আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিয়াদের উদ্ভব ও ধর্মীয় মতবাদ



শিয়া শব্দটি আরবি শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ গোত্র বা সম্প্রদায়। ইসলামে শিয়া এমন একটি মুসলিম সম্প্রদায়কে বলা হয় যারা সর্বক্ষেত্রে হযরত আলী (রাঃ) কে অনুসরণ করে। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর মুসলিম বিশ্ব যখন নেতা শূন্য হয়ে পড়েছিল তখন সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তার মনোনয়নকে অনেকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেন নি। আর এই বিরোধই নতুন রাজনৈতিক বিভেদের বীজ বপন করে।

আবু বকর (রাঃ) কে যারা খলিফা হিসেবে মানতে পারেনি তাদের দাবি ছিল যে, মোহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে হযরত আলী (রাঃ) সবার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। কারণ তিনি ছিলেন নবীর নিকট আত্মীয়, এছাড়াও হিজরতের সময় মোহাম্মদ (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে মক্কায় তার প্রতিনিধি হিসেবে রেখে গিয়েছিলেন। সুতরাং তিনিই যোগ্য ব্যক্তি যিনি নবীর অবর্তমানে মুসলমানদের সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আলী (রাঃ) এর সমর্থকরা প্রথম দিকে মনে মনে হতাশ হলেও পরে তারা প্রকাশ্যে খলিফাদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন সময় আলী (রাঃ) কে মুসলিম বিশ্বের খলিফা নির্বাচিত করার দাবি জানাতে থাকে।

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর আলী (রাঃ) এর সমর্থকদের হতাশ করে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর (রাঃ) ও ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত উসমান (রাঃ) কে মুসলিম বিশ্বের খলিফা নির্বাচিত করা হয়, ফলে আলী (রাঃ) এর সমর্থকরা আরও বেশী হতাশ হয়ে পড়ে। উপায় না দেখে তারা গোপনে তাদের দলে আরও আলী অনুসারীদের ভেড়াতে থাকে এবং আলী (রাঃ) এর অজ্ঞাতে পৃথক একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল সংগঠিত করে। হযরত উসমান (রাঃ) এর শাসনামলে আলী সমর্থকরা অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং তারা উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনয়ন করে এবং প্রকাশ্যে উসমান বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এই সময় ইবনে সাবা নামক জনৈক ইহুদী ধর্মান্তরিত হয়ে আলী সমর্থকদের দলে যোগ দিলে উসমান বিরোধী আন্দোলন আরও বেশী জোরদার হয়। পরিশেষে তাদের আন্দোলন ও চক্রান্তের শিকার হয়ে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত উসমান (রাঃ) শাহাদাত বরন করেন।

উসমান (রাঃ) এর শাহাদাতের পর ৬৫৬ সালে অবশেষে হযরত আলী (রাঃ) মুসলিম বিশ্বের খলিফা নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। পরে সিফফিনের যুদ্ধে মুয়াবিয়া ও আমর বিন আল আস এর নিকটে হযরত আলী (রাঃ) এর কূটনৈতিক পরাজয় ঘটলে আলী (রাঃ) এর দল থেকে বা শিয়া মতবাদ থেকে কতিপয় অনুসারী বের হয়ে নতুন দল গঠন করে, যারা ইতিহাসে খারিজি সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই খারিজিদের হাতে ৬৬১ সালে হযরত আলী (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন, ফলে শিয়া আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। আমীর মুয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর হযরত আলীর পুত্র ইমাম হাসান (রাঃ) এর সাথে সন্ধি ভঙ্গ করে তার পুত্র ইয়াজিদ নিজেকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

হাসান ও হোসেন (রাঃ) ইয়াজিদের হাতে বায়াত হতে অস্বীকৃতি জানালে কৌশলে হাসান (রাঃ) কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় এবং হোসেন (রাঃ) কে কারবালার প্রান্তরে তার পরিবার ও অনুসারী সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হোসেন (রাঃ) এর শাহাদাতের পর হযরত আলী (রাঃ) এর অনুসারীরা ইয়াজিদ বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামে এবং শিয়া সম্প্রদায় নামে আত্মপ্রকাশ করে। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেন সহ ৭২ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করায় শিয়াগন উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে। আন্দোলন চলাকালে আল মুখতার নামক একজন শিয়া সমর্থক ইমাম হোসেন এর হত্যাকারী উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে হত্যা করে কারবালার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। ৭৫০ সালে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় এসে শিয়াদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করলে তারা তানজিয়াতে গমন করে ইদ্রিসের নেতৃত্বে প্রথম শিয়া রাষ্ট্র গঠন করে।

অপরদিকে ৭৫৬ সালে মিশরে ফাতেমীয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়ারা নতুন উদ্যমে তাদের প্রচার প্রসার বাড়ানো শুরু করে। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া মতাদর্শীদের রয়েছে আলাদা প্রভাব। আশির দশকে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে শিয়াদের এক সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্বের সকল শিয়ারা ইরানে এসে একত্রিত হয়ে স্বাধীন শিয়া রাষ্ট্র ইরান প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়াও ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে শিয়াদের বাস রয়েছে।

