আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুবা থেকে মালাকালের পথে

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ

জুবা থেকে প্লেনে করে মালাকালের পথে রওয়ানা হলাম। দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে ফ্লাইট , সময় মত প্লেন টেক অফ করল।

এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট ফ্লাইট টাইম। মালাকাল আপার নাইল স্টেটের রাজধানী, এই স্টেটের প্রদেশ বারটি। এই প্রদেশের আয়তন ৭৭,৭৭৩ বর্গ কিলোমিটার। প্রদেশটা সাউথ সুদানের উত্তর পূর্বে, ইথিওপিয়ার পাশে। হোয়াইট নাইল নদী এই স্টেটের উপর দিয়ে বয়ে দক্ষিনের দিকে চলছে।

মালাকাল এয়ারপোর্ট দুপুর বেলা মালাকাল এসে পৌঁছালাম, আজ দিনটা ছিল আলোকিত, আকাশ পরিস্কার হাল্কা মেঘ ছিল শুধুমাত্র। এই পথে প্রায় বৃষ্টি হয় এবং আবহাওয়া খারাপ থাকলে বেশ বাম্পিং হয় প্লেনে। আমরা সুন্দর ভাবে ছোট্ট মালাকার বিমান বন্দরে অবতরন করলাম। এটা একটা ছোট বিমান বন্দর, এখান থেকে আভ্যন্তরীণ রুটে কিছু প্লেন চলে। দিনে একটার বেশি ফ্লাইট কমই থাকে।

চারিদিক সব শান্ত। অল্প কিছু মানুষজনের আনাগোনা দেখা যায়। এক মেঘলা বিকেলে হোয়াইট নাইল নদীর পাড়ে জিপে করে রওয়ানা হলাম, মাটির রাস্তা, লাল মারাম ফেলে বানানো, এখানকার মাটি কাল। বাহির থেকে এই লাল মারাম আনা হয়েছে রাস্তা বানানর জন্য। বাজে রাস্তা, বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে।

পেটে খাবার থাকলে এই পথে চললে সব হজম হয়ে যাবে। হোয়াইট নাইল নদীর পারে থাকার জায়গা। নদীতে বড়শি ফেলে মাছ ধরলাম কিছুক্ষণ। আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে, হোয়াইট নাইল নদীর কয়েকটা ছবি তুললাম। হোয়াইট নাইল নদীর বুকে নৌকায় মানুষেরা নদীর দুই পাড় বুক সমান উঁচু ঘাসে ঢাকা, কাঁদা মাটি, স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা জায়গা।

তারপর ঝোপ গাছের সারি, এরই মাঝে তাল গাছ একপায়ে দাড়িয়ে আছে। কখনো একলা কখনোবা বেশ কয়েকটা মিলে। এই নদীতে মাঝে মাঝে নৌকা দেখা যায়। ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করে। মালামাল ও নৌ পথে এখানে আসে।

মালাকালে একটা নদী বন্দর আছে । একা এক জেলে মাছ ধরছে হোয়াইট নাইল নদীর পানিতে বিকেলটা ছিল মেঘে ঢাকা। হঠাৎ দেখলাম একটা ডিঙ্গি নৌকাতে করে একলা এক জেলে মাছ ধরছে। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত, জেলে এক হাতে নৌকা সামলাচ্ছে আর আরেক হাতে বিছিয়ে যাওয়া জালে মাছ লেগেছে কিনা দেখছে । আর দেরী না করে ছবি তুলে ফেললাম।

নদীর মাছগুলো বেশ মজার। এখানে একদিন এই মাছের ফ্রাই খেলাম। মাইলের পর মাইল প্রকৃতি এরকম –মালাকাল জুবা থেকে একটু বাহিরে গেলেই প্রকৃতি অন্য রকম হয়ে যায়। বহু শত মাইল ঘাস জমি, মাঝে মাঝে ঝোপ গাছ। তালগাছ একপায়ে দাড়িয়ে আছে অনেক।

এটা কমন দৃশ্য এখানকার। শহর থেকে বাইরের রাস্তাগুলোতে মাঝে মাঝে গাড়ি চলে। এখানে খচ্চরে টানা গাড়িতে মালপত্র এবং কখন ও মানুষজন চলাচল করে। চাইনিজ মোটর সাইকেল দিয়ে আমাদের দেশের মত ভটভটি দেখলাম এখানে। মোটর সাইকেল ও আছে একটু অবস্থাপন্ন মানুষের।

তৃণ ভূমির মাঝে এখন স্কুল দেখা যায় বিশাল এই দেশে পাকা রাস্তার বড়ই অভাব। রাস্তা গুলো মাটির এবং যুগ যুগ ধরে এভাবেই মানুষজন দিন পার করছে। তবে বর্ষা কালে রাস্তা চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে যায় , এসময় না পারতে যাতায়াত চলে। বহু বছর ধরে চলা গৃহ যুদ্ধ তাদের স্বাভাবিক জীবনকে বদলে দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে সব শুরু হচ্ছে।

