আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূর্গা পূজোর আর্তিঃ 'আমি হিন্দু' নয় বলুন 'আমি বাঙালি'

জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, যুক্তি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।

আমরা যারা নব্য মুসলমান তাদের আদি ধর্ম হচ্ছে হিন্দু। পাল-সেন সহ অত্যাচারী হিন্দু রাজাদের শাসনে পিষ্ট হতে থাকা ও ধর্মীয় উঁচু নিচু জাতের ফ্যারে পড়ে বাংলার নিম্নবর্গের হিন্দুরা আকৃষ্ট হয় ইসলামে। ইসলামের সার্বজনীনতা, আধুনিকতা ও শান্তির বানীতে স্নিগ্ধ হয়ে ও ভাগ্যের পরিবর্তনে এই হিন্দুরা গ্রহণ করে ইসলাম। প্রথম বখতেয়ার খলজি ১২০০ তে তরবারির মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

ক্ষমতায় টিকেও যান। কারণ ভিতটা আগেই তৈরী করে রেখেছিলেন এদেশে বহু আগেই আগত সুফী সাধক ও আউলিয়ারা। এরপর একে একে মুসলিম শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। শাসক ধর্মের আনুকুল্য লাভের আশায়ও ঘটেছে ব্যাপক ধর্ম বদল। এসবই ঘটেছে নীরবে।

ধর্ম নিয়ে কোনোরকম বাড়াবাড়ি ছিলো না। কোনোরকম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাও শোনা যায় না। বাংলার সর্বশেষ মুসলমান নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার মন্ত্রীসভায়ও অর্থ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন হিন্দুরা। ব্রিটিশরা এলো। গ্রহণ করলো ভাগ করো, শাসন করো নীতি।

ভাগ করলো ধর্মের ভিত্তিতে। ব্রিটিশরা নিজেদের তত্ত্বাবধানে তৈরী করলো কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। যদিও কংগ্রেস মুসলিম লীগ অপেক্ষা অপেক্ষাকৃত সেক্যুলার (মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন দীর্ঘদিন) দল ছিলো। তারপরও এ দলের কেন্দ্রে ও তৃণমূলে হিন্দুত্ববাদী আচরণ স্পষ্ট ছিলো। শুরু হলো দুই ধর্মের নেতিবাচক রাজনৈতিক ব্যবহার।

আমদানী হতে থাকলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের নতুন নতুন তত্ত্ব। সৌদি ওয়াহাবিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চরম প্রতিক্রিয়াশীল মওদুদীবাদেরও জন্ম হলো। জন্ম হলো ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক জামাতে ইসলামের। ব্রিটিশরা টিকে গেলো আরো কয়েক দশক। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্টদের আবির্ভাবে ব্রিটিশদের পতনকে কিছুটা ত্বরান্বিত করলো।

আর ব্রিটিশরা যাবার আগে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে দিয়ে গেলো ভারতকে। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ বেজায় খুশি হলো। সাধারণ হিন্দু মুসলমানরা ভিটে মাটি ছাড়তে বাধ্য হলেন। মুসলিম লীগাররা স্লোগান তুললো, 'হাত মে বিড়ি মু মে পান, লরকে লেঙ্গে পাকিস্তান। ' আর কমিউনিস্টরা বললো, 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়'।

ব্রিটিশরা বিদায় হলো কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নতুন করে আসন গেড়ে বসলো ভারত ও পাকিস্তানে। পাকিস্তান নিজেকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করলো। একে একে পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মের চূড়ান্ত অপব্যবহার শুরু করলো। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইসলাম দুই ভাগ হয়ে যাবে বলেও প্রচার করতে পিছপা হয়নি আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও তাদের শাসন ভাগীদার জামাতে ইসলাম। এদিকে ৬৫'র পাক ভারত যুদ্ধের সুযোগে হিন্দু খেদানো শুরু হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে।

করা হলো 'শত্রু সম্পত্তি আইন। ' ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু বনে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি লুট শুরু হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রদ না করে একই আইনকে ভদ্রস্থ করলেন 'অর্পিত সম্পত্তি আইন' নাম দিয়ে। হিন্দুদের সম্পত্তি ভোগ দখলে আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা পিছিয়ে থাকলো না। জিয়া এসে জামাতকে রাজনীতিতে সক্রিয় করলেন।

এবার জামাত ধর্মের শুধু রাজনৈতিক নয় ব্যবসায়িক ব্যবহারে মনোযোগী হলো। এবং ধর্মের ব্যবসায়ীক ব্যবহারকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব দেখালো। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে 'অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ' নামে একটি বিল আনলো। কিন্তু হিন্দুদের দূর্ভোগ কমলো না বিন্দুমাত্র। এবং আজ অব্ধি এ কালো আইনের মারপ্যাচে হিন্দুরা সম্পত্তি হারাচ্ছেন।

