একটা মেয়ের একটু কথা।
সে লেখক। এক অর্থে সে ও সৃষ্টিকর্তা। কিছু চরিত্রের, কিছু কল্পনার, কিছু ছন্দের সৃষ্টিকর্তা। তার কল্পনার জগৎটিতে সে ই বিধাতা।
আচ্ছা সেই জগৎটিতে কি কেউ তার পুজো করে?- এই কথাটি সে প্রায়ই ভাবে। কল্পনার জগৎটিকে সে তার ইচ্ছা মতো সাজিয়েছে। এখানেই সে স্বাধীন, সৃষ্টির আনন্দ এখানেই উপলব্ধি করে সে। তার কল্পনার জগৎ।
জাগতিক কাজে সে খেলার পুতুল কিন্তু এই জগতে সে ই পুতুল নাচায়।
সুতো তার হাতে। আচ্ছা তার সৃষ্টি গুলোর কি কোন অনুযোগ আছে তার প্রতি? কোন অভিমান বা বেদনা? তার নিজ মনের আনন্দ বেদনাই তো এই কল্পনার জগতের কাঁচামাল। সে কি কোন অন্যায় করেছে তার সৃষ্টি গুলোর সাথে? নিজ জীবনের অনুভুতি হতেই সে তাদের সৃষ্টি করেছে। তার নিজ জীবনের প্রতিই তো তার কত অনুযোগ আছে। সে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে তার সৃষ্টি গুলোকে।
স্বপ্নে তার কবিতারা এসে হাজির হয়। কেউ আনন্দে ঝলমল করে, কেউ বা বেদনায় নীল হয়ে ঘোরাঘুরি করে, কেউ বিষন্নতার চাদর গায়ে তাকে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়, কেউ বা একটুকরো জীবনের হয়ে মতো দেখা দেয়। সৃষ্টিগুলোর নির্দিষ্ট আকার হয়তো আছে। কিন্তু কখনই জেগে ওঠার পর সে শত চেষ্টা করেও তাদের কোন আকার মনে করতে পারেন না।
সে তার অসমাপ্ত লেখা লিখতে বসে।
তার মাথায় লেখার আইডিয়ার অভাব নেই। একটা লেখা থেমে গেলে অন্য একটা শুরু করে দেয়া তার কাছে কোন ব্যাপার না। গল্প থেমে গেলে কবিতা, কবিতা থেমে গেলে গল্প। সে এক হাতে লিখে আর একহাতে সিগারেট খেয়ে যায়। গল্প শেষ তো সিগারেট শেষ।
কিন্তু আজ এত অলসতা লাগছে কেন?
সিগারেট আধখান খেয়ে বাকি টুকু এশট্রেতে গুজে দেয়। গল্পের মাঝামাঝিতে এমন একটা যায়গায় আছে সে যেখানে গল্পের পুরোটা থিমই বদলে যেতে পারে। সে কি বদলাবে? আগে থেকে ভেবে কোন গল্প লেখা কঠিন। গল্প যেন নদীর মতো। তার নিজ গতিতে বয়ে যাবে।
কিন্তু তাতে কি গল্প তাকে পরিচালনা করছে না? গল্পকে তো লেখক নিজের মতো করে পরিচালনা করবে এখানে গল্পের নিজস্ব কোন ইচ্ছা থাকার কথা না। ইচ্ছা করলে দুটোই ঘটতে পারে। দুভাবেই লিখা যাক তাহলে- সে ঠিক করে নেয়।
গল্পটিকে একটি খাতায় লেখক নিজ গতিতে প্রবাহিত হতে দেয় আরেকটি খাতায় গল্পটিকে লেখক তার মনের মতো করে প্রবাহিত করে। পাতার পর পাতা লিখে যায় সে।
সাথে দেদারসে সিগারেট শেষ হতে থাকে। গল্পের মুল চরিত্র রৌদ্র। লেখকের অনুভব করে রৌদ্র যেন তার পাশেই বসে আছে। মিটিমিটি হাসছে তাকে দেখে।
লেখক একসময় রৌদ্রকে সে দেখতেও পায়।
হাসিখুশি ছেলেমানুষ চেহারার এক তরুণী। রৌদ্রের হাতের সিগারেটা যেন তার চেহারার সাথে যাচ্ছে না। লেখকের ভ্রুকুঞ্চিত হয়। যে খাতায় লেখক গল্পকে নিজ গতিতে প্রবাহিত হতে দিয়ছেন সেখানে রৌদ্র সিগারেট খায়, ডেসপারেট মেয়ে। অন্যটিতে যেখানে রৌদ্র তার কমান্ড মতো চলছে সেখানেও রৌদ্র ডেসপারেট তবে সিগারেট খায় না।
লেখক এক ধরণের ইলিউশনে ভুগেন।
- কেমন আছো রৌদ্র? লেখক বলে।
- ভাল আছি স্যার। আপনি ভ্রুকুটি করে তাকাচ্ছেন কেন? সিগারেট দেখে?
