আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুবা থেকে মালাকাল হয়ে বেনতিউ

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ
দুপুর বেলা জুবা থেকে মালাকালের পথে রওয়ানা হলাম, বিমানে এক ঘণ্টার ফ্লাইট টাইম । আজ আবহাওয়া বেশ ভাল, সময় মত চলে এলাম।

বর্ষা শেষ হয়ে গেছে, রাস্তা গুলো এখন রিপেয়ার করার সময়। এখন ও সব রাস্তা ঠিক হয়নি। আজ বিকেলে মালাকাল শহরে গেলাম। আজ আমার সাথে আছে ইথিওপিয়ার মুলিগেতা, তার খেতে হবে, এর আগে সে এই শহরে ছিল, মোটামুটি শহরটা তার চেনা। আমরা একটা ইথিওপিয়ান হোটেলে গেলাম।

সাধারন মানের হোটেল, মালিক ইথিওপিয়ার। এখানে অনেক ইথিওপিয়ার মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তারা সবাই এইসব নিজদেশের মানুষের হোটেল গুলোতে খায়। অনেক মানুষ দেখলাম শিশা খেয়ে অলস সময় পার করছে। সন্ধ্যার পর এরা বিয়ার নিয়ে বসে রাত পাড় করে।

ইথিওপিয়ার অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভার আছে এখানে, তবে তদেরকে সুদান সরকার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সব কাজ এখন স্থানীয় লোকজনকে করার জন্য সরকার উৎসাহিত করছে। মালাকাল শহরে হোটেল মালিক মুলিগেতাকে ভাল করে চিনে। সে ইথিওপিয়ার খাবার অর্ডার দিল। একটা বিরাট স্টিলের থালাতে বড় একটা চাপরার মত রুটি, তার উপর একটা প্লেটে মরিচ পেয়াজ দিয়ে সেদ্ধ করা ছোট ছোট মাংসের টুকরা।

রুটিকে বলে ইনজেরা এর সাথে তিবস বা ফ্রাইড মিট। এগুলোর সাথে লাল মরিচের গুড়ো মিশিয়ে মলিগেতা খাওয়া শুরু করেছে। এত ঝাল কি করে যে খাচ্ছে? লাল মরিচের গুড়ো লবনের মত কাউকে খেতে এই প্রথম দেখলাম। মুলিগেতার বাড়ি আদ্দিস আবাবা থেকে আট শ কিলো মিটার দূরে। সেখানে তার একটা ডি পার্ট মেন্টাল স্টোর আছে।

তার স্ত্রী সেই দো কান চালায়। স্ত্রী বুদ্ধিতে সে বিমোহিত। শহরের রাস্তা একটু ভাল হয়েছে, গত বার যখন এসেছিলাম তখন কাঁদা ও পানিতে রাস্তা ডুবে ছিল। দুই একটা রাস্তায় পিচ ঢালা হয়েছে বলে মনে হল। আজ আপার নাইল ইউনিভার্সিটি দেখলাম।

এখানে এখন পড়াশোনা শুরু হয়েছে। নতুন নতুন দোকান হচ্ছে, নতুন ঘর বাড়ি ও উঠছে। জিনিসপত্র বেশ দেখলাম আজকে। দাম অবশ্য জুবার তুলনায় বেশী। জুবা হয়ে এখানে মালামাল আসে।

বৃষ্টির কারনে রাস্তাঘাট ডুবে ছিল তাই অনেক জিনিষ সময় মত আসে নি। এখন তা আসা শুরু করেছে। মোবাইল কোম্পানি এম টি অ্যান আর ভিভা সেল বেশ ভাল ব্যবসা করছে এখানে। এবার মালাকালে অনেক দেশের লোকজনের সাথে দেখা হল। রাশিয়ার ভ্লাদিমির তারাসেংকো ইউ টি এয়ার সার্ভিসে চাকুরী করে, বহু বছর সে রাশান আর্মিতে ছিল।

এখন সে নানা দেশে কাজ করে। লিবেরিয়া, সিয়েরালিওন, সুদান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে সে ছিল। তার এক টাই মেয়ে , এক সময় অনেক ছবি তুলত। দেশে গেলে মেয়েকে সেসব ছবি দেখাত, মেয়ে এসব যুদ্ধ পীড়িত দেশের ছবি দেখে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করত না। তাই এখন আর ছবি তোলেই না।

আমি তাকে তার অভিজ্ঞতা লিখতে বললাম। বলল অনেকে কত লিখেছে। এখন এগুলো কেউ পড়ে না, কি হবে লিখে। আমাকে সাইবেরিয়ার পাইনের মোচা দিল। এর থেকে এক রকমের বিচি পাওয়া যায় সেগুলো ভেংগে ভেতরের বাদাম খেতে বেশ মজা।

