বোকারা ভাবে তারা চালাক, চালাকরা ভাবে তারা চালাক। আসলে সবাই বোকা। বোকার রাজ্যে আমাদের বসবাস
১৯৮৯ সালের কোন এক শীতের সকাল। খুব সকালে চারদিক কেমন ঘোলাটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। বছর শেষে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ।
প্রতিবছর এই সময়টা আমি আমার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে চলে যাই। সেই বাসার আমার সমবয়সী এক আত্মীয় বন্ধু যার সাথে ডিসেম্বরের সেই ছুটির আনন্দঘন সময়গুলো কাটাতাম। প্রতি ডিসেম্বর তাদের বাসায় কাটানো ছিল আমার ফি বছরের রুটিন। এই সময়টায় আমরা ভীষণ মজা করতাম। বিশেষ করে বিজয় দিবস উদযাপন আজো স্মৃতিকাতর করে তোলে।
তো যাই হোক সেই ১৯৮৯ সালের এক সকালে আমার খুব প্রিয় একটি শখের হাতেখড়ি হল। মাত্র আগের বছর দেশে হয়ে যাওয়া ৩য় এশিয়া কাপের খেলা মাঠে যেয়ে দেখার প্রবল ইচ্ছা থাকার সত্ত্বেও দেখতে পারি নাই। তাই যখন আগের রাতের সেই আত্মীয় বন্ধুর বাবা (সম্পর্কে আমার নানা) আমাদের দুজনকে বললেন যে আগামীকাল ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ক্রিকেট খেলা দেখাতে নিয়ে যাবেন, আমি তো আনন্দে আত্মহারা। টুর্নামেন্টের নাম “বেক্সিমকো এশিয়া যুব কাপ”। তো সেই দিনের সেই খেলার কথা মনে হলে মনে পরে সাবেক শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক মারভান আতাপাত্তুর কথা।
সেই অনূর্ধ্ব ১৯ শ্রীলঙ্কান দলের সদস্য ছিলেন এই ক্রিকেটার। সেই ম্যাচ দিয়ে আমার বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার ফ্যান্টাসি শুরু। এর পর কতদিন কতবার যে ক্রিকেটের টানে মাঠে ছুটে গেছি তার ইয়াত্তা নেই।
তো ১৯৮৯ এর সেই টুর্নামেন্টের পরে যতসম্ভব ১৯৯২ সালের সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং এর পর ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে আসে করাচী জিমখানা ক্রিকেট ক্লাব। উভয়টিই দেখতে মাঠে গিয়েছিলাম।
সেই টিনএজের শুরুতেই আমার প্রথম প্রেম বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে। এরপর যখনই সময় পেয়েছি ছুটে গেছি আমার বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে। তো ১৯৯৪ থেকে ছুটে যেতাম ঘরোয়া ক্রিকেট লীগ দেখতে, যত সম্ভব তখন নাভানা প্রিমিয়ার লীগ আর দামাল সামার টুর্নামেন্ট বেশ জনপ্রিয় ছিল। আবাহনীতে খেলতে যখন ফিলিপ ডিফ্রেটাস, নেইল ফেয়ারব্রাদার, ওয়াসিম আকরাম প্রমুখরা এলেন তখন ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকা স্টেডিয়াম এই স্বপ্নের বিদেশি খেলোয়াড়দের দেখতে। এর পর এলেন তখনকার সেন্সেশনাল ক্রিকেট প্লেয়ার জয়সুরিয়া।
আহা! ঢাকা স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নাই।
১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে দুই দুইটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করে বাংলাদেশ। একটি “ইন্ডিপেনডেন্ট কাপ” অন্যটি “মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ” যা আজো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তো এই দুটি টুর্নামেন্টের খেলা তখন দেখে খুব ফুর্তি করেছি। বিশেষ করে টিকেট কাটার কথা মনে পরলে আজো হাসি পায়।
ভোর রাতে গিয়ে লাইন দেয়া, হরতালের দিন টিকেট বিক্রি বন্ধ থাকার পরও ব্যাঙ্কে যেয়ে লাইন দেয়া এবং অবস্থা সামাল দিতে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের পুলিশ ডাকা, পুলিশের লাঠির বাড়ি খাওয়া... আরও কত কি। এইসব মধুর যন্ত্রণা পোহানোর পর যখন বিজয়ীর বেশে টিকেট নিয়ে বের হলাম... আহ যেন যুদ্ধ জয়ী সেনাপতি একখান। সেই টুর্নামেন্টে একটি ১৫০ টাকার টিকেট ২০০০ টাকায়ও বিক্রয় হয়েছে। পুরো টুর্নামেন্টে দল বেঁধে মাঠে গিয়ে খেলা দেখেছি।
এবার আসি আমার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে।
তখন স্কুলের গণ্ডি পেরোই নাই, ১৯৯৩র আইসিসি ট্রফি, কেনিয়ার নাইরোবি থেকে রেডিওতে খেলার ধারা বিবরণী প্রচার হত। সারাদিন বসে বসে শুনতাম আর গলা ফাটাতাম। কিন্তু কিশোর হৃদয়ে দাগা দিয়ে ব্যর্থ হল আমার দেশ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে। কৈশোরের রেশ কাটিয়ে কলেজের গণ্ডিতে এসে পেলাম ১৯৯৭ সালে এলো আবার সেই স্বপ্নের আইসিসি ট্রফি, ভেনু এবার মালেয়শিয়া। এখনো কানে বাজে ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফাত এর কণ্ঠ – “মালেয়শিয়া কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠ থেকে আমি চৌধুরী জাফরউল্লাহ সারাফাত আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি...”।