- হয়তো তাই।
মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ওঠে।
লেখকের হঠাৎ মেয়েটির এই রুপটি পছন্দ হয়ে যায়। ছেলেমানুষী চেহারার এক ডেসপারেট তরুণী কিশোরীদের মতো শব্দ করে হাসছে হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বাহ্- লেখক মনে মনে ভাবেন। পরক্ষণেই তার মনে হয় - এটা তার কল্পনার জগৎ এখানে অন্য কেউ প্রভাব কেন ফেলবে?
লেখক দেখলেন তরুণীটি হাসি থামিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
- স্যার! তরুণীটি বলে।
- বলো।
- আপনি হেসিটেট হচ্ছেন কেন?
- হচ্ছি না তো।
- আমি আপনার কল্পনায় সৃষ্টি। বলতে পারেন আমিও আপনার কল্পনার একটা অংশ। আমি জানি আপনি কি ভাবছেন।
- ঠিক আছে জেনে বসে থাকো। কিচকিচ করে কথা বলে আমাকে জ্বালাবে না ফাজিল মেয়ে।
তরুণীটির মুখটিতে অন্ধকারের ছায়া পড়ে।
লেখক আর তরুণীটিকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন।
তার কল্পনায় কারো প্রবেশাধিকার নেই।
তিনি আবার লিখতে থাকেন। ঝর্ণাধারার মতো শব্দ আসছে মাথায়। গল্পটিকে তিনি দুভাবেই লিখছেন। দেখা যাক কি হয়।
কিছুক্ষণ পরে মেয়েটির আবারো উদ্ভব হয়। এবার মেয়েটি এক মগ কফি নিয়ে হাজির হয়। তার টেবিলে রেখে পাশের চেয়ারে বসে। লেখক কফি নেন। তিনি জানেন এটা একধরণের হ্যালুসিনেশন।
কিন্তু তিনি বেশ উপভোগ করছেন ব্যাপারটিকে। যা তার আশ্চর্যতাকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বললেন:
- তুমি আবারো?
- হুম। অবাক হচ্ছেন আবার কিছুটা উপভোগও করছেন তাই না?
- হ্যাঁ।
- আমার ক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে স্যার।
দেখেন একটু আগে আপনি আমাকে সত্যি ভেবে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন। আমি ও আঘাত পেয়েছি। কিন্তু তাতে আমার ক্ষমতা বেড়ে গেছে স্যার। আমি আপনাকে প্রভাবিত করতে পেরেছি। মেয়েটি সিগারেট ধরায়।
লেখক একমুহুর্ত মেয়েটিকে দেখেন তারপর লেখা আরম্ভ করেন। লেখক একটু পর অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন যে তিনি শুধু ১ নং খাতাটিতে লিখে যাচ্ছেন। যেটায় গল্প নিজের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি দেখেন পাশে মেয়েটি হাসি হাসি মুখে একের পর এক সিগ্রেট খেয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় জেদ চেপে গেল।
তিনি ২নং খাতাটি টেনে নিলেন আবারো। নিজের মতো করে লিখছেন। প্রয়োজন মতো গল্পটিতে কাটছাট করছেন। চরিত্র গুলোকে কখনও কষ্ট দিচ্ছেন কখনও আনন্দে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
একসময় পাশে তাকিয়ে দেখেন মেয়েটিকে দেখা যাচেছ না।
কিন্তু কপালে কারো স্পর্ষ অনুভব করলেন। ফিরে দেখেন তার স্ত্রী। বলছেন:
- তোমার কপাল এতো গরম হয়ে আছে কেন? চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কেন? ব্লাড প্রেশার কি বেড়েছে নাকি!
- ওটা কিছু না। তুমি যাও।
- কিন্তু আমি তো...
