎ সংখ্যার বিচারে প্রায় ২৫ লক্ষ হিন্দুকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যা করা হয়েছে ।
প্রবন্ধটি আমেরিকা থেকে অনলাইনে প্রকাশিত ও প্রচারিত Unity নামের একটি নিউজলেটারের আগস্ট ২০১৩ সংখ্যায় অবিকল প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’-এর মূল উদ্যোক্তা Unity নিউজলেটারটির প্রকাশক ও প্রচারক । এই প্রবন্ধটিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে নতুন এক ধরনের বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া হয়েছে বলে দৃশ্যমান। এই বিতর্ক সৃষ্টি এমন সময় করা হচ্ছে- যে সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলমান রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে দেশ-বিদেশের কুচক্রীরা প্রশ্ন উত্থাপন করে চলছে।
তাই মুক্তিযুদ্ধে নিহত হিন্দুদের সংখ্যা ২৫ লক্ষ বলে দাবি করলে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে তোলা বিতর্কিত প্রশ্নের ভিত্তিকে শক্ত করে দেবে বলে ধারণা করা যায় । সব মিলেয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মোট সংখা এবং Hindu Genocide in East Pakistan শিরোনামের প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে ২৫ লক্ষ হিন্দু আত্মাহুতি দিয়েছেন বলে অলীক দাবি করার সমসাময়িক ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজনের বিশেষ কোন যোগসূত্র থাকলেও তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না ।
অন্যদিকে, হিন্দুধর্ম মতে ‘গণশ্রাদ্ধ’ বলতে কোন অনুষ্ঠানের বিধান নেই । কারণ উক্ত ধর্ম মতে ‘শ্রাদ্ধ’ একান্তই পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পারলৌকিক ক্রিয়া বিধায় রক্তের সম্পর্কের ক্রমানুসারে সর্বনিকটজনই কেবলমাত্র শ্রাদ্ধ করার অধিকারী- যাকে শ্রাদ্ধকর্তা বলে অবিহিত করা হয়। গোত্র এবং নারী-পুরুষ ভেদে শ্রাদ্ধের ক্রিয়াদি, দিন গণনা (গোত্র ভেদে ১০, ১৫ বা ৩০ দিন) শাস্ত্র এবং মন্ত্রের ভিন্নতা বিদ্যমান।
শ্রাদ্ধকার্য সম্পাদনে তিন পূর্বপুরুষ পর্যন্ত স্মরণ এবং তাদের নামে মন্ত্রোচ্চারণ, যজ্ঞ এবং পিণ্ডদান করা বাধ্যতামূলক। শ্রাদ্ধের ক্রিয়াদি পালনে পরলোকগত ব্যক্তির এবং শ্রাদ্ধকর্তার নাম উচ্চারণও বাধ্যতামূলক। এসব কারণে হিন্দুধর্ম মতে ‘গণশ্রাদ্ধ’ করা সম্ভব নয় এবং তাই তা হিন্দুধর্ম পরিপন্থী, অর্থাৎ গণশ্রাদ্ধ আয়োজন ধর্মের নামে ধর্মবিরোধী একটি কাজ । তাছাড়া হাজার হাজার পরিবার কষ্ট-ক্লেশ করে এবং বিপন্ন জীবন নিয়ে ’৭১ সালেই তাদের নিহত নিকটজনদের শ্রাদ্ধক্রিয়াদি গোত্র ভেদে ১০, ১৫ বা ৩০ দিন শেষে সম্পন্ন কেরেছিলেন। এখন তথাকথিত গণশ্রাদ্ধের নামে তাদেরও শ্রাদ্ধ করা হলে, একই ব্যক্তির শ্রাদ্ধ দুইবার করা একটি গর্হিত কাজ ।
এই গর্হিত কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে এবং পারিবারিক সম্মানে আঘাত লাগবে। এসব পরিবারের সদস্যরা গণশ্রাদ্ধ আয়োজকদেরকে যদি প্রশ্নে করেন- একবার যাঁদের শ্রাদ্ধ করা হয়ে গেছে ধর্মীয় কোন রীতি এবং কোন অধিকারে ঐসব আয়োজকরা দ্বিতীয়বার তাঁদের শ্রাদ্ধ করবেন, তা’হলে তাদের কাছে এর কী উত্তর আছে ?