স্বপ্নের সেই ট্রফি জিতে আমরা কোয়ালিফাই করি বিশ্বকাপের মর্যাদাপূর্ণ আসরে। আহ কি সেই বিজয় মিছিল। মনে আছে শেষ ম্যাচে জেতার সাথে সাথে আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়া পড়ি পতাকা হাতে। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো এক বেবিট্যাক্সি (তখন সিএনজি ছিল না) চালক আমাদের দুজনকে ডেকে বলল তার গাড়ীতে উঠতে। তারপর তার বেবিট্যাক্সির দুইদিক দিয়ে আমরা দুইভাই পতাকা হাতে স্লোগান তুলে মুখর করেছি পড়ন্ত বিকেলের বাতাস।
পরবর্তীতে তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এর বিজয় র্যালিতে গিয়েছি।
এরপর ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিজয়। আহ কি এক খেলা, চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। সেই বিশ্বকাপ এলাকার এক ক্লাবে ছোট-বড় ৩৯ জন মিলে চাঁদা দিয়ে টেলিভিশন ও ক্যাবল কানেকশন নিয়ে মহা আয়োজন করে দেখতাম। মনে আছে আমার একটি নিজের ডিজাইন করা টিশার্ট ছিল ঐ বিশ্বকাপের জন্য।
বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচের দিন সকাল থেকে আমি ঐ টিশার্ট পড়ে ঘুরতে থাকতাম। শেষে যেদিন পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জিতলাম সেদিন এক বড় ভাই আনন্দের অতিশহ্যে পতাকা আটকানো বাঁশ দিয়ে আমার মাথায় দিল এক বাড়ি... হা হা হা কি মজার সেই দিনগুলো। ও হ্যাঁ একটি কথা মনে পরে, পরদিন সকালে বিজয় মিছিল করতে করতে আমরা যখন পুরাতন ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, তখন ডাস এর পেছনের মাঠে বিটিভি’র ক্রীড়া রিপোর্টার অনুপম সাক্ষাতকার নিচ্ছিল সবার। তো আমিও দেই সেই সাক্ষাৎকার যা তখন প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল...... আর যায় কোথায়?... আমিতো মামা বাসায় তখন হিরো।
২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেল, ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতের সাথে খেলা।
এলাকা থেকে প্রায় ২০ জনের দল নিয়ে লাল সবুজের টি-শার্ট (যা আমরা বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম) পড়ে ড্রাম নিয়ে মাঠ মাতিয়ে দেখেছিলাম সেই খেলা। আহ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম... .. .
শুধু যে আনন্দের স্মৃতি আছে তা নয়, অনেক মন ভাঙ্গা দুঃখের প্রহর আছে এই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ঘিরে। ১৯৯৩ সালের সেই আইসিসি ট্রফির যাতনা দিয়ে শুরু বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ঘিরে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। এরপর বহুবার বুক ভেঙ্গেছে। কিন্তু সেই ক্ষতে প্রলেপ হয়ে একসময় এসেছে বহু স্মরণীয় জয়, বহু স্মরণীয় অর্জন।
কেনিয়ার বিপক্ষে রফিকের সেই ওপেনিং ইনিংস, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ৯৫ অথবা অপির সেঞ্চুরি। কি ওপেনিং জুটিই না ছিল তারা। এরপর আশরাফুল এল, এল আফতাব, অলক কাপালি, শাহরিয়ার নাফিস, মাশরাফি, রাজিন সালেহ, তামিম, সাকিব। ও হ্যাঁ অবশ্যই তার আগের প্রজন্মে দেখা মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, জাহিদ রাজ্জাক মাসুম, গোলাম নওশের প্রিন্স, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, এনামুল হক মনি, হাসিবুল হোসেন শান্ত, জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা, আল শাহরিয়ার রোকন, নাইমুর রহমান দুর্জয়, হাবিবুল বাশার সুমন, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট এদের কথা হৃদয়ের মণিকোঠায় রয়ে যাবে। সর্বশেষ গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ড ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখেছিলাম।
যে কারনে এত কথা আজকের লেখায়, গতকাল বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দেখে পুরানো আমার প্রথম প্রেম বাংলাদেশের ক্রিকেটের কথা মনে পড়ে গেল। এই আমার বাংলা মায়ের ক্রিকেটের দামাল ছেলেরা। তোমরা আমার জনম জনমের প্রথম প্রেম হয়ে রবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। আমার জন্মের পর থেকে অদ্যাবধি দেশের তথাকথিত রাজনৈতিকেরা আমার মুখে একবারের জন্যও হাসি ফুটাতে পেড়েছে বলে মনে পরে না। কিন্তু বাংলা মায়ের দামাল ক্রিকেটার ছেলেরা কতবার যে এই পোড়া চোখে আনন্দ অশ্রুর বান এনেছে তার হিসেব আমি দিতে পারব না।
তোমাদের জন্যই শত যাতনা ভুলে গর্ব করি আমার বাংলাদেশকে নিয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।