আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল
১ম পর্ব
২য় পর্ব
***
মাসুদ রানা বসে আছে অন্ধকার একটি ঘরে।
ঘরটি আসলে পুরোপুরি অন্ধকার নয়। সিলিং থেকে একটা স্বল্প ওয়াটের বাল্ব নেমে এসেছে রানার ঠিক কপালের উপর। রানার মনে হচ্ছে কেউ যেন একটা গরম ড্রিল মেশিন দিয়ে ওর কপাল ফুটো করে মগজ বের করে আনতে চাইছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে বাল্বের আলো রানাকে ছারিয়ে ঘরের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে না।
হয়তো দীর্ঘ সময় চোখের এতকাছে উত্তপ্ত আলোক উৎস থাকায় রানা সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে গেছে।
রানা বসে আছে কাঠের একটা চেয়ারে। তার দুই হাত এবং শরীর ডাক্ট টেপ দিয়ে চেয়ারের সাথে শক্ত করে পেচানো। চেয়ারের পায়াগুলো বোধ হয় মেঝের সাথে বোল্ট দিয়ে আটকানো। এক চুল নড়ার উপায় নেই।
রানা কতক্ষণ এভাবে বসে আছে জানে না। সময়ের হিসেব গুলিয়ে গেছে অনেক আগেই। যত নষ্টের গোঁড়া ওই লাইট বাল্বটা। সামান্য একটা আলো জ্বালিয়ে রেখে যে মানুষকে কতখানি কষ্ট দেয়া যায় সেটা বলে বুঝানো যাবে না। চোখ বন্ধ রেখেও উপায় নেই।
বাল্বের আলো চোখের পর্দা ভেদ করে আচড় বসাচ্ছে চোখের মনিতে। পানির তেষ্টায় রানার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিভে মনে হয় কেউ ঝামা ঘসে দিয়েছে। নিঃশ্বাস নেয়ার সময় মনে হচ্ছে ফুসফুস দিয়ে যেন কতগুলো ব্লেডের কুচি উঠছে নামছে।
আহ, এভাবে আর কতক্ষণ? কেউ আসে না কেন?
দরজা খোলার শব্দে রানা বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকালো।
আলোর হলুদ পর্দার ওপাশে একটি মেয়ের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা গেল। বাচ্চা একটা মেয়ে... বয়স কত হবে? চৌদ্দ... পনেরো? লিকলিকে শীর্ন শরীর। আলোর কারসাজির কারনেই কিনা কে জানে রানার মনে হল মেয়েটির মুখটা কেমন যেন বেকেচুরে গলে গেছে। নাকমুখ কিছুই ঠিক জায়গায় নেই। মেয়েটি হাতে করে একটা বড় পাত্র বয়ে নিয়ে আসছে।
একটা পানির গামলা। পাত্রটা বয়ে আনতে শির্ন মেয়েটির বেশ কষ্ট হচ্ছে। একটু একটু পানি ছল্কে পড়ছে মেঝেতে। মেয়েটি পানির গামলাটা এনে রাখলো রানার পায়ের কাছে। তারপর রানার পা দুটো তুলে নিয়ে ডুবিয়ে দিল গামলার পানিতে।
ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়ায় রানার শরীর শিরশির করে উঠল। সেই সাথে আরেকটা ভীতি তার মন ছুঁয়ে গেল।
গামলা রেখে মেয়েটি বের হয়ে গেল ঘর থেকে। একটু পর কেমন ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ শুনা গেল, কেউ ভারি কিছু টেনে আনছে মেঝের উপর দিয়ে। মেয়েটি আবার প্রবেশ করল ঘরে, সে তার পেছনে ভারি কিছু একটা টেনে টেনে আনছে।
জিনিসটার ভারে তার পিঠ ধনুকের মত বেঁকে গেছে। চারকোণা জিনিসটা কি? ব্যটারি??
নাহ। । এদেরকে আসলে মুর্খ ভাবার আর কোন উপায় নেই। টর্চারের নিয়ম কানুন ভালোই জানে।
প্রথম ধাপ আইসোলেশন। সাবজেক্টকে একটা খালি ঘরে দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে হবে। তার সাথে কোন রকম কন্টাক্ট করা যাবে না। সম্ভব হলে তাকে একটা অবিরাম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এতে প্রাথমিক ভাবে সাবজেক্টের কনফিডেন্স ভেঙে যাবে।
এর ফলে পরের ধাপগুলো সহজ হয়ে যাবে। পরের ধাপে শুরু হবে আসল টর্চার। রানার ক্ষেত্রে ওরা বেছে নিয়েছে ইলেকট্রিক শক। জিনিসটা কিভাবে সবচেয়ে কার্যকরি ভাবে ব্যবহার করা যায় ওরা তাও জানে। সরাসরি শরীরে শক না দিয়ে কোন ইন্সুলেটর ব্যবহার করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়।
সেজন্যেই এই পানির গামলার ব্যবস্থা। নাহ, ব্যটাদের সত্যি প্রশংসা করতে হয়। মেয়েটি দুইটা মোটা ক্যবল এনে ডুবিয়ে দিল গামলার পানিতে। ক্যবলের ওপর প্রান্ত মেয়েটির হাতে ধরা।
ঘরে ঢুকল সোর্ড অভ আহকামের লিডার টাইগার রমিজ।
ঘরের দ্বিতীয় কাঠের চেয়ারটি টেনে এনে বসল রানার সামনে। তার মুখে ঝুলে আছে একটা প্রাশান্ত হাসি। সহৃদয় কণ্ঠে রমিজ বলল, “হ্যালো মাসুদ রানা, কেমন আছ?”
