আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনগণের জন্য একটি সমতল ভূমি প্রয়োজন

আজকের এই লেখাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি আমার গুণগ্রাহী একজন সমালোচক পাঠকের কথায়। প্রথমেই আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একটি লেখা পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পরই মেইল ঠিকানায় অনেক প্রতিক্রিয়া আসে। তার মধ্যে কিছু থাকে নির্দয় মনের কঠিন সমালোচনা। আবার কিছু কিছু গালাগালির পর্যায়েও চলে যায়।

কিন্তু পাঠক তো পাঠকই, তারা সবাই লেখকের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাই ই-মেইলের উত্তরে বিস্তারিত না লিখলেও বিরূপ মন্তব্যকারীসহ সবাইকে অন্তত ধন্যবাদ জানাতে কার্পণ্য করি না। গত পাক্ষিকে আমার লেখার শিরোনাম ছিল, 'একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা'। প্রসঙ্গক্রমে লেখার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও তার চেতনা, দর্শন এবং আদর্শের মূল্যায়ন গত ৪২ বছরে যে রকম হওয়া উচিত ছিল সে রকম কেন এখনো হলো না; এ সম্পর্কে কিছু মতামত আমার ওই লেখায় ছিল। সেগুলো পড়ে আমার সহৃদয় পাঠকের কাছে মনে হয়েছে লেখাটি কোনো একটি দলের পক্ষে গেছে এবং আমাকে তার নিরপেক্ষ মনে হয়নি।

সহৃদয় পাঠককে সবিনয়ে বলতে চাই, তার পর্যবেক্ষণের প্রথমাংশ সঠিক আর শেষাংশ সঠিক নয়। কারণ কে কোন পক্ষে, আর কে নিরপেক্ষ এবং এগুলোর সংজ্ঞাই বা কি- এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়, এমন কথা আমরা শুনেছি আমাদের নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকে। এ প্রসঙ্গে আজ আর যাব না। তবে কোনো রাখঢাক না রেখেই বলতে চাই, আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে সংগ্রাম করেছি।

সেই সংগ্রামের পথে ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ থেকে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং এসবের মাধ্যমের মধ্য থেকে প্রস্ফুটিত চেতনা, আদর্শ ও দর্শনের পক্ষে আমরা শতভাগ। আরও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা স্লোগান কোনো দলের নয়। বাঙালির সেরা সম্পদ। বাহাত্তরের সংবিধান ওই দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিফলন, এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। এসব কিছুর পক্ষেই আমাদের অবস্থান।

এ অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ কারও পক্ষে বা বিপক্ষে গেলে সেটি তাদের অবস্থানের কারণে। আমাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একটি জায়গায় এসে স্থবির হয়ে পড়েছে। আর তা হলো নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দুই জোটের মুখোমুখি অবস্থান। এই পরিস্থিতিতে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি এবং আলাপ-আলোচনার মুখ্য বিষয় দাঁড়িয়েছে দুই দল বা জোটের জন্য সমতল ভূমি সৃষ্টি করতে হবে।

এ কথায় অন্তত বাহ্যিকভাবে সবাই একমত। কিন্তু গোল বেঁধেছে এই সমতল ভূমির সংজ্ঞা, চিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এখানে সবাই একমত হতে পারছে না। পূর্বের অভিজ্ঞতায় ধরে নিই একপর্যায়ে দুই দলের জন্য একটা সমতল ভূমি সৃষ্টি হবে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাও কি বলা যায় না যে, দুই পক্ষ মাঠে নেমে কালো টাকা, সন্ত্রাস এবং ধর্মের নামে অধর্মীয় বিষ ছড়িয়ে জনগণকে হাতের পুতুল ও পায়ের ফুটবল বানাবে? সংবিধানে বলা হয়েছে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক।

