প্রগিশীল, মুক্তমনা, সমঅধিকার এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী
১৯৪৭ সালের পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান মিলে অবিভক্ত দেশের নাম ছিল ভারতবর্ষ- যাকে ভারতীয় উপমহাদেশও বলা হয়। এই উপমহাদেশে কবে প্রথম মনুষ্য বসতি শুরু হয়েছিল তা নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। ৫ লক্ষ বা আড়াই লক্ষ বা ৭৫ হাজার বছর পূর্বে যে কোন সময়ে আদিমানবরা ভারতবর্ষে এসে বসিত স্থাপন করেছিল বলে বিভিন্ন গবেষণাভেদে জানা যায় । কিন্তু এ কথা সত্য যে, সভ্যতা বিকাশলাভের গোড়াপত্তনে তাদের বহু সহস্রাব্দ চলে যায়। আধুনিককালে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং গবেষণা পরিচালনায় জানা যায়- খ্রীষ্টপূর্ব ৯০০০-৭০০০ পর্যন্ত প্রস্তর যুগ এবং খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০০-৩৩০০ শতাব্দী পর্যন্ত ‘মেহেরগড়’ নামে অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম সভ্যতা বিরাজিত ছিল।
এরপর একে-একে খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে সিন্ধুসভ্যতা, খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ পর্যন্ত বৈদিক যুগ, খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০-৪৮৩ পর্যন্ত লৌহযুগ, খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০-৫৫০ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, ৫৫০-১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় সভ্যতা, ১৫২৬-১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর-মধ্যযুগীয় সভ্যতা, ১৬১২-১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পর্তুগীজ, ডাচ, ফরাসী এবং বৃটিশ কর্তৃক ভারত-শাসনের যুগ বিরাজ করে। এরপরের ইতিহাস একেবারেই হালনাগাদ- যা সকলেরই জানা, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ তৃখণ্ডে ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
উপরোক্ত বিভিন্ন সময়কালে ভারতবর্ষে নৃতাত্ত্বিকভাবে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। তবে জাতিগতভাবে আদিকালে এ ভূ-অঞ্চলের প্রথম জনগোষ্ঠী ‘হিন্দু’ বলে পরিচিত। বৈদিক ও প্রস্তরযুগে সিন্ধু নদের অববাহিকায় এই জনগোষ্ঠীর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে ‘সিন্ধু’ শব্দের অদ্যাক্ষর ‘স’-এর স্থলে ‘হ’ উচ্চারণ করে এ ভূখণ্ডে বসবাসকারীদেরকে ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করা হয়।
মতান্তরে ‘হিন্দু’ একটি ফার্সি শব্দ - যার অর্থ হচ্ছে ‘কালো’, অর্থাৎ ভারতবর্ষের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ‘কালো’ বিধায় তাদেরকে ‘হিন্দু’ নামে অবিহিত করা হয়। সঙ্গত কারণে হিন্দুদের জীবনাচার, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঈশ্বরীয় বিশ্বাস ও তা লালন-পালন থেকে ‘হিন্দুধর্মের’ আবির্ভাব ঘটে। তবে বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টপূর্ব ৫২৮ সালে ‘বৌদ্ধধর্মের’ আর্বিভাবের পূর্বে ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডে হিন্দুধর্মের একছত্র আধিপত্য বিরাজ করে । যদিও ঔ সময় পর্যন্ত ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিবাসীদের ধর্মকর্মে ততটা আনুষ্ঠানিকতার বালাই ছিল না। বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবের পরই ধর্মকর্ম পালনে অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত ঘটে।
তাই হিন্দুদের ব্যাপক এক জনগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ অপেক্ষাকৃত অধুনিক ও উদার বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ক্রমান্বয়ে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। পরবর্তীতে দ্বাদশ শতাব্দীতে সুফিসন্তদের কর্তৃক ‘ইসলাম’ ধর্ম প্রচার এবং ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমান শাসকদের কর্তৃত্বের ফলে বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসারলাভ ঘটে। বলা বাহুল্য, ধর্মান্তরের এ পক্রিয়ার হিন্দু এবং বৌদ্ধ- এই উভয় ধর্মাবলম্বীরা নানাবিধ কারণে ব্যাপকহারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
বিভিন্ন সময়ে সংখ্যায় স্বল্প হলেও ভারতবর্ষে শিখ, জৈন, পার্সী প্রভৃতি ধর্মের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আর মুঘল শাসনের ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণুতা এবং অবসানের পর ইউরোপীয় বণিক ও শাসকদের প্রভাবে খ্রীস্টধর্মেও বেশ কিছু ভারতীয় ধর্মান্তরিত হয়।
এভাবে বিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতবর্ষে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, পার্সী প্রভৃতি সব ধর্মের অনুসারীদেরকে কমবেশি বিদ্যমান দেখা যায়। এতে বিভিন্ন সময় ধর্মেধর্মে সংঘাতও দেখা যায়। তবে তারও পূর্বে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং জ্ঞান, কর্ম ও পেশার ভিত্তিতে ভারতবর্ষে নানান জাত-পাতের সৃষ্টি ‘করা হয়’। এভাবে বহুধা বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক এবং গোষ্ঠীগত সংঘাতের সূত্রপাত ‘ঘটানো হয়’।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের বাঁকে-বাঁকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বিচিত্র ভূমিকা পরিলক্ষিত ।
ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে তাদের ভিন্ন-ভিন্ন ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ধর্মীয় এবং ভূ-আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রভাবই মুখ্যত কাজ করে । আর এতে প্রভাবশালী এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জনগণের উপর যাদুকরী প্রভাব বিস্তার করেন । ফলে যে জনগোষ্ঠী বিংশ শতাব্দীর ৩০-৪০ দশকে ভারত বিভাজনে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে রায় ঘোষণা করে, সেই একই জনগোষ্ঠী ৫০, ৬০ ও ৭০ দশকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য, উভয় ক্ষেত্রেই জনগণের একাংশ বিরোধী ভাবধারার অনুসারী হলেও তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ ।
উপসংহারে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষণে বাংলার আধুনিককালের বাসিন্দাদের ধমনীতে আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, মারাঠী, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান প্রভৃতি জাতি ও ধর্মের জনগোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত।
এসব জাতিগোষ্ঠী এবং ধর্মের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, কৃষ্টি আর সামাজিক ব্যবস্থার উপাদানসমূহ নিয়েই কালক্রমে নৃতাত্ত্বিকভাবে গড়ে উঠেছে অভিন্ন ‘বাঙালি’ জাতিসত্তা । তাই শংকর বটে, বাঙালি এই অধিবাসীরা কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় সাময়িক রেশারেশি, দ্বন্দ্ব, এমন কি সংঘাতে লিপ্ত হলেও তারা মূলত একই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যতানে আবদ্ধ । ধর্মীয় আচার-আচরণটুকু ভিন্ন এখানার গণমানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে ঈদ, পুজো, বৌদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন বা নববর্ষ উদযাপন করে । মূলত বাংলাদেশ গণমানুষের অনন্য এক সম্প্রীতির দেশ । কোন ধর্মীয় মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাময়িক বিভ্রান্তি, গোলযোগ বা বিশঙ্খলা সৃষ্টিতে সক্ষম হলেও তারা বাঙালির ঐক্যতানের জায়গায় কোনদিনও ফাটল ধরাতে পারবে না ।
বাঙালি সমহিমায় তাদের স্বকীয়তা নিয়ে টিকে থাকবে চিরন্তন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।