রানা ভাঙা গলায় বলে, “আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন? তোমরা যা যা জানতে চেয়েছ আমি সবই বলেছি। কিছুই গোপন করিনি। ”
“তা সত্যি, অত্যান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে তুমি খুবই কো-অপারেটিভ ছিলে।
সে জন্যে তোমাকে ধন্যাবাদ। ” রমিজের কণ্ঠে সেই হৃদ্যতার সুর। “কিন্তু কি জান, তোমার গল্পটা তেমন একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ”
“আমি জানি মিলিটারির ভেতর তোমাদের কন্টাক্ট আছে। তুমি চাইলেই আমার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখতে পার।
দেখা আমি মিথ্যে বলছি কিনা”
“আমি ইতিমধ্যে চেক করেছি। তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি পুরোপুরি সত্যি কথা বলছ। প্রথমে তুমি ইমরান ক্লিফোর্ডকে হত্যা করলে। তারপর নিজে ইমরান সেজে আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে।
সুযোগ বুঝে আমাদের দলে ঢুকে গেলে। আমাদের মিটিং এর কথা রহস্যজনক ভাবে পুলিশের কাছে ফাঁস হয়ে গেল। আমাদের এতগুলো ছেলে আমারা পড়ল। কিন্তু তুমি নিজের জীবন বাজি রেখে আমাকে বাঁচিয়ে আনলে। আর এখন তুমি নিজে থেকেই এসে আমাদের কাছে ধরা দিলে, নিজের আসল পরিচয় দিয়ে বললে আমাদের সাথে যোগ দিতে চাও।
তুমিই বল তোমাকে কি আমাদের বিশ্বাস করা উচিত? কিভাবে বুঝব যে তোমার অন্য কোন প্ল্যান নেই? হয়তো এর সবই অভিনয়? এই সব কিছুই SOA ইনফিল্ট্রেড করার জন্যে তোমার একটা সাজানো নাটক?”
“আমাকে আর কি প্রামান দিতে হবে?”
“আমি জানি না মাসুদ রানা। কিন্তু এই মুহুর্তে গুলি ভরা পিস্তলটা আমার হাতে আর তুমি আমার সামনে চেয়ারে হাত পা বাঁধা। অতএব এখন তোমার দায়িত্ব যে কোন মুল্যে আমার বিশ্বাস অর্জন করা। ”
“তুমি জানো ওরা আমার বাবাকে কি করেছে? জানো ওরা কিভাবে আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে? আমি সারা জীবন এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি। আর তোমারাই আমার প্রতিশোধের একমাত্র পথ।
”
“হুম... আমি জানি রানা। তোমার ব্যপারে আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। তোমার বাবা আনোয়ার হোসেন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ৭১ এ দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধিনতার পর কর্নেল তাহেরের সাথে মিলে সমাজতান্ত্রিক দল করেছিলেন।
তাহেরে ফাসি হবার পর একরাতে তোমার বাবাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় সরকারের ব্ল্যাক অপস টিম। তার আর কোন হদিশ মিলেনি। তোমার বয়েস তখন কত? এক বছর? না দুই?”
“আমি আমার বাবাকে চেনার সুযোগ পাইনি। বাবা বলতে আমার কাছে শুধু দেয়ালো বাঁধানো একটা ছবি। আর মায়ের মুখে শোনা কিছু গল্প।
বাবার জন্যে অপেক্ষা করে করে মা এক সময় পাগল হয়ে গেল। আমি বড় হলাম একা একা...”
“হুমম... আমি দুঃখিত রানা, সত্যি বলছি। কিন্তু তুমি যদি ভেবে থাক শৈশবে বাবাকে হারানো তোমাকে SOA’র আদর্শ ক্যন্ডিডেট করে তুলবে তাহলে ভুল করছ। সোর্ড অভ আহকাম কোন প্রতিশোধের অস্ত্র নয়। সোর্ড অভ আহকাম একটা আদর্শ, একটা স্বপ্ন, একটা শক্তি।
একদিন এই দেশকে সত্যিকারের স্বাধিনতা এনে দেবে সোর্ড অভ আহকাম। ”
“প্রতিশোধের চেয়ে বড় আদর্শ আর কি হতে পারে?”