শিয়ারা প্রথম থেকেই সর্বদা বিভক্ত ছিল তাদের ইমামতের ক্ষেত্রে। কেউ ইমাম হুসাইনের পুত্র জয়নুল আবেদিনকে আবার কেউ মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়াকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে। শিয়াদের মোট ইমামের সংখ্যা ১২ জন। তাদের প্রথম ইমাম ছিলেন হযরত আলী (রাঃ) এবং সর্বশেষ ইমাম ছিলেন মোহাম্মদ আল মুনতাজির। তাদের অন্যান্য ইমাম গন ছিলেন যথাক্রমে (১) আলী (রাঃ) (৬৫৬-৬৬১ খ্রীঃ), (২) হাসান (৬৬১-৬৬৯ খ্রীঃ), (৩) হোসেন (৬৬৯-৬৮০ খ্রীঃ), (৪) ২য় আলী (জয়নুল আবেদীন) (৬৮০-৭১২ খ্রীঃ), (৫) মুহাম্মদ আল বাকের (৭১২-৭৩১ খ্রীঃ), (৬) জাফর আস সাদিক (৭৩১-৭৬৫ খ্রীঃ), (৭) মুসা আল-কাজিম (৭৬৫-৭৯৯ খ্রীঃ), (৮) আলী আর-রেজা (৭৯৯- ৮১৮ খ্রীঃ), (৯) মুহাম্মদ আল জাওয়াইদ (৮১৮-৮৩৫ খ্রীঃ), (১০) আলী হাদী (৮৩৫-৮৬৮ খ্রীঃ ), (১১) হাসান আল-আসকারী (৮৬৮-৮৭৪ খ্রীঃ) এবং (১২) মুহাম্মদ আল মুস্তাজির (৮৭৪-৮৭৮ খ্রীঃ) ৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে শেষ ইমাম আল মুন্তাজির সামাররাহ হতে অন্তর্ধান হন।

শিয়ারা প্রাথমিক অবস্থায় একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও সময়ের বিবর্তনে তারা বেশ কিছু ধর্মীয় মতবাদও প্রতিষ্ঠা করে। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান মতবাদগুলো হলো- ** মুসলমানরা সাধারণত যে কালিমা পাঠ করে থাকে শিয়ারা তার থেকে একটু বাড়িয়ে কালিমা পাঠ করে থাকে। তারা বলে আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই, মোহাম্মদ (সাঃ) তার প্রেরিত রসূল এবং আলী (রাঃ) তার যোগ্য প্রতিনিধি। ** শিয়াদের মতে ইমামত মোহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের মধ্য হতে প্রাপ্ত হবে। তারা আবু বকর, ওমর ও উসমান (রাঃ) কে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে স্বীকার করে না।

তারা আলী (রাঃ) কে শুধুমাত্র সঠিক খলিফা মনে করে। ** এদের অনেকে আবু বকর, ওমর ও উসমান (রাঃ) কাফির মনে করে (আস্তাগফিরুল্লাহ) ** শিয়াদের মতে ইমাম আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হবেন, এখানে জনগণের কোনও এখতিয়ার নেই। ** সাধারণত শিয়ারা হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আবু হোরায়রা, ইবনে উমর, আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসকে সঠিক মনে করেন না। তারা শুধুমাত্র হযরত আলী (রাঃ) এবং তার বংশধরদের বর্ণিত হাদিসগুলো বিশ্বাস করে থাকেন। ** শিয়াদের মতে ইমাম তার কার্যকলাপের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।

** তাদের মধ্যে ইমাম অবিভাজ্য। সুতরাং একই সময়ে দুজন ইমাম পৃথিবীতে আসা অসম্ভব। ** তাদের মতে ইমাম মানুষ ও আল্লাহর মাঝে মধ্যস্থতাকারী। সুতরাং তার সিদ্ধান্তই সর্বদা চূড়ান্ত। ** শিয়াদের মতে আল-কুরআন ও আল-হাদিস ইসলামী জ্ঞানের একমাত্র উৎস।

সুতরাং ইজমা ও কিয়াসের কোনও বিধান ইসলামে নেই। ** শিয়াদের মতে প্রত্যেক দিন তিন ওয়াক্ত নামাজ ফরজ এবং কবর জিয়ারত করা উত্তম কাজ। ** তাদের মতে অন্যান্য নামাজের মতো জুম্মার নামাজও একাকী আদায় করা যায়। দ্বাদশ পন্থী শিয়াদের মতে ইমাম মোহাম্মদ আল মুন্তাজির কিয়ামতের আগে আল মাহদী হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করবেন। ** তারা অনেকেই মনে করেন পৃথিবীর সকল মাটি অপবিত্র, তাই তারা নামাজ পড়ার সময় কাবা শরীফ থেকে নিয়ে আসা মাটি দিয়ে তৈরি করা টালির উপর সেজদা প্রদান করে।

**শিয়াদের বেশির ভাগ গোত্র হযরত আলী (রাঃ) কে নিয়ে এবং তাদের ইমাম দের নিয়ে শিরক করে থাকে। ** মহরমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরার দিন মাতম করাকে তারা ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। তারা মনে করে এতে ইমাম হোসেনের কষ্টকে তার সাথে শেয়ার করা হয়। ** তারা হোসেন (রাঃ) এর নকল মাযার (তাজিয়া), ক্ষেত্র বিশেষে হযরত আলী (রাঃ), হোসেন (রাঃ) এর ছবি, নকল মৃতদেহ তৈরি করার দ্বারা উনাদের জঘন্ন অপমান করে থাকে

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.