আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশের ওপর বিশ্বকাপ !



কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে ব্যস্ততার শেষ নেই। মহাপতঙ্গের রোটর ব্লেডের শোঁ শোঁ আওয়াজে চাপা পড়ে লাস্যময়ী বিমানবালাদের হাইহিলের শব্দ। বিশ্বায়ন সেখানে দু হাত ভরে দিয়েছে। ভিনদেশের পণ্য থেকে প্রান-কিছুরই অভাব নেই। তারই চাক্ষুষ প্রমান হয়ে আছে বিমানবন্দরটির দুটি ফটক।

নাড়ির টান ছিঁড়ে যে গেটটি দিয়ে ভিনদেশে উড়াল দেয় নেপালিরা, সেই ডিপারেচার গেটে ইদানিং কিছুতেই ভিড় কমছেনা। সবার চেহারাতেই একটা ছবি সেঁটে রাখা-মুখের হাসিতে চোখের কান্না লুকিয়ে সন্তানকে ভিনদেশে পাঠাচ্ছে বাবা-মা। তার থেকে কিছুটা দুরেই অ্যারাইভাল গেট। সেখানকার দৃশ্যটা একটু আলাদা। কিছু বয়োবৃদ্ধ নেপালির মরাকান্না এবং কয়েকটা কফিনের সমাহারে জায়গাটার পরিবেশ বেশ ভারী।

প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চারটি কফিন আসছে। সবগুলোই একেকটা তাজা স্বপ্ন খুন হয়ে যাওয়ার বোবা সাক্ষী ! ইতিহাস পরাজিতরা লেখেনা। হাজার বছরের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে আছে অযুত হেরে যাওয়া শ্রমিকের ঘাম। তারই বেদীতে বসে আজও ইতিহাসের পাতায় নিত্য-নতুন মণিমুক্তো যোগ করছে বিজয়ীরা। কাতারও ঠিক একই কাজ করছে।

অনেক জল ঘোলা করার পর ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের ছাড়পত্র পেয়েছে 'মধ্যপ্রাচ্যের মরুদ্যান' নামে খ্যাত দেশটি। সেজন্য এখন থেকেই শুরু হয়েছে এলাহী কান্ড। ১২টি ভেন্যু শহরের স্টেডিয়াম নির্মানেই কাতার খরচ করবে ১০৭ বিলিয়ন পাউন্ড। সবমিলিয়ে থরচের আনুমানিক অংকটা ১৩৮ বিলিয়ন পাউন্ড ! ভুভুজেলার বিশ্বকাপের তুলনায় যা ৬০ গুন বেশী ! কৃত্রিম মেঘ দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ঈশ্বরকে দেখিয়ে দেয়ার খরচটা কিন্তু হিসেবের বাইরেই রইল। কারণ,এই তুঘলকি কান্ডের খরচা-পাতি সমন্ধে কাতার নিজেই অজ্ঞাত ! ফাইনাল এবং উদ্ধোধনী ম্যাচের স্টেডিয়াম নির্মানে তারা আস্ত একটি শহর তৈরির কাজে হাত দিয়েছে।

যার নাম লুসাইল। এজন্য অতিরিক্ত আরও ২৮ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হবে কাতারকে। কিন্তু বিশ্বকাপ আয়োজকদের ইতিহাসে জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রুতম দেশটি তাদের ওজনের চেয়ে ভারী মহাযজ্ঞটি সম্পন্ন করবে কিভাবে ? জবাবটা লুকিয়ে দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর কাঁচা-পাকা এন্তার কুঁড়েঘরে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে প্রায় প্রতিটি বাবা-মাই ঋন করে থাকেন উচ্চ হারের সুদে। সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে বেঁচে থাকার শেষ কটা দিন দুধে-ভাতে কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্নে তাদের চোখ চকচক করে।

আর তা পূরনের প্রতিজ্ঞায় প্রতিবছর দেশ ছাড়ে প্রায় ৪ লাখ নেপালি তরুন। তাদের মধ্যে গড়ে এক লাখের ঠিকানা হয় কাতার। বিশ্বকাপের মতো মহাযজ্ঞকে সামনে থাকায় সেই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। তাদের মধ্যে গণেশ বিশ্বকর্মাও ছিল। নেপালের ডাং শহরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কশাঘাত করে চলা দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সেও পাড়ি জমায় কাতারে।

স্থানীয় সুদব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩৬ শতাংশ হারে ঋন নিয়ে গণেশকে কাতারে পাঠান তার বাবা তিলক বিহারী বিশ্বকর্মা। ডিপারেচার গেটে গণেশ তার বাবাকে বলেছিল-'ফিরে এসে মাকে একটা সুন্দর ঘর বানিয়ে দেবে। ' দুইমাস পর কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেট দিয়ে গণেশ ঠিকই ফিরে এলো, না তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। তখন তার শরীরে প্রাণের লেশমাত্র নেই। মুখে ক্ষুধা আর তৃঞ্চার স্পষ্ট ছবি।

এই গ্রহে মাত্র ১৬টি বসন্তের রুপ-রস উপভোগের পর শেষ যাত্রায় গণেশের সঙ্গী হয় শুষ্ক কাঠের কফিনটি। তাও মাত্র কয়েকঘন্টার জন্য। বিমানবন্দর থেকে গণেশকে বহনকারি অ্যাম্বুলেন্সটি যখন তাদের মাটির বাড়িটিতে পৌঁছায় তখন প্রায় শেষরাত। তার আগে থেকেই মরাকান্নায় যোগ দিয়েছে গণেশের আত্নীয়-স্বজন থেকে প্রতিবেশিরা। শুধু গণেশের বাবা তিলক বিহারী সবার থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন-ঋন শোধ করতে না পারলে ভিটে-মাটিটুকুও যাবে ।