একটা ক্লান্ত হাসি রূপ নিল রমিজের ঠোঁটে। সে জিভ দিয়ে একটা ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “ওই যে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছ, ওর নাম সুমি। ” রামিজ হাত তুলে ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা শির্ন মেয়েটিকে দেখালো। মেয়েটি কেমন জুবুথুবু হয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
যেন প্রভুভক্ত কুকুর অপেক্ষা করছে প্রভুর নির্দেশের জন্যে। রমিজ হাত তুলে ডাকল, “সুমি, কাছে আয়। ”
রমিজের নির্দেশের সাথে সাথে সুমি এসে দাঁড়ালো আলোর নিচে।
রমিজ বলল, “ওর মুখটা দেখ রানা। ”
ওই মুখ দেখলে অন্য যে কেউ হয়তো বমি করে ফেলত।
মেয়েটার নাক মুখ গলে একাকার হয়ে গেল। একটা চোখ আর একটা কান নেই। মাথার একপাশের সব চুল চামড়া ঝরে গিয়ে খুলি বেড়িয়ে আছে।
রমিজ বলে চলেছে, “সুমির বয়েস যখন নয় বছর তখন এক রাতে ওকে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় কিছু যুবক। পাড়ার স্কুল ঘরে আটকে রেখে ওরা সারা রাত সুমিকে নির্যাতন করে।
ভোর হলে সুমির মুখে এসিড ঢেলে দিয়ে ওরা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে আসে। সবাই সব কিছু জানত, কিন্তু কেউ সুমিকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসেনি। কারন ওই যুবকদের মাঝে একজন ছিল তৎকালীন এক মন্ত্রির ভাগ্নে। সুমির পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যায়। এতে উল্টো তাদের আরো হয়রানির শিকার হতে হয়।
অসুস্থ ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে সুমির পরিবার কোথায় যাবে দিশে পায় না। ”
এটুকু বলে রমিজ একটু বিরতি নেয়। তারপর আবার বলে, “তুমি হয়তো ভাবছ এই গল্পে আমি এলাম কিভাবে? বলছি। সুমির পরিবারের এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায় এক সাংবাদিক। তিনি তার পত্রিকায় সুমির নির্যাতনকারিদের আসল পরিচয় জানিয়ে রিপোর্ট করেন।
অনেক লোভ আর ভয় ভীতি দেখিয়েও তাকে দমানো যায়নি। অবশেষে উপায়ন্তর সরকার আমাকে ডেকে পাঠায়। আমি ছিলাম তাদের শেষ অস্ত্র। সরকারের নির্দেশে এক অমাবস্যার রাতে আমি সেই সাংবাদিক আর তার স্ত্রীর গলা কেটে লাশ ফেলে আসি তাদের বেডরুমে। ব্যাস সব কিছু শান্ত হয়ে যায়।
আর কেউ সুমির নাম উচ্চারন করার সাহস পায় না। একটু একটু করে সবাই ভুলে যায় সুমির কথা। ”
একটা লম্বা শ্বাস টেনে রমিজ বলে, “এমন গল্প একটা দুইটা নয়, বাংলাদেশের আনাচে কোনাচে তে এমন একশ সুমি বসবাস করছে। আমি তার জীবন্ত সাক্ষি। সরকার সোর্ড অভ আহকাম কে জন্ম দিয়েছে নিজেদের নোংরা কাজগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে।
যখন যেই দল সকারের গদিতে বসেছে তখন সে আমাদেরকে নিজের ইচ্ছে মত ব্যবহার করেছে। তারপর এক সময় আমি বললাম, অনেক হয়েছে। আর নয়। ”
“গণতন্ত্রের নামে একদল ক্ষমতা লোভি নেকড়ের কাছে আমরা নিজেদের জীবন বিকিয়ে দিয়েছি রানা। প্রতিবার ভোট দিয়ে আমরা নির্বাচন করি পরের পাঁচ বছর কোন দল আমাদের রক্ত শুষে খাবে।
এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। এই নষ্ট নিয়ম থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সোর্ড অভ আহকাম কোন টেরোরিস্ট দল নয় মাসুদ রানা। সোর্ড অভ আহকাম এই যুগের মুক্তিযোদ্ধা।
”
“আমাকেও সেই যুদ্ধে আপনাদের সাথে নিন। দেশের জন্যে জীবন উতসর্গ করার একটা সুযোগ দিন। যেমন আমার বাবাকে করেছিল। ”
“দেব রানা। কিন্তু তার আগে তোমার নিজেকে প্রমান করতে হবে।
তোমাকে প্রামান করতে হবে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা, তোমাকে প্রমান করতে হবে এই যুদ্ধের জন্যে তুমি প্রস্তত। ”
“আমি প্রস্তত...” রানা দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়।
“সেটা সময়ই বলে দেবে। ”
“আমাকে টর্চার করার উদ্দেশ্য কি?”