- যাও বলছি।
গেট লস্ট!
লেখকের স্ত্রী এসবে অভ্যস্ত। তিনি চলে যান।
লেখক আবারো লিখতে থাকেন। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করতে থাকে তার। মনে হচ্ছে ভেতরের রগ ছিড়ে যাবে।
তবুও তিনি লিখতে থাকেন। পাশে আবারো তিনি মেয়েটিকে দেখতে পান।
- স্যার আমাকে আমার মতো প্রবাহিত করেন।
- তোমাকে বলতে হবে না মেয়ে।
বলে লেখক অবাক হন।
তিনি একটি কল্পনাকে সত্যি ভেবে বসেছেন না তো! মেয়েটি তো তার মাথায় সৃষ্টি। এই মেয়েটিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? দেখলেন মেয়েটি মিটি মিটি হাসছে।
তিনি আবার এক নম্বর খাতাটা টেনে নেন। গল্পটি একটানে শেষ করে ফেলেন। তারপর ২য় খাতাটা টেনে নেন।
নিজের মতো করে লিখতে থাকেন।
একসময় দেখলেন মেযেটি খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
- কি হলো মেয়ে?
- আপনি শেষ করলেন না যে গল্পটা?
- গল্পটিতে নিজ গতিতে প্রবাহিত করলে এর কোন এন্ডিং হয় না। কিন্তু আমি নিজের মতো করে লিখলে এর একটা সমাপ্তি আছে।
- কিন্তু আপনি আমাকে অনিশ্চয়তায় রাখতে পারেন না!
- তাই? আমি কি তাই রেখেছি?
- হ্যাঁ।
আপনি গল্পটা এভাবে শেষ করেছেন ‘ আয়নায় আধো আধো আলোয় রৌদ্র দেখতে পেল অন্য এক রৌদ্র কে। ঠোঁটে চেপে ধরা জ্বলন্ত সিগ্রেটটা উঠানামা করছে। এটি তার সিগ্রেট খাবার এক নতুন কায়দা। হাতে একটা রিভলবার। রৌদ্র নিজ মাথায় রিভলবারটি ধরে।
চোখ বন্ধ করে ট্রিগার চালায়। কিন্তু এই মুহুর্তটিতে যেন সময় থেমে যায়। সব কিছু স্থির হয়ে যায়। বুলেট বের হতে গিয়েও থেমে যায়। সৃষ্টি হয় নতুন এক সময়ের।
সেখানে রৌদ্র নামের কেউ নেই। ’
- তাতে কি?
- আপনি এমন করতে পারেন না। আপনি পুরো গল্পটাকেই বদলে ফেলেছেন! আপনি আমাকে শুণ্য সময়ে হারিয়ে ফেলেছেন!
- সেটা আমার দোষ না। গল্পের দোষ। তুমি বলেছো তোমাকে নিজ গতিতে প্রবাহিত করতে।
আমি তাই করেছি।
- তাহলে আপনি নিজের মতো আমাকে সৃষ্টি করেন।
- তাই তো করছি অন্য খাতাটিতে। কিন্তু সেখানে তোমার প্রবেশাধিকার নেই রৌদ্র। সেখানে শুধুই আমি।
লেখকের হঠাৎ কি যেন মনে হয়। তিনি ২য় খাতাটাকে ও বন্ধ করে দেন। তিনি উঠে পড়েন। যেটা তার চরিত্রের সাথে যায় না।
- স্যার কোথায় যাচ্ছেন?
- আমি আর লিখবো না।
- কেন?
- আমার ইচ্ছা। আমি আর লিখবো না। আর কোনদিন লিখবো না। আমার কল্পনা গুলো থাকুক বন্দী হয়ে।
লেখক একটি সিগ্রেট ধরান।
ধরিয়ে দেখেন মেয়েটি নেই। তিনি আপন মনে হাসেন। তিনি স্ত্রীকে খোঁজেন। হয়তো রাগ করেছে। এই রাগ ভাঙ্গাতে হলে ৩৬৫০ টি লাল গোলাপ লাগবে।
আজ তাদের বিয়ের ৩৬৫০ তম দিন। ১০ম বিবাহ বার্ষিকী। তার স্ত্রী হয়তো ভেবেছে তার মনে নেই। কিন্তু তার ভাল ভাবেই মনে আছে। ফুলও কেনা আছে।
লেখক এবার ফুলগুলো বের করে হাতে নেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।