আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রাভেলগ -জুবা থেকে ওয়াও- আওইল-সাউথ সুদান

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ
জুবা থেকে দুপুর বেলা বিমানে করে ওয়াওয়ের পথে রওয়ানা হলাম। ছোট বিমান, পঁচিশ জন বসতে পারে এই বিমানে।

ওয়েস্টার্ন বাহার আল গাযাল এর রাজধানী ওয়াও, এই প্রদেশের কাউন্টির সংখ্যা তিনটি। আরবিতে গাযাল হল এক জাতীয় হরিণ আর বাহার হল সাগর। এই স্টেটে হয়ত অনেক হরিণ ছিল বা আছে, তবে আমি দেখিনি বা দেখার সুযোগ হয়নি এখন ও। এখানে আপাতত পরিস্থিতি শান্ত, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব নেই । জুবা থেকে প্রথমে বিমান রুম্বেক বিমান বন্দরে নামল।

এখানে রিফুয়েলিং হল। এখানে আসতে এক ঘণ্টা দশ মিনিট লাগলো । রুম্বেক বিমানবন্দরের রানওয়ে মাটির, তবে এটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, প্লেন থেকে নামতে একটু দেরি হল তাই বাইরে আর কোথাও যেতে পারলাম না। রুম্বেক লেক প্রদেশের রাজধানী, এই প্রদেশে কাউন্টির সংখ্যা আটটি। সামনের দিনগুলোতে এখানে থাকার জন্য আসতে হবে।

জুর নদী -ওয়াও রুম্বেকে কাজ শেষ করে বিমান ওয়াওর পথে উড়াল দিল। বিমান থেকে নীচে বন্যার দৃশ্য দেখলাম। এই বর্ষাতে ওয়াও শহরের পাশ দিয়ে দুকুল ছাপিয়ে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে, নদীর নাম জুর। একসময় এই নদীর পাড়ে সুইমিং পুল সহ হোটেল ছিল। স্বাধীনতার পর পর্যটক আসা কমে গেছে তাই ভাল লাভ হচ্ছেনা বলে এখন তা বন্ধ হবে হবে করছে।

ওয়াও শহর আকাশ থেকে ওয়াও বিমান বন্দরে যখন নামলাম তখন বিকেল চারটা বেজে গেছে। বের হতে হতে আরও তিরিশ মিনিট লাগল। এই বিমান বন্দরের সবকিছু বেশ উন্নত, এসফল্টের রানওয়ে, অন্যান্য সুবিধাও আছে। বিকেলে কোথাও যাওয়া হল না। সন্ধার পর লোকাল একটা হোটেলে গেলাম।

শহরের লোকজনের ব্যাবহার নাকি তেমন ভাল না। অনেক হোটেলে বিদেশীদের যেতে মানা আছে নিরাপত্তার কারনে। বিশেষ করে রাতের বেলা মাতালরা বিদেশীদেরকে আক্রমন করে জিনিষ পত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় বিচার পাওয়া যায় না। কাজেই উপদেশ হল দূরে থাকা সেসব এলাকা ও বার কিংবা হোটেল থেকে।

আমরা একটা খোলা টুকুলে বসলাম, কোক আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলাম। দাম রিজনেব ল। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম এখানে। ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে ফিরে চললাম। পথে ওয়াও স্টেডিয়াম দেখলাম।

শহরের মূল রাস্তা জুর নদীর উপর বানানো ব্রিজ পর্যন্ত গেছে। এরপর আবার কাঁচা রাস্তা। সেই পথে শুকনার সময় রুম্বেক, জুবা যাওয়া যায়। রাতের শহর অন্ধকার, বিদ্যুৎ নেই, আলো জ্বলে জেনারেটর দিয়ে। তেমন উন্নতি এখনও হয়নি এই শহরের।

তবে কাজ শুরু হয়েছে। কয়াজক যাবার পথে- কয়াজক শহরের পথে পরদিন সকাল আঁটটার সময় আবার হেলিকপ্টারে করে আওইল যেতে হবে। আকাশে উঠার চল্লিশ মিনিট পর আমাদের হেলিকপ্টার ওয়ারাব প্রদেশের রাজধানী কয়াজক শহরের বিমান বন্দরে নামল, এই প্রদেশের কাউন্টির সংখ্যা ছয়টি। বিমানবন্দর শহর থেকে বেশ দূরে। বনের মধ্যে বিমানবন্দর, জনপদ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে।

রানওয়ে লাল মারামের। ছোট বিমান এখানে নামে। এখানে কিছুক্ষণ থেকে হেলিকপ্টার উড়াল দিল আওইলের পথে। বিমান বন্দরের আশেপাশে এরপর আমাদের গন্তব্য নর্দার্ন বাহার আল গাযালের রাজধানী আওইল শহর, এই প্রদেশের কাউন্টির সংখ্যা পাঁচটি। বিমান বন্দরের পাশে অনেক নষ্ট বিমান পরে আছে সেখতে পেলাম।

এই শহরের মানুষগুলোর ব্যাবহার নাকি বেশ ভাল। শহরে ছবি উঠানোর উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। শহরের পথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। বিমান থেকে আওইল শহর বিমান থেকে শহরটাকে বেশ সাজান মনে হল। রাস্তা ঘাত পরিচ্ছন্ন, পাকা রাস্তা আছে শহরে।

বিমান বন্দর শহর থেকে বেশ দূরে। বিমান বন্দরে অনেক ঘাস হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের কিছু অভাব আছে বলে মনে হল। আওইল শহরের পথে দুই সুদান যখন এক ছিল তখনকার মতই অফিস আদালতের সাইন বোর্ড গুলো পরে আছে। দেখে মনে হয় নতুন করে প্রানের ছোঁয়া পায়নি স্বাধীনতার পরে।