এ কথা মানলে অবশ্যই বলতে হয় রাজনৈতিক দল বা তাদের প্রতিনিধিদেরই তো জনগণের হাতের পুতুল বা ফুটবল হওয়ার কথা। ইচ্ছা করলে দুষ্ট পুতুলের গলা টিপে জনগণ মারতে পারবে, আর অপছন্দের ফুটবলকে ছুড়ে মাঠের বাইরে ফেলে দেবে। বাংলাদেশের জনগণ কি এখন এই ক্ষমতা ভোগ করে বা আছে? এ প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক নিশ্চয়ই। তাই এই ক্ষমতা জনগণের কাছে নেই কেন সে উত্তর সবার খোঁজা উচিত। রাজনীতি হচ্ছে সব নীতির রাজা।

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটা রাজনৈতিক সত্তা কাজ করে, চাই সে কোনো দল সরাসরি করুক বা না করুক। যার মনের ভেতরে এ রকম ভাবনা কাজ করে না তাকে মনীষীরা মানুষের সংজ্ঞায় আনতে নারাজ। সুতরাং রাজনীতির খেলার মাঠে বিপরীত দলের সমতল ভূমি যেমন দরকার, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের জন্য সমতল ভূমি। দুই দল খেলতে নেমে কালো টাকা, সন্ত্রাস ও ধর্মের অপব্যাখার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ে যাতে ফাউল খেলা খেলতে না পারে, শুধু ক্ষমতার মোহে একশ্রেণীর রাজনীতিক জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য, হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পদদলিত করে রাষ্ট্রের মান-মর্যাদাকে যেন ধুলায় ভূলুণ্ঠিত করতে না পারেন। এখন প্রশ্ন আসবে একটি রাষ্ট্রের রাজনীতিতে জনগণের সমতল ভূমি কোনটি এবং তার বৈশিষ্ট্যইবা কি? আমি নিজে কোনো রাজনৈতিক পণ্ডিত নই।

তাই বড় বড় তত্ত্বীয় কথায় আমি যাব না। বাস্তবতা ও ইতিহাসের নিরিখে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। একটি গাছের শিকড় যতবেশি পরিপুষ্ট ও বিস্তৃত সে গাছের ডালপালা তত বেশি শীতল ছায়া বিস্তার করে এবং বেশি সুস্বাদু ফল দেয়। পরগাছার শিকড় বিস্তৃত হতে পারে না। তাই তা মানুষের তেমন উপকারেও আসে না।

একই সূত্রে একটি রাষ্ট্রের জন্মের সময় যে শিকড় সমগ্র মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে রোপণ করেছে তার পরিচর্যা ও বিস্তৃতির উপর ওই দেশের মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ সব কিছু নির্ভরশীল। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এখন সবার জানা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা সবকিছু নিজের হৃদয়ে ধারণ করেছেন। তারপর মানুষের প্রতি নিজের ভালোবাসার হৃদয়ের মধ্যে সেগুলোকে পরিশীলিত করে পুনরায় মানুষের কাছে এবং বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর হৃদয় থেকে যে দর্শন ও আদর্শ বের হয়েছে তা জাতির ঐক্যবদ্ধ দর্শন হিসেবে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আর সেই আদর্শের জন্যই ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সে কারণেই পণ্ডিতরা বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। একটিকে বাদ দিলে অন্যটির অস্তিত্ব থাকে না। সেই আদর্শের প্রধান কথা ছিল ধর্মের মহান মর্যাদা রক্ষা করার জন্যই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে ধর্মকে আলাদা করে রাখতে হবে। রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার থাকবে।

থাকবে গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজনৈতিক দল ও নেতারা পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে একীভূত হয়ে বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তারা এদেশে পুনরায় রাজনীতি করতে পারবে না। একই সঙ্গে রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য জামায়াত, রাজাকার ও আল বদরের যে সব সদস্য যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার উপযুক্ত বিচার সম্পন্ন করতে হবে। তাই বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের শিক্ষার সূত্র ধরে বলতে হবে বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িত উপাদানগুলোই হলো বাংলাদেশের রাজনীতির খেলার মাঠের জনগণের জন্য সমতল ভূমি এবং বাধ্যবাধকতা। এগুলোকে প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊধের্্ব রেখে প্রতিটি দল তাদের নিজ নিজ ক্ষমতার মেয়াদে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি খাতে কে কতটুকু করতে পেরেছে, আগামীতে কীভাবে কতটুকু করতে পারবে তা মানুষের কাছে তুলে ধরবে।