আরেকটি বিষয়- গণশ্রাদ্ধ আয়োজন দেখে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের স্ব-স্ব ধর্মমতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণেও অনুরূপ অনুষ্ঠান আয়োজনে উদ্যোগী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে সত্যি-সত্যিই যদি দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের ধর্ম মোতাবেক কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, আর তাতে যদি কোন বিশেষ মহলের মদদ থাকে, তা’হলে তাতে কত মানুষের সমাগম ঘটতে পারে তা কি ধারণা করা যায়ৎ- বিশেষ করে গণশ্রাদ্ধ আয়োজকরা যেখানে ঘোষণা দিয়েছেন তাদের অনুষ্ঠানে ২ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটানোর প্রস্তুতি রয়েছে ? হিসাবটি খবু সহজ এভাবে- দেশের ১০% জনসংখ্যার (ধর্মীয় ষংখ্যালঘু) মধ্যে ২ লক্ষ লোকের সগামগ ঘটলে, ৯০% জনসংখ্যার (ধর্মীয় সংখ্যাগুরু) মধ্যে ১৮ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটতে পারে। এই ১৮ লক্ষ লোকের মধ্যে যদি কোনভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয়ে যায় তাতে ঢাকা শহর এবং দেশের অবস্থাটা কী দাঁড়াতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিগত ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র দেড় লক্ষ হেফাজতী গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ৬ এপ্রিল এবং ৫ মে ঢাকায় মহাসমাবেশের নামে যে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে এবং তা সামলাতে সরকার ও প্রশাসনের যে পরিমাণ গদলঘর্ম ঝড়াতে হয়েছে এবং তা নিয়ে এখনো যেসব ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাতো দিব্যলোকের মত স্পষ্ট।
তাই গণশ্রাদ্ধ আয়োজনের ফলশ্রুতিতে দেশ কোন বড় ধরণের ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
অপর দিকে নানা সময়ে বিভিন্ন অযুহাতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই নানাভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যখন হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষত বিগত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুর্ধর্ষ রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদির ফাঁসির রায় হবার পর বিনা অযুহাতে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন স্থাপনাসহ তাদের জানমালের উপর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে নির্মমভাবে হামলা চালিয়েছে, তখন ‘গণশ্রাদ্ধ-৭১’ নামের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। আর তা’হলে সেই অস্ত্রটির যুতসই ব্যবহার করে নতুনভাবে তারা আরেক দফা নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতে পারে এবং ততে করে দেশের শান্তি-শৃংখলা চরমভাবে বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা অমূলক নয় ।
আগেই বলা হয়েছে- গণশ্রাদ্ধ আয়োজন ধর্মের নামে উস্কানিমূলক একটি অনুষ্ঠান, বিশেষ করে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরণের আয়োজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ।
আরেকটি বিষয়- একাত্তরে অগণিত নিহত ও নিখোঁজ হিন্দুদের জন্য আজঅবধি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি বলে গণশ্রাদ্ধের আয়োজকরা যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন তাও মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ।
কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল তৎকালীন গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম কর্মসূচিটিই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে নীরবতা পালন এবং তাঁদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রত্যেক ধর্মমতে প্রার্থনা করা । অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধে সকল আত্মাহুতিদানকারী জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার অদূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন । সেই স্মৃতিসৌধের নির্মাণ এবং উন্নয়ন কাজ পর্যায়ক্রমে সকল সরকারের আমলেই চলমান থাকে এবং ২০০২ সালে তা সম্পন্ন হয় । এখানে প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির পক্ষে রাষ্ট্রপতি এবং সরকার প্রধান সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা এবং তাঁদেরকে গভীর শ্রদ্ধভরে স্মরণ করেন । বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান এবং কূটনীতিবিদরাও এখানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে । বছরের উপরোল্লেখিত ঐ দুই দিনে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ, তথা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং নিজ-নিজ ধর্মমতে তাঁদের জন্য প্রার্থনা বা দোয়া করেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক ভেদাভেদ রয়েছে বটে, কিন্তু জাতীয় স্মৃতিসৌধকে নিয়ে সকলের মধ্যে একটি অলিখিত একতা বিদ্যমান। গণশ্রাদ্ধ আয়োজনের মাধ্যমে এই একতার জায়গাটিকেও ভেঙ্গে ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান ।
তাই সব মিলিয়ে ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ বন্ধ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।