মানুষগুলো ভেবেছিল স্বাধীন হলে সব নিজ থেকে হয়ে যাবে, আসল তা কি হয় কখনো? আওইল শহরের পথে আসার পথে আমরা হেলিকপ্টারে আট জন ছিলাম, কেনিয়ান, বাংলাদেশী, সাউথ সুদানি এবং বাকী দুজন আফ্রিকার দুটো দেশের। । রাশিয়ান পেরিগ্রিন ইগর ছিল ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট । এটা ছিল রাশিয়ান হেলিকপ্টার । ওয়াও থেকে কয়াজক আসতে চল্লিশ মিনিট , সেখান থেকে আওইল আসতে এরকমই সময় লাগল।

নর্দার্ন বাহার আল গাযালের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এখানে বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম তবে এখন তা চালু আছে কিনা জানতে পারিনি। অনেক আরবি লিখা দেখা যায় এখানে। সাউথ সুদানিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে আরবি ভাষাতে। নতুন দেশে বাচ্চারা ইংরেজিতে পড়াশোনা করছে, এরা বড় হলে হয়ত তাদের ভাব আদান প্রদানের মাধ্যম হবে ইংরাজি। এখানে আসার পর বাংলাদেশিদের সাথে গল্প হল দুপুরে ,কি প্রসঙ্গে সোমালিয়ার কথে চলে এল।

সোমালিয়াতে এত সমস্যা, দেশের ভিতর হানাহানি, খুন চলছেই। দেশের বাহিরে ওরা আবার এক হয়ে ব্যবসা করছে। এক সোমালির কথা বললেন তিনি, সে এখন সাউথ সুদানে আছে। তারা কয়েকজন মিলে দুবাইতে একটা এপার্টমেন্ট কেনার প্লান করছে, দুবাইতে এপার্টমেন্ট কেনার পর তারা সেখানকার রেসিডেন্স পারমিট পাবে। এরপর তারা সেখান থেকে চীন ও সোমালিয়ার মধ্যে ব্যবসা করবে।

প্রায় সব গোত্রের লোক জন এখানে এক হয়ে ব্যবসা করছে, এদের ভাইরা দেশে একটা আরেকটাকে মারছে। কি বিচিত্র দেশ। সোমালিয়াতে ঘরের ভেতর মেয়েদের প্রতাপ এবং এটা সব গোত্র মানে, অথচ কট্টর লোকজন দেশের ভেতর অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছে। উগান্ডাতে একজনের সাথে এক বাঙ্গালি ছেলের দেখা হয়েছিল। তিনি তখন হাসপাতালে ছিলেন।

অপারেশনের রুগী সময় কাটেনা, তাঁর বন্ধু এক বাঙ্গালী ছেলেকে নিয়ে এসেছে তাঁর দেখা শোনা করার জন্য। রাতে তাঁর সাথে কথা হয়। পলিটেকনিকাল থেকে অটো মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিঙে পাশ করে তেমন কোনও কাজ পায়নি দেশে। একজন বুদ্ধি দিল যে ইউরোপে তাঁর অনেক দাম, অনেক চাকুরী আছে। সাত লাখ টাকা দালাল কে দিয়ে সে ইউরোপের পথে রওয়ানা হয়ে উগান্ডায় ধরা পড়ে।

সাত মাস জেলে ছিল। তারপর ছাড়া পেয়ে লোকাল একটা গ্যারাজে চাকুরী নিয়ে কোন মতে বেচে আছে। তাঁর ফেরার পথ নেই, সব বিক্রি করে এখানে এসেছে। তারপরও তাঁর আশা দেশে ফিরে গিয়ে নিজে কিছু করবে। সে চাকুরী করবে না।

তাঁর খামার করার সখ। মাছ মুরগী না কারন অনেকে এই ব্জবসায়েসে গেছে। সে কবুতরের ফার্ম করবে। ভাল জাতের কবুতর বেশ দামে বিক্রি হয়। দুটোতে প্রায় এক কেজি হয়ে যায়।

বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে সে কবুতরের ছবি দেখায়। বাংলাদেশের মানুষের মনের এই জোয়ার আমাদেরকে সামনে নিয়ে যাবেই। এই বয়সের ছেলেরা প্রেমিকা বা মেয়ের ছবি বুক পকেটে রাখে, আর সে রেখেছে তাঁর স্বপ্নের কবুতরের ছবি। সে লেগে থাকলে একদিন উপরে উঠবেই। বিকেল বেলা আবার ফিরতে হবে ওয়াওতে।

এবার সরাসরি যাবে। ফ্লাইট টাইম চল্লিশ মিনিট। বিকেল পাঁচটার সময় ফিরে এলাম ওয়াওতে। রাতে এখানে বাংলাদেশের গল্প করে সময় কাটালাম, পরদিন যেতে হবে জুবাতে। ওয়াও বিমান বন্দর উন্নত বলে বড় বিমান এখানে নামে।

আজ বিমান তা বেশ বড়। পঞ্চাশ জোন যাত্রী নিতে পারে। চৌদ্দ হাজার ফিট উপর দিয়ে উড়ে বিমান পৌনে এক ঘণ্টায় জুবা নামিয়ে দিল আমাদেরকে। এই সফরে সাউথ সুদানের চারটা প্রদেশ ছুয়ে এলাম। এদেশের দশটা প্রদেশের মধ্যে নয়টা দেখা হল এপর্যন্ত।

বাকী আছে একটা। আসা করি দেখা হবে সামনে। জুবাতে নিজের আঙ্গিনাতে ফিরে যেন প্রান ফিরে পেলাম।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।