দূরে একটা প্রিমারি স্কুল দেখলাম। নতুন করে বানান হচ্ছে। সকাল বিকেল ছেলে মেয়েরা যাতায়াত করছে স্কুলে। ঝোপ গাছ ও মালাকালের মেঠো পথ বিকেল বেলা মালাকাল শহর একটু ঘুরে দেখব বলে ঠিক করলাম। দুপুরের পর থেকে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।

আকাশ মেঘলা, পাঁচটার সময় মালাকাল শহরের পথে রওয়ানা হলাম। রাস্তার অবস্থা শোচনীয় , মাটির রাস্তা, গর্ত আর বর্ষার পানিতে কাঁদা হয়ে আছে। খুবই সাদামাটা দৃশ্য। গরিবি হালত বলা চলে। মেইন রোড একসময় পাকা ছিল, এখন খারাপ অবস্থা।

বাজারের দোকানগুলোতে জিনিসপত্র খুব কম। বর্ষাকালে আমদানি কম হয় কারণ রাস্তা খারাপ থাকে, পাশের দেশগুলো থেকে কিছু আসতে পারে না। ফলমূল শাকসবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। মালাকাল শহর এখনো এরকম - রাস্তা গুলো এমনই এর দুপাশ দিয়ে রাস্তা বানানো হচ্ছে। এক সময় শহরটা সুন্দর হয়ে যাবে।

প্লানটা বেশ সুন্দর, জায়গার তো কোন অভাব নেই। টিনের চালের ঝুপরি দোকান, দুই একটা দোতালা বাড়ী। অনেক মুসলমান আছে মনে হল। মসজিদ দেখলাম কয়েকটা। বেশ ভাল করে বানানো।

শহরের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুরে আমরা ফিরে আসছি একটা রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তাটা মালাকাল পোর্টের দিকে গেছে। বাজে রাস্তা, থক থকে কাঁদা রাস্তাতে। পোর্টের অবস্থাও বেশি সুবিধার না। তবে এখান দিয়ে নদীপথে মালামাল আসে।

তোমার ভাংগা বাসেতে আমি যাবনা- তাহলে খচ্চর টানা গাড়িতে যেতে হবে বেশ মজাই লাগছিল যখন লিখছিলাম। এখানে আশেপাশের এলাকাতে যাতায়াতের জন্য মাঝে মাঝে সাধারন বাস চলে দু একটা তা না হলে খচ্চরে টানা দু চাকার গাড়িই ভরসা। কিছু না থাকলে দুই পা তো আছেই। আমাদের ভাগ্য ভাল, বৃষ্টি আসেনি আজ বিকেলে। রাস্তা ছাড়া বাকী জায়গাগুলো ঘাস জমি, মাঝে মাঝে ছোট ছেলে মেয়েরা গরু বা ছাগলের বড় বড় পাল নিয়ে ঘরে ফিরছে।

কিছু পালের সাথে মহিলারাও আছে, পুরুষ খুব কম দেখলাম পশুর পালের সাথে। বহু শত মাইল এরকম তৃণভূমি - তৃণভূমিতে গরুর পাল রাত শেষে মালাকালে ভোর আসে। এখানে এখনও গ্রামের নিস্তব্দতা। সূর্য এখনও উঠেনি, পাখীর ডাক শোনা যায় নদীর পাড়ে। সাদা বকেরা ডানা মেলে উড়ে চলে নদীর উপর দিয়ে।

ঝোপ গাছ গুলোতে নানা জাতের পাখি বসে আছে। অপূর্ব দৃশ্য। সকাল বেলার গাছপালা আর সবুজের দৃশ্য অপূর্ব লাগে, ঝোপের পাশাপাশি তালগাছ গুলো যেন শূন্য প্রান্তরে মাথা উঁচু করে পাহারাদারের মত দাড়িয়ে আছে। রাতে বৃষ্টি হয়েছে, নদীতে বেশ স্রোত, কচুরিপানা আর ঘাসের নানা আকারে একত্রে ভেসে যাচ্ছে। মানুষজন দেখতে পেলাম না নদীতে, তবে পাখীরা তাদের খাবারের খোঁজে নদীতে উড়াউড়ি করছে।

মালাকালে সকালটা বেশ সুন্দর। দুপুরের দিকে আবহাওয়া বেশ গরম থাকে তারপর সন্ধার পর আবার হালাকা ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়া যায়। এখানকার মানুষেরা পশুপালন করে তাদের দিন কাটায়, এই পশুর সংখ্যা তাদের ক্ষমতার প্রকার। যে যত বেশি গরুর মালিক তার তত দাপট। সে অনেক বিয়ে করতে পারে, মেয়েদেরকে গরু দিয়ে বিয়ে করতে হয়, যে মেয়ে যত সুন্দর তার জন্য তত বেশি গরু লাগে।

