সমাজে দীর্ঘ কাল ধরে এটাই প্রচলিত যে আমাদের দয়াল রাসুল (সা ১২ই রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার জন্মগ্রহন করেছিলেন এবং তিনি ওই একই তারিখে ওফাত লাভ করেন । কিন্তু দয়াল রাসুল (সাঃ) হিজরি পূর্ব ৫৩ সালের ১২ই রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার জন্মগ্রহন করলেও তার ওফাতের প্রকৃত তারিখটি ছিল হিজরি ১১ সালের ১লা রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার। সধর্মীদের অজ্ঞতা আর বিধর্মীদের চক্রান্তের কবলে পড়ে হয়ত কোন এক ভাবে এই সঠিক ইতিহাসটির বিকৃতি ঘটেছে।
পবিত্র আল-কোরআনে আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলাম কে একমাত্র ধর্ম হিসেবে কবুল করে নিলাম। ” (সুরা মায়েদাঃ ৩)
এই আয়াতটি ১০ই হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব রোজ শুক্রবার অর্থাৎ বিদায় হজের দিন আরাফার ময়দানে নাজিল হয়েছিল।
আর এই তারিখটি হযরত রাসুল (সাঃ) এর ওফাত লাভের প্রকৃত তারিখ নির্ণয়ে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “এই আয়াতটি ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব তারিখে নাজিল হয়। এরপর রাসূল (সাঃ) আর মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। ” (তফসীরে মা’রেফুল কোরআন)
তফসিরে দুররে মানসুরের ৩য় খণ্ডে বলা হয়েছে “ইবনে জারির কর্তৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) ৮১ রাত দুনিয়াতে অবস্থান করেন। ”
তফসিরে তাবারীর ৪র্থ খণ্ডে বলা হয়েছে, “হাজ্জাজ কর্তৃক ইবনে জুরাইজ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর ৮১ রাত রাসূল (সাঃ) জীবিত ছিলেন।
”
ইবনে জারির বলেন যে আরাফা দিবসের পর রাসুল (সাঃ) ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। (তফসীরে ইবনে কাসীর- ২য় খণ্ড)
ইমাম বাগবী বলেন, “হারুন ইবনে আনতারা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। ” (তফসীরে মাযহারী-৩য় খণ্ড)
সুতরাং ১০ম হিজরীর বিদায় হজ্জের দিনটি মূলসুত্র ধরে ৮১তম দিন কবে হয় তা হিসাব করলে খুব সহজেই বের করা সম্ভভ যে রাসুল (সাঃ) আসলে কবে ওফাত লাভ করেছিলেন।
একথাটি ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত যে ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব হযরত রাসুল (সাঃ) এর আরাফার ময়দানে বিদায় হজ্জের ভাষণ দানকালে উক্ত আয়াতটি নাজিল হয়েছিল এবং তার পর তিনি আর মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীর বুকে জীবিত ছিলেন।
চন্দ্রবর্ষ হিসাব অনুযায়ী এক মাস ২৯ দিন হলে তার পরের মাস হয় ৩০ দিনে।
এই হিসেবে জিলহজ্ব মাস ২৯ দিন, মহররম মাস ৩০ দিন, সফর মাস ২৯ দিন। এখন ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব থেকে হিসাব করলে দেখা যায় যে ওই জিলহজ্ব মাসের বাকি থাকে আর ২১ দিন, তার পরের মাস অর্থাৎ ১১ হিজরির মহরম মাসের ৩০ দিন এবং সফর মাসের ২৯ দিন। সর্বমোট ৮০ দিন। সেই হিসেবে ৮১ তম দিন হয় ১লা রবিউল আওয়াল। এবং সেই দিনটিও ছিল সোমবার।
এখন এই ৩টি মাসের সব কয়টি মাস ২৯ দিন অথবা ৩০ দিন যাই হোক না কেন বিদায় হজ্জের দিন থেকে হিসেব করলে ৮১ তম দিন কখনই এবং কোন ভাবেই ১২ ই রবিউল আওয়াল হয়না।
আবার আখেরি চাহার সোম্বা। এই দিন থেকে হিসেব করেও রাসুল (সাঃ) ওফাত দিবস কবে ছিল তা বের করা সম্ভব। “আখেরি চাহার সোম্বা” এটা একটা ফারসী শব্দ। এর অর্থ শেষ বুধবার।
রাসূল (সাঃ) তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তবে ওফাত এর ৫ দিন পূর্বে তিনি হঠাৎ একদিন সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ২৫ শে সফর, রোজ বুধবার। শেষ বুধবার বলা হয় এ জন্য যে দয়াল রাসূল (সাঃ) এর জীবনের এটাই ছিল শেষ বুধবার। তিনি তার জীবদ্দশায় পরবর্তী বুধবার দেখে যেতে পারেননি।
কারণ তার পর তিনি আবার ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরের সপ্তাহের সোমবার তিনি ওফাত লাভ করেন। এখন এই বুধবার যদি হয় ২৫শে সফর তাহলে সেই হিসেবে পরবর্তী সোমবার হয় ৫দিন পর অর্থাৎ ১লা রবিউল আওয়াল। কিন্তু সেটাতো ১৬ দিন পর ১২ই রবিউল আওয়াল হয়না। অথচ সমাজে এটাই প্রচলিত যে রাসূল(সাঃ) ১২ই রবিউল আওয়াল জন্ম লাভ করেছেন এবং ঐ একি তারিখে ওফাত লাভ করেছেন। ১২ ই রবিউল আওয়ালকে যদি রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের তারিখ হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে ২৫শে সফর তার জীবনের শেষ বুধবার মনে করার আর কোনই কারণ থাকেনা।
কারণ, ২৫শে সফর থেকে ১২ ই রবিউল আওয়াল পর্যন্ত এই ১৬ দিনে আরও ২টি অতিরিক্ত বুধবার চলে আসে।