“আমি টর্চারে বিশ্বাস করি না। ”
“তাহলে আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন?”
“এটা একটা ডিকন্সট্রাকশন প্রোগ্রাম।
আল কায়দা এর মুল আবিষ্কারক। মাঝে মধ্যে এক দুইটা ইউএস মিলিটারি আলকায়দার হাতে ধরা পরে, জানোই তো। বেশির ভাগ সময় আল কায়দা স্রেফ ওদের মাথা কেটে ফেলে। তবে মাঝে মাঝে ভাগ্যবান দুই একজনকে তারা ডিকন্সট্রাকশন পোগ্রামে ফেলে দেয়। এর মাধ্যেমে একটা মানুষকে ভেঙে চুরে তাকে একবারে অস্থিমজ্জা থেকে আবার নতুন করে গড়ে তুলা হয়।
তাকে সম্পুর্ন নতুন ব্যক্তিত্ব, নতুন পরিচয় দেয়া হয়। তোমাকে আমরা একটা নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব রানা। একজন সত্যিকারের স্বাধিন দেশপ্রেমিক হিসেবে তোমার পুনর্জন্ম হবে। ”
রমিজ ফিরে যাবার উদ্যোগ নেয়। দরোজার কাছ থেকে ফিরে তাকিয়ে বলে, “ওহ হ্যাঁ... একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি।
আমাদের মিটিং এর কথা পুলিশকে জানিয়েছিল কে? তুমি?”
উত্তরটা দেওয়ার আগে কয়েক মুহূর্ত ভাবল রানা। হয়ত তার এই একটা উত্তরের ওপর নির্ভর করছে একজন মানুষের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার হাতে আর কোন উপায় নেই। সে বলল, “নাহ... রাজ্জাক আলি। আমি জানার সাথে সাথে সবাইকে সতর্ক করার চেষ্টা করি।
কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ”
“রাজ্জাক আলি!?! দুঃখজনক। ছেলেটাকে আমি বেশ পছন্দ করতাম। ” রামিজ ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
সুমি আবার তার হাতে ইলেকট্রিক ক্যাবল দুটো তুলে নেয়।
ক্যবলের এক প্রান্ত গামলার পানিতে ডোবানো। অপর প্রান্ত হাতে নিয়ে সুমি ফিরে যায় ব্যটারিটার কাছে। ব্যটারির সাথে ওই প্রান্ত জুড়ে দিলেই ক্যবল বেয়ে কয়েকশ ভোল্টের বিদ্যুৎ ছুটে আসবে। পুড়িয়ে দেবে শরীরের প্রতিটি কোষ। রানা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে।
Here comes the pain…
***
রাত পৌনে দশটা বাজে।
রাজিয়া স্কুলের ক্লাশ শেষে অনেকক্ষণ প্রাইভেটে ছাত্র পড়ায়। বাসায় ফিরতে তাই সাধারণত রাত হয়। আজ অবশ্য একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। সামনে জেএসসি পরিক্ষা।
ছাত্রদেরকে তাই বাড়তি সময় পড়াতে হয়েছে।
রাজিয়ার বেশ ক্লান্ত লাগছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ছাত্র পড়িয়ে রাতে একবার হাসপাতালে গিয়েছিল মা’কে দেখতে। গিয়ে দেখে মা ঘুমিয়ে আছে।
মায়ের সাথে কথা হয়নি তাই। মা অবশ্য এখন ভালোই আছে। সেই পুলিশের লোকটা, সোহেল আহমেদ যার নাম, সে তার কথা রেখেছে। মায়ের চিকিৎসার সব খরচ ওরাই দিয়েছে। আর বাবার পেনশনের টাকাটাও বোধ হয় দুই একদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ওই টাকাটা পেলে রাজিয়া একটু হাপ ছেড়ে বাঁচতে পারবে। ও ঠিক করে রেখেছে টাকাটা হাতে এলে মা’কে একদিন কক্সবাজারে নিয়ে যাবে। মায়ের ভীষণ সমুদ্র দেখার শখ। আহা... ভাইয়াটাকে যদি সাথে নেয়া যেত। ভাইয়া এখন কেমন আছে কে জানে? সেই যে দিন দশেক আগে তার সাথে সোহেলের কথা হল, এরপর ভাইয়ার আর কোন খোঁজ খবর নেই।
তবে সোহেল আশ্বাস দিয়েছে ভাইয়ার কোন ক্ষতি হবে না। সে নিজে ভাইয়ার নিরাপত্তার দিকটা দেখবে। রাজিয়া সোহেলের কথা বিশ্বাস করেছে। নিজের অজান্তেই সোহেলের উপর তার কিছুটা নির্ভরতা জন্মে গেছে। মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় এর উপর ভরসা করা যায়।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাজিয়া রিক্সা সিএনজি কিছুই পায়নি। আসলে রিক্সার অভাব নেই। কিন্তু কেউ রাজিয়ার বাসার দিকে যাবে না। রাজিয়ার বাসা একটু ঘিঞ্জি এলাকায় তো। গাড়ি টারি এদিকে তেমন একটা আসতে চায় না।