তাই গরু ছিনিয়ে নেয়া এবং এজন্য যুদ্ধ , হানাহানি, রক্তপাত সবই হয় এখানে । মালাকাল থেকে আগামিকাল আমাকে জংলে প্রদেশের ইউয়াই যেতে হবে। মালাকালে দিনগুলো ভাল ভাবেই কেটে গেল। ইউয়াই – বোর – জুবা এখন বর্ষা কাল, এ সময় সাউথ সুদানের রাস্তা গুলো চলাচলের জন্য তেমন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে না । একে তো মাটির রাস্তা তার উপর কাদা, তাই যাতায়াতের জন্য আকাশপথ সবচেয়ে ভাল।

সবার পক্ষে কি এভাবে যাওয়া সম্ভব? অবশ্যই না, তাই এদেশে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে অল্প কিছু লোকই যাতায়াত করতে পারে। আমি আজ চলছি জংলে স্টেটের ইউয়াই তে। এখানে দুটো দলের মধ্যে মারামারি চলছেই। এটা ছোট একটা জনপদ । বোর জংলে স্টেটের রাজধানী, এই স্টেটের প্রদেশ এগারোটি।

এই প্রদেশের আয়তন ১,২২,৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। জংলে স্টেটের বিদ্রোহীরা তাদের নেতা ডেভিড ইয় ইয়র অনুগত। এই প্রদেশেই এখনও সমস্যা রয়ে গেছে। এখানে মুরলে গোত্রের মানুষ বেশ হিংস্র এবং এরা যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত। এদেরকে ডিঙকা কিংবা স্থানীয় নুয়ের গোত্রের মানুষ ও পছন্দ করে না।

হোয়াইট নাইল নদী বয়ে চলছে - আপার নাইল স্টেট থেকে জংলে স্টেটের পথে মালাকাল থেকে উড়াল দেয়ার পর আবার সেই চির পরিচিত দৃশ্য। হোয়াইট নাইল নদী এঁকে বেঁকে বয়ে চলছে এই প্রদেশের উপর দিয়ে। তবে এখানের গ্রাম গুলো একটু অন্য রকম লাগল। প্রথমে চারিদিকে ঘাসের গোলাকার অবস্থান, তারপর কিছু ঝোপ গাছ, এরপর ভেতরের অংশ পরিস্কার করে টুকুল গুলো সাজান রয়েছে। এরকম টুকুল গুচ্ছের মাঝে পায়ে চলা পথ।

নানা দিক দিয়ে এগুলোতে ঢোকা যায়। বেশ সুন্দর লাগে আকাশ থেকে দেখতে। জংলে স্টেটের গ্রাম, দূরে টুকুল –বোর এলাকাতে প্রায় এক ঘণ্টা উড়ে আমরা ইউএইতে নামলাম। এখানে কোন বিমানবন্দর নেই। মাঠেই নামতে হল।

একটু দূরে দিয়ে মানুষজন হেঁটে যাচ্ছে, নিরাপত্তার জন্য কিছু জায়গা পরিস্কার করা হয়েছে। এখানে দেখার কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার রওয়ানা হলাম বোরের উদ্দেশ্যে। জংলে স্টেটের ইউএইতে আরও এক ঘণ্টা পনের মিনিট পরে বড় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালাম। ছোট বিমান বন্দর।

দু একটা ছোট বিমান মাঝে মাঝে উড়াল দেয় এখান থেকে। এখানেও মাটির রাস্তা । শহরে পাকা রাস্তা আছে। দুএকটা বিল বোর্ড দেখা যায় এখানে সেখানে। দুই দিন এখানে থাকার কথা ছিল।

এইফাকে জুবা জাবার সুযোগ আসল, তাই দেরী না করে জুবার পথে আবার উড়াল দিলাম। বোর বিমান বন্দর থেকে শহরের দিকে –জংলে স্টেট এক দিনে প্রায় চার ঘণ্টা বিমানে ভ্রমন। বেশ কষ্ট কর। তবে নিজের আস্তানার বাইরে ছুতির দিন কাটানোর বদলে জুবা যতই খারাপ হউক তাও ভাল। বিকেল পাঁচটার পর জুবাতে ল্যান্ড করল বিমান।

রোদের তেজ এখনও বেশ, মেঘহীন নীল আকাশ, নীচে লাল মাটির পথে চলতে আবার ফিরে এলাম জুবাতে। এক সপ্তাহ পর জুবাতে ফিরতে পেরে বেশ ভাল লাগছিল। মনে হল জুবাও যেন আপন নিবাস এই পরবাসে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।