তখন মানুষের জন্য হিসাব মিলানো সহজ হবে, সাধারণ অংকের সূচকে মানুষ তা দেখতে পারবে। তখন রাজনৈতিক দলগুলো ছদ্মবেশ ধারণ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্ম গেল, দেশ ধ্বংস হয়ে গেল, দেশ বিক্রি হয়ে যাবে, অমুক দল দেশদ্রোহী- এসব অদৃশ্য, অবাস্তব ও অপরিমাপনীয় ভাসমান কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। ভোটের সময় মানুষ প্রার্থীকে সোজা বলতে পারবে বিদ্যুৎ, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আপনার বা আপনার দলের আমলনামা নিয়ে আসেন। আমলনামা দেখেই মানুষ ভোট দেবে। আর মানুষ যখন ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে আর্থিকভাবে সচ্ছল হবে, খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, তখন আর কোনো রাজনৈতিক নেতার পেছনে মষের পালের মতো অন্ধ হয়ে ছুটবে না। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পর সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ অন্যায়, দুঃশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আর সোচ্চার হবে। তাই সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দূর করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের প্রতিবাদী হওয়ার ক্ষমতা অর্জন। বিগত কয়েক বছরে ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক ক্ষমতায়নের অগ্রগতির দিকে তাকালে বোঝা যায় মানুষ এ লক্ষ্যে জোর কদমে এগুচ্ছে।

ধর্মের নামে যত সহজে মানুষকে উত্তেজিত করা যায় এবং কাছে টানা যায়, কাজের মাধ্যমে করা যায় না।

আর ধর্মের নামে যদি মানুষকে উন্মত্ত রাখা যায় তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে নিজেদের ভাগ্য গড়া সহজ হয়। তখন মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা মনে করে এখন ভাত-কাপড়ের খবর নেওয়ার সময় নয়, এখন ধর্ম রক্ষা করাই প্রধান কাজ। ইতিহাস ঘাঁটলে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। ইউরোপ আজ উন্নয়নের স্বর্ণ সোপানে পৌঁছেছে। তার অন্যতম কারণ তারা সব দেশ একযোগে মধ্যযুগের গির্জাকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহের সংস্থা ওআইসির ৫৭টি দেশের মধ্যে জাতিসংঘের সংজ্ঞায় একমাত্র উন্নত দেশ তুরস্ক। এটি সম্ভব হয়েছে সেই কামাল আতাতুর্ক ত্রিশ দশকের শুরুতে তুরস্কের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে। ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আবদ্ধ আরব দেশগুলো ধনী কিন্তু উন্নত নয়। সে কারণেই আরব দেশগুলোর মুসলমানরা পশ্চিমা বিশ্বকে নাসারা বলে গালি দিলেও, আবার সেই নাসারাদেরই ক্রীড়নক হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এখন দেখা দরকার মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের ওপর নির্মিত জনগণের রাজনীতির সমতল ভূমি থেকে রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা কে কতদূরে আছে।

মানুষের কাছে এখন সব কিছু স্পষ্ট। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলার প্রয়োজন নেই, নিবন্ধের পরিসরেও তা কুলাবে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আরোহণ, রাজনৈতিক দল গঠন, তার রাজনৈতিক মত ও পথের সঙ্গী কারা ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ধর্মীয় রাজনীতি ও জামায়াতকে নিষিদ্ধের কবল থেকে জিয়া কর্তৃক তাদের উদ্ধার, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও তার বিচার না হওয়া, এবং বর্তমান সময়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের ও জামায়াত রক্ষায় যে ভূমিকা নিয়েছে এসব কর্মকাণ্ড যে কেউ ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তার বুঝতে কষ্ট হবে না যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নির্মিত জনগণের সমতল ভূমি থেকে বিএনপি কত দূরে আছে। ষাটের দশকে ইতিহাসের মাইলফলক সৃষ্টিকারী একেকটি ঘটনা, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মার্চ মাসের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা প্রবাহের ফলই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। এই ঘটনাগুলোর বিষয়ে যারা নিশ্চুপ থাকে, আমলে নেয় না, তারা জনগণের আকাঙ্ক্ষিত সমতল ভূমিতে আছে, সে কথা কি বলা যায়?

