আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
১৮ অক্টোবর, ২০১৩, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ আশার সঞ্চার করেছিল। নির্বাচন নিয়ে যে সন্দেহ-বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী তা সমাধানের সুপ্রশস্ত পথ দেখিয়েছেন। প্রথম চালেই তিনি তুরুপের তাসটি মারলেন এবং তা ছিল বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কোচিত।
বিরোধী নেত্রী হতাশ করলেন।
তিনি প্রস্তাবটি শোনেননি অথবা তা যথেষ্ট মনযোগ ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে বিবেচনা করেননি। তিনি নিজের কথা পুনরাবৃত্তি করলেন। সঙ্কট নিরসনের জন্য রাষ্ট্রনায়কোচিত দায়িত্ববোধ ও গভীরতা তাঁর বক্তব্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।
শেখ হাসিনার প্রস্তাব সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নাগরিকগণ ধারণ করেন, অন্য কেউ নয়। তাঁদের নির্বাচিত আস্থাভাজন প্রতিনিধিগণই সরকার পরিচালনা করবেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করবেন, অন্য কেউ নয়। কোন বিকল্প পদ্ধতিতে গঠিত সরকারের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক বৈধতা নেই।
সংবিধানের ভিত্তির ওপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। সংবিধানকে অস্বীকার বা অমান্য করলে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর অস্তিত্ব থাকে না।
সংবিধানের পরিসীমার মধ্যে সঙ্কট নিরসনের পথ থাকলে, সেই সহজ-সরল পথ অনুসরণ করতে হবে। যারা সে পথ ছেড়ে অন্য পথে গেছে, বিপথগামী হয়েছে, তাদের পথ অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
নির্বাচন সঙ্কটের কারণ ছিল, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে নির্বাচনের ওপর অযাচিত প্রভাব পড়বে কিনা। নির্বাচিত সর্বদলীয় সরকার গঠন করলে সে সন্দেহের আর কোন ভিত্তি থাকে না।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করেন; সরকার কমিশনকে তার প্রয়োজনমতো সকল সহায়তা দেয়।
সরকারী কর্মকর্তাগণ- বিশেষত মাঠপর্যায়ে কর্মরত এবং যাঁরা নির্বাচন সম্পৃক্ত দায়িত্ব পালন করেন, তাদের বদলি/পদায়ন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ ও অনুমতি অনুসারে করা হয়। নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং সরকারের দায়িত্বের পার্থক্য বুঝবার ব্যর্থতা জটিলতা সৃষ্টি করে। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝার ঘাটতি অতি সহজেই দূর হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বেই ঘোষণা দিয়েছেলেন, অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন বিতর্কিত বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে না। এ রীতি বা কনভেনশন সব গণতান্ত্রিক দেশ অনুসরণ করে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি দিশারীর ভূমিকা নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুসরণ করে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন কী প্রকার হবে, তাদের দায়িত্ব-ক্ষমতা কী হবে, সীমাবদ্ধতা কী থাকবে, সংসদে দলের মধ্যে কোন্ দল কয়টি মন্ত্রিত্ব পাবে ইত্যাদি আলোচনা হতে পারত। সেটাই আশা করা হয়েছিল, তাই হতো যুক্তিসঙ্গত ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচ্চমানের দায়িত্ববোধের পরিচয়।
বেগম জিয়া সেই সরল-প্রশস্ত পথে গেলেন না, কবরস্থান হতে উঠিয়ে এনে সঙ্কটকে জীবনদানের চেষ্টা করলেন। তাঁর আচরণে নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রনায়কোচিত দায়িত্ববোধের একান্ত অভাব দেখা যায়।
তিনি এ পথ বেছে নিলেন কেন? বেগম জিয়ার মনে অনেক জটিল ও বিশদ বিবেচনা থাকতে পারে। তবে যেটুকু প্রকাশ করেছেন, তা এক কথায় বলা যায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর তাঁর আস্থা নেই; তাঁর দেয়া রূপরেখা গণতন্ত্র এবং তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নস্যাতের পদক্ষেপ মাত্র। সরাসরি বলতে পারেন না, তাই ঘুরিয়ে বলা।
গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি ও মূল্যবোধ জনগণের সার্বভৌমত্ব; গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এই মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বেগম জিয়ার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আস্থা দুর্বল, তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
অবশ্য সংসদ সদস্যগণ তো তাঁর অপরিচিত। সংসদ বয়কটেই তাঁর বেশি সময় কেটেছে, আর দু-একবার যে গেছেন তাও কয়েকটি কথা উচ্চারণ করে বেরিয়ে আসবার জন্য (ওয়াকআউট)।
জনগণের প্রতিনিধিরাই তাদের পক্ষে সংবিধান রচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পৃথিবীর প্রথম লিপিবদ্ধ সংবিধান। সে সংবিধান খুললেই দেখতে পাবেন লেখা- ‘জনগণের পক্ষে জনগণের প্রতিনিধিগণ সংবিধান অনুমোদন ও গ্রহণ/আরোপ (বহধপঃ ্ ধফড়ঢ়ঃ) করলেন।
’ সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি ও সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। জনগণের প্রতিনিধিগণই বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে (দুই-তৃতীয়াংশ) সংবিধান সংশোধন করতে পারে। সংবিধান সংশোধনের কোন বিকল্প বৈধ পদ্ধতি নেই।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘদিন এবং কয়েক দফায় দেশে সামরিক শাসন বিদ্যমান ছিল। সামরিক শাসকরা বন্দুকের নলের খোঁচায় অথবা ভোট কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপহরণ করে সংবিধান পরিবর্তন করে।
জনগণের পক্ষে নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক সংশোধনের বৈধতা সেখানে অনুপস্থিত। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ/না ভোটে হাস্যকর বিজয় সকলেই জানেন। ভোটারের তুলনায় প্রদত্ত ভোট বেশি!