এদিকে বাসের র্যুটও নেই। মেজাজ খারাপ করে হেটেই চলে এসেছে রাজিয়া। এতে একটা লাভ হয়েছে। গাড়ি ভাড়াটা বেঁচে গেছে। কিন্তু এখন পা টনটন করছে।
আর দুপুরে না খাওয়ায় শরীরটা একদম ভেঙে আসছে। ঘরে খাবার দাবার তেমন কিছু নেই। গিয়েই ভাত চড়াতে হবে।
তালা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকল রাজিয়া। ঘরের ভেতরে অন্ধকার।
রাজিয়ার নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। ঘরের মধ্যে সিগারেটের গন্ধ কেন? তাড়াহুড়া করে বাতি জ্বালতেই রাজিয়ার পিলে চমকে উঠল। ঘরের একপাশে একটা চেয়ারে রাজিয়ার ভাই রাজ্জাক আলি বসে আছে। তার হাত পা বাঁধা। মাথার একপাশে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে।
মুখের ভেতর একটা রুমাল গোঁজা। রাজ্জাকের চোখ বড় বড় হয়ে আছে, যেন কোটর ছেড়ে এখনি লাফ দিয়ে বেড়িয়ে আসবে। সে প্রান পনে একটা কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। রাজিয়া ভাইয়ের কাছে ছুটে গেল।
ওর হাতের বাঁধন খুলে দিতে যাবে এই সময় কেউ পেছন থেকে রাজিয়াকে চেপে ধরল। গায়ের জোরে ওকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলো ভাইয়ের কাছ থেকে। রাজিয়া এতক্ষনে দেখতে পেল ঘরের ভেতর ওর ভাই ছারাও আরো তিন জন মানুষ আছে। ওরা কারা? এতক্ষন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
দাড়িওয়ালা একটা মানুষ সামনে এগিয়ে এল, “তোমার নাম রাজিয়া? রাজ্জাক তোমার বড় ভাই?”
রাজিয়াকে তখনো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কেউ, তার লোহার মত আঙুল রাজিয়ার বাহুতে কেটে বসছে। নিজেকে ছারিয়ে নেয়ার যুদ্ধ করতে করতে রাজিয়া চিৎকার করে উঠল, “আপনারা কারা? ভাইয়াকে কেন আটকে রেখেছেন?”
দাড়িওয়ালা গাল চুলকে বলল, “সোহেল নামে কাউরে তুমি চিন?”
“না না... ওই নামে কাউকে মাই চিনি না।
ছেড়ে দিন আমাকে। ”
“কেন মিথ্যা বলতেস? পুলিশের সাথে কথা বলে তোমারা কাজটা ভাল কর নাই। টাইগার রমিজ বিশ্বাস ঘাতক পছন্দ করে না। ”
রাজিয়ার চোখে বোবা আতঙ্ক ফুটে উঠে। তার শরীর কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে।
চিৎকার করার শক্তিও যেন আর নেই।
দাড়িওয়ালা এবার রাজ্জাকের দিকে ফিরে বলে, “টাইগার রমিজ বিশ্বাস ঘাতকদের কঠিন শাস্তি দেয়। তোমার কারণে আমাদের দশটা ছেলে মারা গেছে। এর মুল্য তোমাকে দিতে হবে। ”
রাজ্জাক প্রচন্ড শক্তিতে দড়ি ছিঁড়ে ছুটে আসতে চায়।
তার গলার শিরা ফুলে ওঠে। মুখ দিয়ে লালা বেড়িয়ে আসে। কিন্তু রাজ্জাক কিছুই করতে পারে না। বাকি দুই জন টান মেরে রাজিয়াকে মেঝেতে ফেলে দেয়। তারপর দুইপাশ থেকে ওকে শক্ত করে ধরে রাখে।
দাড়িওয়ালা কোমরের বেল্ট খুলতে শুরু করে।
***
বাড়ির চারপাশে পুলিশ আর সাংবাদিক গিজগিজ করছে। মানুষের হইহট্টগোল, পুলিশের বাঁশির শব্দ, ক্যমেরার ফ্লাশের ঝিলিক। সব মিলিয়ে সোহেলের পরিস্থিতিটা কেমন অবাস্তব মনে হতে থাকে। মাথার ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে।
পুলিশ ফিতা দিয়ে বাড়ির সামনেটা কর্ডন করে রেখেছে। বাড়ির দরোজা খোলা। অনেক মানুষ আসছে যাচ্ছে। দরোজার ফাঁক দিয়ে সোহেল ভেতরটা এক পলক দেখল। ভেতরে মেডিক্যাল টিম কাজ করে যাচ্ছে।
দুইটা লাশ। একটা পুরুষ ও একটা নারি। খুন করার পর প্রতিটি লাশকে কেটে পাঁচ টুকরা করা হয়েছে। টুকরো গুলো ব্যগে ভরতে গিয়ে মেডিক্যাল টিম গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে।
রাজিয়ার মুখটা দেখতে ইচ্ছে করেনি সোহেলের।
তারপরেও জোড় করে অনেকটা সময় নিয়ে ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। মেয়েটাকে খুন করার আগে রেপ করা হয়েছে... অনেক বার...