জিয়াউর রহমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় দ্বিতীয় লাইনে বাহাত্তরে সনি্নবেশিত 'জাতীয় মুক্তি' এবং 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের' স্থলে যথাক্রমে 'জাতীয় স্বাধীনতা' ও 'ঐতিহাসিক যুদ্ধ' কেন সন্নিবেশিত করলেন? এ দুটি মাত্র কথা পরিবর্তনের গভীরে ঢুকলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন বিএনপির রাজনীতির শিকড় ও অবস্থান কোথায়।

বুঝতে পারবেন কেন তারা জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের পরিত্যাগ করতে পারছে না।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন দল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান তারা বাহাত্তরে বাংলাদেশকে উপহার দিতে পেরেছে। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার পর অনেক চড়াই-উতরাই ও কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ ও কঠিন পথ-পরিক্রমায় উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে মাঝে মধ্যে আওয়ামী লীগেরও যে পদস্খলন হয়নি তা বলা যাবে না।

কখনো কখনো নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করেও হাঁটার চেষ্টা করেছে। পঁচাত্তরের পর রাজনীতির বাস্তবতার ছিদ্রপথে আওয়ামী লীগের মতো মাল্টি ক্লাস দলের অভ্যন্তরেও অনেক বিজাতীয় লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আবার তারা বেরও হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সব চেয়ে বড় ব্যর্থতা তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহকের একমাত্র বড় দল হয়েও সমআদর্শের অন্যান্য দল ও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেনি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধবাদীরা সবাই একগোছা। আবার আওয়ামী লীগের বড় গুণ হলো যখনই তারা আদর্শগত পদস্খলনের পথে পা বাড়িয়েছে, তখনই জনগণের চাপে তারা ভুল সুধরিয়ে অনতিবিলম্বে মূল জায়গায় ফিরে আসতে পেরেছে।

এ কারণেই ৪০ বছর পর হিমালয়সম ঝুঁকি, শুধু ক্ষমতা হারানোর নয়, দলের নেত্রী শেখ হাসিনার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা শতভাগ বাঙালির আকাঙ্ক্ষা পূরণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের অবস্থান বুঝতে মানুষের বেগ পাওয়ার কথা নয়। বিএনপিও জানে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নির্মিত মাঠই বাংলাদেশের মানুষের জন্য সমতল ভূমি। তাই তারা প্রায়শই চিৎকার করে বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। কিন্তু কথা ও কাজের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফারাক রেখে কেন তারা আত্মপ্রবঞ্চনার যন্ত্রণায় ভুগছে সেটি তারা যেমন জানে, এদেশের মানুষও তা বুঝে।

সুতরাং এই প্রবঞ্চনায় বেষ্টিত জায়গা থেকে বিএনপি যেদিন বের হতে পারবে, সেদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত মানের অভাবনীয় পরিবর্তন হবে এবং নির্বাচনকালীন ঝগড়াও অনায়াসে মিটে যাবে। গণতন্ত্রের সুবাতাস ফিরে আসবে। আমাদের মতো মানুষের আর নিরপেক্ষতা হারানোর অপবাদ সইতে হবে না। কিন্তু তাদের রাজনীতির শিকড় যেখানে প্রোথিত, সেই ভয়াবহ শিকল থেকে বিএনপি হয়তো নিজের প্রচেষ্টায় বের হতে পারবে না।

এটা বিএনপির জন্মের ইতিহাস ও তার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বিএনপির মতো একটা বড় দলকে যদি এদেশের মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে চায়, তাহলে ওই বন্দীদশা থেকে বিএনপিকে মুক্ত করার দায়িত্ব জনগণকেই নিতে হবে। ওই পরিত্যক্ত পরাজিত শিকড়ের বন্ধন ছিঁড়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত মাটিতে নতুন করে বিএনপিকে শিকড়ের বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। এই কাজটি বাংলাদেশের মানুষ করতে পারে আগামী নির্বাচনে বিপুলভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : sikder52@gmail.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.