স্তালিনের সময় যাদেরকে নির্বাসনে পাঠান হয়েছিল তারা ক্ষুধার জ্বালায় এসব জিনিষ খেত। তার কাছে স্তালিন এখন ও হিরো। সেই নাকি রাশিয়ার জন্য ঠিক ছিল। বাকিরা দেশটাকে ভেঙ্গে টুকরো করে দিয়েছে। ভ্লাদিমিরের বাড়ি কৃষ্ণ সাগরের পারে, চাকুরী করে সাইবেরিয়াতে, সেখানে মাইনাস বিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা, মালাকালে বত্রিশ ডিগ্রি, তার নিজের শহরে এখন দশ থেকে পনের ডিগ্রি।

তার এই যা যা বরের জীবন কেটে যাচ্ছে একরকম। তার বাড়ীর দিকে একটা তীর বানিয়ে ৪৭১৪ কিলোমিটার লিখে রেখেছে। এই পৃথিবীতে কে যে কখন কোথায় থাকবে কেউ জানে না। যাযাবরের মত মানুষ এক জীবনে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। জালমেই তাজিক আফগানিস্থানি।

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে দেশ ছেড়ে বিদেশে চাকুরী করছে। তার পরিবার কাবুলে থাকে। বাচ্চারা সেখানে লেখাপড়া করে। সে তার দেশকে ভালবাসে। পশতুনরা আফগানিস্থানে মেজরিতি, তারমতে তারাই দেশটাকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পশতুন দুররানিরা এসে তাদের সুন্দর দেশকে মৃত্যু, হত্যা, যুদ্ধ ও প্রতিশোধের ভূমি বানিয়েছে, সেই সুযোগ নিচ্ছে বিদেশিরা, আর মরছে হাজার হাজার নিরীহ আফগান মহিলা, শিশু, যুবক আর বৃদ্ধ। তার মতে আফগানিস্থানের কাছে হিন্দুকুশ উপত্যকায় বনি ইসরায়েলের এক হারানো গোত্রের সন্ধান নাকি পাওয়া গিয়েছে। এদের অনেকে এখন পশতুন হয়ে গেছে, এই কথার সঠিকটা প্রশ্নবিদ্ধ, তার মনে এটাই ঠিক। তাজিকরা দারি বা দরবারি ভাষাতে কথা বলে, এটা ফারসি ভাষার কাছাকাছি। ইরানিরা শিয়া মুসলিম তবে তাজিকরা সব সুন্নি।

এটা কিভাবে হল সে আগে ভাবেনি কখনও। মঙ্গোলদের আক্রমনের সময় এদেশে এক হাজার মঙ্গোল পরিবার থেকে যায়। হাজারারা তাদেরই বংশধর। হাজার থেকে হাজারাজাত। এরা বামিয়ানে থাকে এবং শিয়া মুসলমান, পশতুন তালেবানরা বহু হাজারা কে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল।

জালমেই তারপর ও আশাবাদী একদিন তার দেশে শান্তি আসবে। সে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কখনোই যেতে চায় না। তার আশা যেন পূর্ণ হয়। রাতে বেশিক্ষণ হাঁটা যায়না, অনেক পোকামাকড় আছে, সাথে আছে মশার উপদ্রব। সকাল বেলা আবার বেনতিউর পথে রওয়ানা হতে হবে তাই দেরি না করে ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে ফ্লাইট ছিল তবে সময় বদলে তা দুপুরে যাবে জানতে পারলাম। এখানে সাউথ সুদানি মোরসেইলের সাথে দেখা হল। আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম কিছুদিন এন্টেবিতে। আমাকে বেশ পছন্দ করে, দেখার পর কিছু না খাইয়ে ছাড়বেই না শেষে কোক খেতেই হল। এই পৃথিবীতে মানুষকে ভালভাবে রাখার অনেক ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন।

আন্তরিকতাও তারই একটা রহমত। এসব আছে বলেই এই পৃথিবী এত সুন্দর এবং বহু মানুষ বেঁচে থাকতে চায় এখানে। নামিবিয়ার পুলিশ অফিসার একজনের সাথে দেখা হল। প্রায় দু বছর মালাকালে আছে। কিছুদিন পর পর ছুটিতে যায়।

বাচ্চারা বেশ মিস করে তাঁকে । এবার সে দেশে চলে যাবে। তার দেশে অনেক ভারতীয় আছে। এরা ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ জমিয়ে বসেছে নামিবিয়াতে। বাংলাদেশি তেমন নেই জানাল।

তার আন্তরিকতা ভালই লাগল। কত দেশের মানুষের সাথে এই প্রবাসে দেখা হয় কথা হয়। এটাও একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।