বীভৎসতার সাথে সোহেলের পরিচয় নতুন না। বলতে গেলে বীভৎসতার নিয়েই সোহেলের জীবন। নিজের অনুভুতির সুইচটা অফ করতে শিখে গেছে অনেক আগেই। কাজের সময় সে একটা আবেগ বিবর্জিত যন্ত্রে পরিনত হয়।
তাই রাজিয়ার এই পরিনতির তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। তাই না? রাজিয়া কে? কেউ না? ও জাস্ট একটা দাবার গুটি। আজকের পর আগামি কাল সে সবার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। রাজা মহারাজার যুদ্ধে এক সামান্য রাজিয়ার কি মুল্য আছে? ওর জন্যে দুঃখ পাবার কিছু নেই। আর রাজিয়ার মৃত্যুর জন্যে তো অবশ্যই সোহেল দায়ি নয়, তাই না? ও কেবল ওর দায়িত্ব পালন করেছে।
কেবল দায়িত্ব।
আর কিছু নয়।
সোহেলের তো কোন দোষ নেই। কিন্তু রাজ্জাকের বিশ্বাসঘাতকতার কথা SOA জানল কীভাবে? তবে কি রানা মুখ খুলেছে?
Damn you Rana...
***
রানার বাঁধন খুলে দেয়া হল। রমিজ সাহায্য করল ওকে উঠে দাঁড়াতে।
রানা হুরমুর করে পরে যাচ্ছিল। রমিজ তাকে শক্ত করে ধরে রাখল। বলল, “এসো আমার সাথে। ”
রমিজের কাঁধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে রানা এগিয়ে চলল। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন নিয়মিত বিরতিতে ওকে ইলেক্ত্রিক শক দেয়া হয়েছে।
শরীরে এখন আর এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। দেহের প্রতিটি কোষে যেন আগুন জ্বলছে। এক ফোঁটা পানির জন্যে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে রমিজ। আর কি বাকি আছে?
একটা আধো অন্ধকার করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা দুই জন।
ওদের পেছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে একটু দুরত্ব রেখে এগিয়ে আসছে আরেক জন। হাঁটতে হাঁটতে রমিজ কথা বলছে। ওর কথার কিছু কিছু রানার কানে ঢুকছে, কিছু অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে। রমিজ বলে চলেছে, “আমি ছিলাম বাংলাদেশ রাইফেলসের অষ্টম রেজিমেন্টের একজন। আমার টাইগার রমিজ নামটা কিন্তু আমাকে দিয়েছিল আমার বিডিআর এর ভাইয়েরা।
ওরা বলত আমার বুকে মানুষের কলিজা নাই, আমার হচ্ছে বাঘের কলিজা। আমার ভিতরে তাই ভয় ডর বলে কিছু নাই। আসলেই ওই সময় বর্ডারে দস্যু, চোরাচালানকারী, বিএসএফ কিচ্ছু তোয়াক্কা করতাম না। আমার দেশের মাটিতে কেউ অন্যায় কিছু করলেই হল, আমার হাত থেকে নিস্তার নাই। আর হাতের নিশানাও ছিল চমৎকার।
একদিন হয়েছে কি শোন। বর্ডারের পাশের গ্রামের বাচ্চা একটা মেয়ে, বেকুব কিসিমের হয়তো, না বুঝে চলে গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে। আর তারপর পরবি তো পর একেবারে শয়তানের বাবা অর্থাৎ বিএসএফ এর সামনে। বিএসএফের শুয়োরগুলা কি করল জানো? মেয়েটাকে গুলি করে ঝুলিয়ে দিল কাঁটাতারের সাথে। ওপর থেকে আমাদেরকে কড়া নির্দেশ দেয়া হল, খবর্দার কেউ মাথা গরম করবে না।
যা করার আমরা করছি। মিলিটারি আমার বাল করবে, জানি না আমি? এই দৃশ্য দেখে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায়? আমি রাইফেল হাতে নিয়ে উঁচা একটা টিলায় উঠে গেলাম। পর পর দুইগুলিতে বিএসএফের দুইটা শূয়োরকে সাবাড় করে দিলাম। আরো মারতে পারতাম। কিন্তু আমার ব্যটেলিয়নের অন্যান্যরা চলে এসে আমাকে আটকে ফেলল।
ভিন দেশি প্রভুর গায়ে গুলি চালিয়েছি, আমার তো ফাঁসি সুনিশ্চিত। জেলে বসে ফাঁসির দিন গুনছি এই সময় মিলিটারির এক কর্নেল আমার সাথে দেখা করতে এল। তার মুখ থেকে নতুন এক প্রস্তাব শুনলাম। মিলিটারি বেসামরিক কিছু মানুসজন নিয়ে একটা মিলিশিয়া তৈরি করছে। এই মিলিশিয়ার কাজ হবে বিচারের ফাঁক গলে বের হয়ে যায় যেসব ক্রিমিন্যাল তাদের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা।