তখন ! গণেশের বাবার মতো লোকের সংখ্যা নেপালে দিনকে দিন বেড়ে চলছে। কারণ, কাতারে প্রায় প্রতিদিন গড়ে একজন করে নেপালি শ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে। যাদের সবার ঘামই লেগে রয়েছে ২০২২ বিশ্বকাপের নির্মানাধীন প্রতিটি সৌধে। একবার ভাবুন তো, মাথার ওপর ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন বিলোচ্ছে সুর্য। আর তার নিচে শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে টানা ১২ ঘন্টা উদয়াস্ত পরিশ্রম, চা্ই কি পানিটুকু খাওয়ার জো নেই।

তাহলেই ঘ্যাচাৎ করে চাকুরী নট ! আর পারিশ্রমিক ? গনেশ দুইমাস চাকুরী করে একটি রিয়ালও বাড়িতে পাঠাতে পারেনি। কারণ তাকে কোন বেতন দেয়া হয়নি। অথচ স্থানীয় দালাল তাকে চাকুরী দিয়ে কাতারে পাঠানোর চার্জ বাবদ পকেটে পুরেছে পাক্কা দেড় লাখ রুপি। গনেশ তো মরে বেঁচেছে, কিন্তু এখন সেই ঋণ করা দেড় লাখ রুপির একেকটি কড়ি পাই পাই করে শোধ করতে তিলক বিহারীর জান যাবার জোগার। লুসাইল সি্টি নির্মানের কাজে নিয়োজিত থাকা ৫০ হাজার নেপালি শ্রমিকেরও ঠিক একই দশা।

টানা ছয়মাস কোম্পানি তাদের বেতন দেয়না। কয়েকজন বিদ্রোহ করেছিল। পরিণামের বেশিরভাগ শ্রমিকের পাসপোর্ট জব্দ করে চশমখোর কোম্পানিগুলো। ওদিকে দেশে কুসীদজিবিরা বারবার সুদের টাকার জন্য তাগাদা দেয়। বেঁচে থাকাটা তখন কতটা দুঃসহ তা প্রতিটি শ্বাসে অনুভব করে চলে হতভাগা নেপালিরা।

‌'পারিশ্রমিক এখানে ফেলে রেখে দেশে ফেরার উপায় নেই। তারওপর দৈনিক ১২ ঘন্টা খালি পেটে কাজ করতে হয়। রাতের খাবার বন্ধ থাকে। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। বিনিময়ে কোম্পানি কর্মকর্তা আমাকে মার-ধোর করে ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়।

কয়েকদিন ভিক্ষা করার পর আবারও ক্যাম্পে ফিরে আসতে বাধ্য হই'-বলেন রমেশ কুমার নামের এক নেপালি শ্রমিক। নির্মানাধীন লুসাইল সিটির ভেতরই একটি ক্যাম্পে গাদাগাদি করে থাকে প্রায় হাজার খানেক নেপালি শ্রমিক। তাদের খাবারের জন্য রান্নাঘর মোটে আছে মোটে দুটি। সেখানে আবার বসত গেড়েছে তেলাপোকা থেকে শুরু করে আরশোলা প্রজাতির নানা প্রাণী। ক্যাম্পটি থেকে আবার বুর্জ আল খলিফার দুরত্ব খুব বেশি নয়।

কর্মক্লান্ত দেহ এবং খালি পেট নিয়ে প্রতি রাতে বুর্জ আল খলিফায় ঈশ্বরের দীপাবলির বাহার দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে হিমালয় পাড়ের ছেলেগুলো। গত বছর সেই ঘুম থেকে আর উঠতে পারেনি ৭২৬ জন। এবার সেই সংখ্যাটা ১১% বেশি। কিংবদন্তি বলে, তাজমহল গড়ার পর ২০ হাজার শ্রমিকের আঙ্গুল কেটে রেখেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। যেন তাজমহল আর দ্বিতীয়টি কোথাও তৈরি না হয়।

ঠিক একই কারণে পিরামিড গড়ার পর ফারাওরাও কোন শ্রমিককে বাঁচতে দেয়নি। কাতারের কর্তা-ব্যক্তিরা সেরকম কিছু করলেও মেনে নেয়া যেত। কিন্তু গনেশদের বাবার কি হবে ? জলজ্যান্ত ছেলের চিতার পাশে দাঁড়িয়ে যে বাবাকে অশ্রুবিসর্জনের বদলে সুদের টাকা পরিশোধের পথ খুঁজতে হয়, তার দায় কে নেবে ?.....ঈশ্বর ? তিনি তো থাকেন আঁকাশছোঁয়া বুর্জ আল খলিফার রংয়ের বাহারে ! (ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান অবলম্বনে। ছবি ইন্টারনেট থেকে। ছবি হাতে ধরা ব্যক্তিটি গনেশের বাবা তিলক বিহারী বিশ্বকর্মা।

বাকি ছবিটি কাতার বিশ্বকাপের ভেন্যু ম্যাপ। } (খেলাধূলা নিয়ে লিখতে ভাল লাগে। তাই হঠাৎ করেই এই লেখা.........। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.