সামরিক শাসকদের সংবিধান সংশোধনের বৈধ ক্ষমতা নেই। সংবিধান সংশোধন মামলায় (ত্রয়োদশ সংশোধন) মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট এ সম্পর্কে রায় দিয়েছেন। আইন-বন্ধু (এ্যামিকাস কিউরি) অনেকে অনির্বাচিত সরকার বহাল রেখে নির্বাচনের পক্ষে মতামত দেন।
অনেকে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের চেতনা ও মূল্যবোধের সঙ্গে এরূপ ব্যবস্থায় অসঙ্গতি তুলে ধরেন। মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট তাঁদের মতামত বিচার বিবেচনা করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ ও কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মন্তব্য করেন যে, দেশের মঙ্গল বিবেচনায় সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিরোধী নেত্রী কোন কিছু মানতে নারাজ। তাঁর অবস্থান, তাঁর কথাই চূড়ান্ত, সেভাবেই দেশ চলবে, সংসদ-সংবিধান-আইন নস্যিমাত্র, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে একগুঁয়ে-একনায়কত্বের বীজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ নমনীয়তার সঙ্গে সঙ্কট নিরসনের প্রস্তাব দিলেও, বিরোধী নেত্রীর পক্ষে তা গ্রহণ করার পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা আছে।
আর সে বাধা এমন যে বিরোধী নেত্রী তা সোজাভাবে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন, বাঁকা পথে চলে অকার্যকর করবার অপপ্রয়াস করছেন।
বেগম জিয়ার বড় খুঁটি জামায়াত। জামায়াতের নেতারা এবং তাঁর নিজ দলের অনেক নেতা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায়। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। মীমাংসার পথ বেছে নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে জামায়াত এবং অন্য অপরাধীদের ফেলে রেখে আসতে হবে।
রাজনীতিতে আজব শয্যা সঙ্গী হয়; বেগম জিয়া তাঁর পছন্দের সঙ্গীদের নিয়েই শয্যায় থাকবেন। সঙ্কট নিরসনের সর্বোত্তম ও সর্বাপেক্ষা নমনীয় প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না।
তাঁর প্রস্তাব মানতে হলে সংবিধান সংশোধন দরকার। বেগম জিয়া জানেন সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁর নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে নতুন গণজাগরণ দেখা গেছে, তাতে তাঁর দলের এবং সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদনির্ভর ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে জিতবে বা টিকে থাকবে কিনা, সন্দেহজনক।
সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কল্পনাবিলাস মাত্র। তাই তাঁর জেদ জনগণের কাছে না গিয়ে নির্বাচনের আগেই সংবিধান সংশোধন হোক। আগে তাঁরা ভোট ছাড়া জিতেছেন, এবার নির্বাচন ছাড়া জিততে চান। একে ‘উদ্ভট’ পরিকল্পনা বলা যায় না; এটা ‘ভট্উদ পরিপ্যাঁচ। ’
বিরোধী দলের প্রস্তাব ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে যাঁরা উপদেষ্টা ছিলেন, তাদের থেকে ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
তাদের অনেকেই বেঁচে নেই (তাঁদের রূহের মাগফিরাত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য শান্তি কামনা করি)। বেগম জিয়া তাঁদের খোঁজ খবর নেননি, অথবা যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদেরকেই আবার দেখতে চান।
সংবিধান অমান্য করে উপদেষ্টা হওয়ার মতো বিবেকহীন লোকের অভাব সম্পর্কে বেগম জিয়া সচেতন বলে মনে হয়। সংবিধানের ধারা অনুসারে, এ জাতীয় প্রচেষ্টা সংবিধান অমান্য করা এবং সংবিধানের কর্তৃত্ব ধ্বংস করার অপরাধ- যা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য। এ জন্য লোক পাওয়া দুষ্কর।
মনে করেন- আপনি তিন মাসের জন্য একটি সার্কাস পার্টি করবেন এবং সেই পার্টিতে শুধু জোকার থাকবে; তাও আপনি পারবেন না। তথাপি এমন একটি প্রস্তাব কেন এলো? মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে একটিই মাত্র কারণ থাকতে পারে মাথা, অর্থাৎ বুদ্ধি কাজ না করলে, একই কথা পুনরাবৃত্তি করা হয়।
বিএনপির কাঁধে ভর করে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ও বিচারাধীন মানবতাবিরোধী অপরাধী এবং তেঁতুল বুভুক্ষু জামায়াত-হেফাজত। তাদের ভারে বিএনপি যে রাজনৈতিক চোরাবালিতে পা রেখেছে, তা থেকে উঠে আসা দুষ্কর। মুসলীম লীগের ইতিহাসে তাদের জন্য শিক্ষা নিহিত আছে।
সুত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।