ওরা নাকি আমাকে এই মিলিশিয়ার লিডার বানাতে চায়। আমি রাজি থাকলে আমার ফাঁসি মাফ করে দেবে। আমি এই প্রস্তাবে খারাপ কিছু দেখিনি। হাজার হোক দুষ্ট লোককে শাস্তি দেবার জন্যেই তো আমি সশস্ত্র বাহিনিতে নাম লিখিয়েছি। আর জান বাঁচানো ফরজ।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারপরের এক বছরে আমার হাত ধরে গড়ে উঠল সোর্ড অভ আহকাম। হেন কুকর্ম নাই যেটা সরকার আমাদেরকে দিয়ে করায়নি। তারপর একদিন ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহ করল। তাদের ন্যায্য দাবির বিপরিতে সরকার সবাইকে পাইকারি হারে জেলে ভরল।
আমি বুঝতে পারলাম এই নষ্ট সরকারের হাতের চাবুক হয়ে থাকার দিন শেষ। সেই দিনই সোর্ড অভ আহকাম সরকারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধিনতার শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ”
রমিজের হিস্টোরি লেসনের অনেক কিছুই রানার মাথায় ঢুকল না। ওর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। এতো কথা শুনার সময় কই? লম্বা করিডোর পার হয়ে রমিজ তাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে যায়।
রানা যেই ঘরে ছিল এই ঘরটিও দেখতে একই রকম, তবে আকারে আরেকটু ছোট। ঘরের একপাশে দেয়াল থেকে একটা লোহার পাইপ বের হয়ে এসেছে। পাইপের সাথে শিকল দিয়ে একটা মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মানুষটার পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন, শরীরের এখানে সেখানে রক্ত লেগে আছে।
রানা জিজ্ঞেস করল, “আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?”
“এখানেই তোমার পরিক্ষার শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
”
রমিজ তার প্যন্টে গুজে রাখা পিস্তলটা টেনে বের করে। তারপর অস্ত্রটা রানার হাতে ধরিয়ে দেয়। পিস্তলটা রানার অতি পরিচিত, ওর ওয়ালথার পিপিকে।
রমিজ বলে, “সুমির কথা মনে আছে তো তোমার?”
রানা মাথা নাড়ে।
“যেই ছেলেগুলো সুমিকে রেপ করেছিল ও তাদের একজন।
এই সেই মন্ত্রির ভাগ্নে। আমি চেয়েছিলাম সুমি নিজের হাতে এই কুকুরটাকে গুলি করে মারুক। কিন্তু মেয়েটা পারেনি, ও এই জানোয়ারটার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভয় পাচ্ছে। এই ভয় নিয়েই হয়তো ওকে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। মাসুদ রানা, আমি চাই সুমির হয়ে তুমি কাজটা শেষ কর।
”
রানা একবার হাতের ওয়ালথারের দিকে তাকায়। হাতের তালুতে পরিচিত অস্ত্রটার ধাতব শীতল স্পর্শ বেশ ভালো লাগছে। সে এবার তাকায় শেকলে বাঁধা মানুষটার দিকে। ওটাকে আসলে কুকুর বলাই ভালো। নিজেকে মানুষ পরিচয় দেবার কোন অধিকার আসলে আর এর নেই।
রমিজ রানার পিঠে হাত রেখে বলে, “ডু ইট রানা... ”
রানার হাত কাপছে। পিস্তলের নল সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। রানা বুক ভরে একবার দম নিল। ঘাড় ফিরিয়ে রমিজকে একবার দেখে নিল। মানুষটা মাত্র দুই ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
রানার হাতে গুলি ভরা পিস্তল। হাত যতই কাপুক এত কাছ থেকে লক্ষ ভুল হবার কোন কারন নেই। রানা আস্তে করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর ওয়ালথারের ট্রিগার টেনে দিল।
নাইন এম এম এর ছোট্ট একটা বুলেট শেকলে বাঁধা মানুষটার খুলি ফুটো করে বের হয়ে গেল।
রমিজ রানার কাঁধ চাপরে দিয়ে বলল, “সাব্বাস বেটা... তুমি প্রস্তত। ”
তারপর ফিরে পেছনের মানুষটাকে বলল, “ডিকন্সট্রাকশন প্রোগ্রাম ইজ কমপ্লিট। নাউ হি ইজ ওয়ান অভ আস। ”
***
৫ দিন পর...