তাছাড়া ইসলামী ফাউনডেশন, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত “সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ” এর ২য় খণ্ডে বর্ণীত আছে যে “১লা রবিউল আওয়াল, সোমবার, ৬৩ বছর বয়সে হযরত রাসূল (সাঃ) এর ইন্তিকাল হয় সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে। ”
সুতরাং আমাদের রাসূল (সাঃ) ১১ হিজরির ১লা রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার ওফাত লাভ করেছিলেন এবং এটাই সঠিক ও নির্ভুল। সমাজে প্রচলিত ১২ই রবিউল আওয়াল রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের প্রকৃত তারিখ নয়। ১২ই রবিউল আওয়াল রাসুল (সাঃ) এর শুধুমাত্র জন্ম দিবস।
দয়াল রাসুল (সাঃ) ওফাত লাভ করেছিলেন ১লা রবিউল আওয়াল সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে। এই তথ্য দুর-দুরান্তে পৌছাতে সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। যেহেতু চন্দ্র মাসের তারিখ গননা শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে তাই দূর-দুরান্তে যখন রাসুল (সাঃ) এর ওফাত লাভের তথ্য গিয়ে পৌছায় ততক্ষণে ২রা রবিউল আওয়াল পরে গেছে। তাই কেও কেও বর্ণনা করেছেন যে রাসুল (সাঃ) ২রা রবিউল আওয়াল ওফাত লাভ করেছেন। যার ফলে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের তারিখ ১/২ রবিউল আওয়াল হিসেবে প্রচারিত হয়।
পরবর্তীতে চক্রান্তকারীরা ১/২ এর মাঝ থেকে “/” চিহ্নটি তুলে দিয়ে এই তারিখটিকে ১২ তে পরিণত করে। উদ্দেশ্য একটাই যে ১২ই রবিউল আওয়াল কে যদি রাসূল (সাঃ) এর ওফাত দিবস হিসেবে উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে তুলে ধরা যায় তাহলে ১২ই রবিউল আওয়াল রাসূল (সাঃ) এর ওফাত দিবস হিসেবে মানতে গিয়ে ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী কেও পালন করবে না।
অনেকেই ১২ই রবিউল আওয়ালকে একই সঙ্গে রাসুল (সাঃ) এর জন্ম ও ওফাত দিবস বিবেচনা করে এই দিনে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালন করতে চান না বরং কেও কেও এইদিনটিকে শোকের দিন হিসেবে জাতির কাছে তুলে ধরতেই বেশী পছন্দ করেন। কিন্তু এই ধরনের অযৌক্তিক বিশ্বাসের কারনে আমরা যদি এই পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবীকে দূরে ঠেলে দেই তাহলে ক্ষতি কিন্তু আমাদের নিজেদের-ই।
এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) ফরমান যে, “সর্ব প্রথম আল্লাহ্ তায়ালা আমার নূর কে সৃজন করেছেন।
আমি আল্লাহ্র নূর হতে আর সমগ্র সৃষ্টিরাজী আমার নূর হতে। ” [সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা-৩]
হাদিসে কুদসিতে ইরসাদ হয়েছে, “আমি আপনাকে না সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। ” [সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা-৭০]
সুতরাং যে মহামানবকে উদ্দেশ্য করে এই বিশ্ব জাহান সৃষ্টি সেই মহামানব যেদিন সশরীরে এই ধুলির ধরায় আগমন করেছিলেন সেই দিনটি যে আল্লাহ্র কাছেও খুশির দিন ছিল একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানি (রহঃ) তার ফাতহুল বারীর ৯ম খণ্ডে বর্ণনা করেছেন হযরত সুহাইলি (রাঃ) কর্তৃক হযরত হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “তিনি বলেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্ন দেখি যে সে অত্যন্ত আযাবের মধ্যে আছে। ” তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে আবু লাহাব জানায় “তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি।
তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়। ” হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন, “তার এই আযাব লাঘবের কারণ হল হযরত রাসুল (সাঃ) এর জন্মদিন ছিল সোমবার। রাসুল (সাঃ) এর জন্মের শুভ সংবাদ নিয়ে আসায় সে তার দাসী সুয়াইবাকে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল। ”
যে আবু লাহাব সারাজিবন আমাদের দয়াল রাসুল (সাঃ) এর বিরধিতা করে গেলো এবং যে ছিল একজন কাফের শুধুমাত্র রাসুল (সাঃ) এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ার কারনে আল্লাহ্ প্রতি সোমবার তার আযাব লাঘব করেন। আমরাও যদি রাসুল (সাঃ) এর জন্মের এই শুভ দিনটিতে খুশি হতে পারি এবং অন্য ২টি ঈদ এর মতই পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রকৃত ঈদ এর আনন্দ উদযাপন করতে পারি তাহলে নিঃসন্দেহে তা পরকালে আমাদের মুক্তির ওসিলা হিসেবে কাজ করবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।