দেশ ছাড়া হচ্ছেন। বাংলাদেশে জামাত, হেফাজত, জেএমবি অপরদিকে ভারতেও উগ্র বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা ও বিজেপির মত সংগঠনকে শক্তিশালী করা হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোতে এরা দু'দেশেই সফলতার পরিচয় দিচ্ছে। যদিও হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও বোধের কারণে এরা শতভাগ সফল হতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলো প্রায় ২০ শতাংশ।

আজ ৪২ বছর পর তা প্রায় নয় শতাংশে নেমে এসেছে। এ পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে আমরা এদেশের মুসলমানরা ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে ধরে রাখতে পারছি না। অথবা যারা ইসলামকে কলুষিত করার জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমন ও সম্পদ লুট করছে আমরা তখন ইসলামের মান রক্ষার্থে নিজেদের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছি না। হিন্দুদের উপর এ অনাচারের বিপরীতে হিন্দুমনে তৈরী প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার করছে ইসকনের মত কিছু ধর্মাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠান। এরা সংক্ষুব্ধ হিন্দুদের ব্যবহার করছে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে।

এরা কেউ কেউ ভারতীয় বিভিন্ন হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। কিছু সংগঠনের আর্থিক যোগানদার খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেমনটা আমরা দেখি ইসলামী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পৃষ্ঠপোষকও আমেরিকা সহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। ফলে দেখা যায় জামাতের ডাকা হরতালে মার্কিনী রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরে জামাত শিবির কর্মীরা ভুলে হামলা করলে পরবর্তীতে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ওয়েবসাইটে ক্ষমা চায় এবং পত্রিকাতে বিবৃতি দেয়। কয়েকদিন আগে হেফাজতের মাদ্রাসায় বৈঠক করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ান রাষ্ট্রদূত।

সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে সকল রকম অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর যোগানদাতা। মূলত সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীলতা টিকিয়ে রাখতে তারা জাতিগত-ধর্মীয় বিভিন্ন দ্বন্দ্ব সংঘাতকে উস্কে দেয়। আমরা দেখি দেশের যেকোনো সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের লুটেরা বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি শাসক দলগুলো কিভাবে বিদেশী দূতাবাসগুলোর কাছে ধর্না দেয়। এদেশে ইসলামি মৌলবাদের সাথে সাথে হিন্দু মৌলবাদেরও উত্থান চাইছে সাম্রাজ্যবাদ। ফেসবুক সহ বিভিন্ন ব্লগে 'আমি হিন্দু' জাতীয় লাইক পেজের অস্তিত্ব ও কর্মকান্ডও বাড়ছে।

এমনকি কিছু কিছু সংগঠন তৈরী হচ্ছে যারা বিভিন্ন লিফলেট বিলি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রেসিজম ছড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি আশা করি এদেশের হিন্দু বন্ধুরা ইসলামি মৌলবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরুপ হিন্দু মৌলবাদের সমর্থক হবেন না। এতে আখেরে ইসলামি মৌলবাদকেই নতুন নতুন দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরীর সুযোগ করে দেয়া হবে। আরেকটি কথা বলতে চাই। 'ফিজিক্যালি ইন দ্য বাংলাদেশ বাট মেন্টালি ইন দ্য ইউএসএ।

' এ লাইনটা প্রথম শুনেছিলাম ফিডব্যাকের 'বঙ্গাব্দ ১৪০০' এলবামে মাকসুদের গলায়। তখন বেশ মজা পেয়েছিলাম শুনে। এরপর এ ধরনের প্রবণতা ও সমস্যার আবর্তে ঘুরতে থাকা মানুষ কম দেখিনি। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বেশিরভাগ মানুষকে দেখলে আমার মনে হয় 'ফিজিক্যালি ইন দ্য বাংলাদেশ বাট মেন্টালি ইন দ্য ইন্ডিয়া। ' আমার হিন্দু বন্ধুরা রাগ করতে পারেন কিন্তু পূজা মন্ডপগুলোতে ঢালাও হিন্দী গানের বাদ্যে এ অভিযোগ কিছুটা হলেও প্রমাণ হয়।

শুধু হিন্দু ধর্মীয় আবেশ থাকা হিন্দী গানগুলো বাজলে আপত্তির জায়গা ছিলো না। কিন্তু মন্ডপগুলোতে নিখাদ হিন্দী প্রেমের গানই শুনি বেশি। যেখানে বাংলা গানে প্রেমের কোনো কমতি নেই। সবশেষে সকলকে 'শারদীয় শুভেচ্ছা'


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।