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাহাত খান। কাঁচা পাকা ভ্রু একটু উঁচু করে রেখেছেন।
ঠোঁটদুটো ডানদিকে কিছুটা বেকে আছে। মুখের এই ছোট ছোট পরিবর্তন গুলো দেখে সহজেই অনুমেয় যে তিনি ভাল মুডে আছেন। এই মুহূর্তে তার সমস্ত মনোযোগ ডেক্সের উপর খুলে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে। একটা মেইল ওপেন করা আছে। মেইলটা এসেছে মাসুদ রানার কাছ থেকে।
মেইলটার DGFI এর স্ট্যন্ডার্ড কোডিং ব্যবহার করে লেখা।
মেইলের সারমর্ম অনেকটা এইরকমঃ
রানা সফল ভাবে সোর্ড অভ আহকাম এর ইনার সার্কেল ইনফিল্ট্রেড করতে সমর্থ হয়েছে। সেই সাথে টাইগার রমিজের বিশ্বস্ততা ও অনেকাংশে অর্জন করেছে। ইন্ডিয়া থেকে বান্দরবান বর্ডার হয়ে অস্ত্রের একটা বড় চালান নিয়ে আসছে SOA. চালানের দায়িত্বে থাকছে রানা নিজে।
মেইলের সাথে ট্রাকের সম্ভাব্য র্যুট প্ল্যান এবং ট্রানজিট শিডিউল দেয়া আছে।
ডান দিকের একটা চেয়ারে বসে আছে সোহেল আহমেদ। চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে কিছু একটা বিষয় তাকে মোটেও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। এসি রুমে বসে থেকেও সে একটা রুমাল বের করে একটু পর পর ঘাম মুছছে।
অবশেষে নিরবতা ভাঙলেন রাহাত খান, “আমি নিশ্চিত ছিলাম রানা যোগাযোগ করবেই। সে কখনো দেশের সাথে বেঈমানি করতে পারেনা”।
“কিন্তু স্যার একটা বিষয় আপনার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। ” সোহেলের কণ্ঠে অস্থিরতা টের পাওয়া গেল।
“কি বিষয়?”
“রানা এখন soa এর হাতে বন্দী। তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই মোবাইল সহ অন্যান্য সব গ্যাজেট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কি করে সে এমন ওপেন লাইনে একটা মেইল পাঠাল?”
“তুমি ভুলে যাচ্ছ সোহেল।
রানা একজন কোভার্ট ইনফিল্ট্রেশন স্পেশালিস্ট। নিশ্চয়ই সে কোন এক ভাবে একটা সুযোগ বের করে নিয়ে আমাদের খবর দিয়েছে। এর মাঝে কোন কিন্তু খোঁজার কারন দেখছি না”।
কিন্তু সোহেল সহজে মেনে নিতে নারাজ। “আমার মন বলছে এর ভেতরে কোথাও একটা ঘাপলা আছে”।
“কথাটা পরিষ্কার কর সোহেল। " রাহাত খানের কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য প্রকাশ পেল। “আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছ না”।
“আমি... আমি বলতে চাচ্ছি এটা তো একটা ফাঁদ হতে পারে স্যার”!
“আমি বিশ্বাস করিনা রানা SOA’র সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের একটা ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করেছে”।
“রানা যে সোয়ার সাথে হাত মিলিয়েছে এমনটা আমি বলছি না।
হতে পারে তাকে কোনভাবে বাধ্য করা হয়েছে”।
“তুমি আমি ভাল করেই জানি যে সেটা সম্ভব না। রানাকে বাধ্য করার একমাত্র উপায় হচ্চে টর্চার করা। কিন্তু কোন টর্চারেই রানা মাথা নোয়াবে না। সারভাইভাল ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন যোদ্ধা নিজের জীবন দিয়ে দেবে কিন্তু শত্রুপক্ষের কাছে মুখ খুলবে না”।
“কিন্তু আমাদের সাবধান হতে বাঁধা কোথায় স্যার?”
“I guess you have a plan?”
“ইয়েস স্যার। " সোহেলের মুখে এতক্ষনে হাসি ফুটল।
রাজিয়ার নিস্পাপ মুখটি এখনও সোহেলের চোখের সামনে ভেসে আছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস রানা ডিফেক্ট করেছে। রানা নিশ্চয়ই এখন ডবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
নয়ত SOA’র পক্ষে এই তথ্য জানা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু কথাটা রাহাত খানের কানে তোলার জন্য তার নিচ্ছিদ্র প্রমান চাই। এই মিশন হতে যাচ্ছে সেই সুযোগ!
সোহেলের চোখে মুখে একটা দৃঢ় ভাব ফুটে উঠল। মনে মনে বলল সোহেল, “আই অ্যাম কামিং ফর ইউ রানা...”
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।