পাঁচ নেতাকে গ্রেপ্তারের পর বিএনপির প্রায় সব নেতা আত্মগোপন করেছেন। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ধারপাকড় অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত কয়েকটি জেলায় অন্তত ৯৭ জন নেতা-কর্মীকে আটকের খবর পাওয়া গেছে। গতকাল রাজধানীর কোথাও বিএনপির কোনো নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গুলশানে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে, গুলশানে ও নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
দলের কোনো নেতা-কর্মী নেত্রীর বাসা বা দলীয় কার্যালয়ের আশপাশে ঘেঁষতে পারছেন না। সাদাপোশাকের পুলিশের লোকেরা এসব স্থানের আশপাশে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও সেখানে আছেন। খালেদা জিয়া সাধারণত প্রতিদিন গুলশান কার্যালয়ে যান। তবে গতকাল তিনি বাসা থেকে বের হননি।
এসব স্থানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার বাসভবন ও কার্যালয়গুলোতে কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেওয়া হবে না। যাঁরাই ঢুকতে বা বের হতে চেষ্টা করবেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। কেবল সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে এসব স্থানে যেতে-আসতে পারবেন। এ ছাড়া রাতে বিএনপি-সমর্থক শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের পৃথক প্রতিনিধিদল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর বাসভবনে গেছেন। তাঁদের প্রবেশের ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি।
শুক্রবার রাতে ধরপাকড় শুরুর পর বিএনপির নেতাদের মধ্যে কেবল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। তিনি শুক্রবার গভীর রাতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। গতকাল দুপুরে সেখানে সংবাদ সম্মেলনও করেন রিজভী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বশীল নেতাদের মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁরা কোথায় আছেন, সে সম্পর্কেও সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে কয়েকটি কর্মসূচিতে বিএনপির নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তাঁরা আসেননি।
বিএনপির মতো ১৮-দলীয় জোটের শরিক নেতারাও প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন না। তবে বিরোধীদলীয় এই জোটের নেতাদের মধ্যে যাঁরা সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, তাঁদের বেশির ভাগই নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন।
গত শুক্রবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া ও এম কে আনোয়ার, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালত তাঁদের জামিন আবেদন নাকচ করে জেলে পাঠিয়ে দেন।
ওই রাতেই ছাত্রদলের এক নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের একজন কম্পিউটার অপারেটরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া রাতভর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরীসহ বিভিন্ন নেতার বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ ছাড়া আরও কয়েকজন নেতার বাসার সামনে রাতভর পুলিশ মোতায়েন ছিল।
জীবন নিয়ে শঙ্কা রিজভীর: সারা দেশে ধরপাকড়ের অভিযোগ করে গতকাল দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন রুহুল কবির রিজভী। এ সময় তিনি তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
নিজের, বিএনপির নেতাদের ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য গণমাধ্যম, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের সহায়তা চান তিনি।
রিজভী বলেন, গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন তিনি। রাতে প্রেসক্লাব থেকে বের হওয়ার পর সাদাপোশাকের পুলিশ তাঁকে ধাওয়া করে। কয়েকটি মাইক্রোবাস তাঁর গাড়ি অনুসরণ করে। তবে তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে সক্ষম হন।
পিয়াস করিমের দারোয়ান গুলিবিদ্ধ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়াস করিম অভিযোগ করেছেন, গতকাল রাতে দুর্বৃত্তরা তাঁর বাসার দারোয়ানকে গুলি করে আহত করেছে। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাঁর বাসার কাছে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়।
সারা দেশে ধরপাকড়: প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, শুক্রবার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৮৯ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে কুষ্টিয়ায় ১০ জন, চাঁদপুরে ১১, নারায়ণগঞ্জে ২১, যশোরে ১৪, সিরাজগঞ্জে তিন, বরিশালে ১৫, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ছয়, মাগুরায় দুই ও নড়াইলে পাঁচজনকে আটক করা হয়। নারায়ণগঞ্জে মহানগর শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদকসহ ২১ জন আটক হয়েছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, নাশকতার আশঙ্কায় এঁদের আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও জেলার সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের বাড়িতে পুলিশ তিন দফায় তল্লাশি চালিয়েছে। তবে এ সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না।
বরিশালে ১৫ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, নাশকতার আশঙ্কায় ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এই ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাংসদ মজিবর রহমান সরোয়ারের ঢাকার গুলশানের বাসভবন এবং বরিশালে মহানগর জামায়াতের আমির মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসভবনে পুলিশ অভিযান চালায়। তবে এ সময় তাঁরা বাসায় ছিলেন না।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বারইয়ারহাট পৌর যুবদলের আহ্বায়ক মীর মো. জহীর উদ্দিনসহ যুবদল ও শিবিরের ছয় নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। বারইয়ারহাটের হাওয়া ভবন থেকে এঁদের আটক করা হয়। জোরারগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলমগীর জানান, আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চাঁদপুরে বিএনপির ১০ নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন। চাঁদপুর সদরে দুজন, ফরিদগঞ্জে তিনজন, হাইমচরে দুজন, মতলব দক্ষিণে দুজন ও হাজীগঞ্জে একজনকে আটক করা হয়। পুলিশ সুপার আমির জাফর বলেন, হরতালে নাশকতাসহ বিভিন্ন অপরাধে বিএনপির চার-পাঁচ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাঁদের আটক করতেই পুলিশ বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে।
যশোর শহর বিএনপির সহসভাপতি আবদুর রবসহ বিএনপি ও জামায়াতের ১৪ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাঁদের আটক করে পুলিশ। নেতা-কর্মীদের আটক করে হয়রানির প্রতিবাদে সকালে শহরের দড়াটানা মোড়ে মানববন্ধন করে বিরোধী দল। গতকাল ভোরে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জোয়ার্দার আশরাফুল আলম, বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা ইলিয়াস আলীর শ্যালক ও মাগুরা জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আনজুম হাসান এবং জেলা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আরিফুজ্জামানকে আটক করেছে পুলিশ।
কুষ্টিয়ায় বিএনপির ১২ নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে কুষ্টিয়া সদর থেকে দুজন, কুমারখালীতে দুজন, দৌলতপুরে একজন, মিরপুরে চারজন, ভেড়ামারায় একজন ও খোকসা থেকে দুজনকে ধরা হয়। পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দীন আহমেঞ্চদ বলেন, হরতালে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের আটক করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে জেলা বিএনপির সহসভাপতি মকবুল হোসেন চৌধুরী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের এবং সলঙ্গা থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল লতিফকে শুক্রবার রাতে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে বলে জানান সদর থানার ওসি হাবিবুল ইসলাম।
রাতে খালেদার বাসায় পেশাজীবীদের প্রতিনিধিদল: বিএনপি-সমর্থক শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের পৃথক প্রতিনিধিদল গত রাতে খালেদা জিয়ার বাসভবনে গেছে।
এর মধ্যে রাত নয়টার দিকে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউটিএবি) সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ ফ ম ইউসুফ হায়দারের নেতৃত্বে শিক্ষকদের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে যায়। রাত সোয়া ১০টার দিকে সেখান থেকে বের হয়ে আ ফ ম ইউসুফ হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে তাঁরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় ও দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, তাঁরা মনে করেন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সব দলের অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রয়োজন।
রাত ১১টার দিকে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) একটি প্রতিনিধিদল খালেদা জিয়ার বাসভবনে যায়। এর কিছুক্ষণ পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, ডিইউজের একাংশের সভাপতি আবদুল হাই শিকদার ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল এবং এ জে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল খালেদা জিয়ার বাসভবনে প্রবেশ করেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।