আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্রিটিশ ভারতে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ১৩৩তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা

আমি সত্য জানতে চাই
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এক অবিস্বরণীয় নাম। তাঁর রাজনৈতিক মেধা, দক্ষতা আর দেশের মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদের কারণে তিনি জনসাধারণের কাছে 'দেশবন্ধু' নামে পরিচিত ছিলেন। দেশদরদী এই নেতা রাজনীতি করতে গিয়ে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে বহুবার জেল খাটেন। তিনি নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির পক্ষে অবিচল থাকেন। তিনি সব সময় ব্রিটিশবিরোধী লড়াইকে জোরদার করতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেছেন।

একসময় তিনি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে স্বরাজ দল নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্বরাজ দলের প্রার্থী হিসেবেই ১৯২৪ সালে কলকাতা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময়ে তিনি নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ ইত্যাদির পক্ষে অনেক কাজ করেন। বাংলার মানুষের এই প্রিয় নেতা ১৮৭০ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন। মহান এই রাজনৈতিক নেতার ১৩৩তম জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

(কিশোর বয়সে চিত্তরঞ্জন দাশ) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বর তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতভুবনমোহন দাশ একজন আইনজীবী ছিলেন এবং মা নিস্তারিণী দেবী গৃহিনী। চিত্তরঞ্জন দাশের পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের তেলিরবাগ গ্রামে। শিক্ষিত পরিবার হিসেবে তাঁদের পরিবারের যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। চিত্তরঞ্জন দাশের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে।

প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ হওয়ার পূর্বে চিত্তরঞ্জন দাশ শৈশবে তাঁর বাবার সাথে কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসেন। কারণ তখন তাঁর বাবা কলকাতার ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯৭৯ সালে ভবানীপুর লন্ডন মিশানারি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে পাঠ্যতালিকার বাইরের বই পড়তে বেশী পছন্দ করতেন তিনি। যে কারণে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল খুব ভাল হতো না।

চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯৮৬ সালে লন্ডন মিশানারি স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৮৯০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত যান।

বিলেতে থাকার সময় রাজনৈতিক ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসেন এবং আইন পেশা শুরু করেন। ১৮৯৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হয়। পেশা জীবনের শুরুতে তাঁর সামান্য আয় হত। যা দিয়ে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

ট্রামভাড়ার সামান্য পয়সা বাঁচানোর জন্য তিনি হাইকোর্ট থেকে ভবানীপুর হেঁটে যেতেন। আইন পেশার পাশাপাশি গোপনে গোপনে বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯০৩ সালে কলকাতায় প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাস প্রথমে 'অনুশীলন সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি এই সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষের 'বন্দে মাতরম' পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।

ওকালতি করে যে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া যায়, তা দেখা যায় আইনজীবি চিত্তরঞ্জনের জীবন থেকে। রাজনৈতিক বন্দীদেরকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত মারাত্বক অভিযোগের হাত থেকে তিনি মুক্ত করে আনতেন তার অসাধারন মামলা পরিচালনার গুনে। তিনি ১৯০৬ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন। নাগপুর কংগ্রেসে তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করার জন্য আইন ব্যবসা সম্পূর্নরূপে বন্ধ করেন। আইনজীবী হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশের জন্য ১৯০৭ সাল ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ এ সময় তিনি সিভিল ও ক্রিমিনাল উভয় কোর্টেই একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেন। এ সময় কলকাতা কোর্টে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের যত মামলা এসেছে তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে অবিরাম লড়েছেন। শুধু আইনের জগতে নয় , সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাহিত্য চর্চায় মগ্ন। রাজনীতির মধ্যে থেকেও তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন।

সে সময়ের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা 'নারায়ণ'-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। 'মালঞ্চ', 'সাগর সঙ্গীত' ও 'অন্তর্যামী' গ্রন্থের জন্য তিনি কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনসভা বর্জন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি নিজেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব কংগ্রেস অধিবেশনে উত্থাপন করেন এবং গান্ধীজীর ডাকে ব্যারিস্টারি পেশা ত্যাগ করে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বয়ং ভারত সরকার প্রখ্যাত মিউনিশনস বোর্ড ঘটিত মামলায় প্রচলিত নজীর উপেক্ষা করে সাহেব এডভোকেট জেনারেল অপেক্ষা অধিক পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁকে সরকারি কৌসুলী নিযুক্ত করেন।

অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি এ দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। এই অসামান্য ত্যাগের জন্য ভারতবর্ষের জনগণ কর্তৃক তিনি 'দেশবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯২৩ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে মতিলাল নেহেরুর সহযোগীতায় স্বরাজ দল গঠন করেন। হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি সাধনের জন্য তাঁর নেতৃত্বে স্বরাজদল মুসলিম নেতাদের সঙ্গে উভয় সম্প্রদায়ের অধিকার বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের অধিবেশন শেষে দার্জিলিং যাবার পথে ১৬ই জুন ৫৪ বছর বয়সে দেশবন্ধু মৃত্যুবরন করেন।

মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি জনসাধারণের জন্য দান করে যান। সেখানে 'চিত্তরঞ্জন সেবাসদন' প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর মৃত্যুতে বরীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান"। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর জীবনানন্দ দাশ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালকে প্রকাশিত হয়।

চিত্তরঞ্জন দাশ রাজনীতির ক্ষেত্রে জীবনের খুব একটা দীর্ঘ সময় ব্যয় না করেও সকল স্তরের বাঙ্গালীর তিনি ছিলেন বন্ধু। উদার মতবাদ ও দেশের প্রতি দরদের কারণে তিনি হিন্দু মুসলমান সকলের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেন এবং তার এই উদার মতবাদের জন্য জনগণ তাকে দেশবন্ধু খেতাবে ভুষিত করেন। বাঙালি আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাশের আজ ১৩৩তম জন্মদিন, জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.