আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নৈতিকভাবে তারেকও দণ্ডিত

তারেক রহমানের বেকসুর খালাসের রায়ে বিএনপি উল্লসিত। তবে তারেকের নৈতিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কথা। কারণ, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এর বাইরে আরও একটি পক্ষ আছে। তাদের প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে চাইব।

তিনি হলেন ডেবরা লাপ্রোভোত্তে, মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এজেন্ট। দেশের আইন-আদালতের স্বরূপ জানার জন্যও তাঁর প্রতিক্রিয়াটি জানা দরকারি। এর কার্যকারণ থেকেই আমরা আইন বুঝব। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বুঝব। রাজনীতি বুঝব।

আর প্রথমবারের মতো সম্ভবত কূটনীতির তল মাপতে পারব। কোথা দিয়ে কী যে হয়ে গেল!

দুর্নীতির দায়ে এই রাষ্ট্র কোনো দুঁদে রাজনীতিককে দণ্ড দেয় না। এরশাদ ব্যতিক্রম। দুই বড় দল কখনো নিজেদের কারও চূড়ান্ত দণ্ড নিশ্চিত করেনি। এই অপ্রিয় সত্য অস্বীকৃত ও অনুচ্চারিত।

অমোঘ নিয়তির মতো এটি একটি অপশাসনগত আঁতাত। তাই পড়ন্ত বেলার একটি চমক যেন অবোধগম্য কারণে ভেস্তে গেল। নিম্ন আদালতের দন্ড তো এঁদের জন্য ডালভাত। এঁরা সব সময় সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত চোখ রাখেন। শেষ না দেখে ছাড়ে না।

তারেকের ক্ষেত্রে ‘পরাধীন বিচার বিভাগ’ তাদের স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।

তবে প্রেক্ষাপটটি বেশ। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ঢাকায়। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার টাটকা অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরবেন। ২০ নভেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের বৈদেশিক সাব-কমিটিতে ‘গোলযোগপূর্ণ বাংলাদেশ’ নিয়ে শুনানি হবে।

সেখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যারা যুদ্ধাপরাধ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে উচ্চকিত, তাদের মুখপাত্র জবানবন্দি দেবেন।

২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার আদালতে ডেবরা তথ্য-প্রমাণ দাখিল করেছিলেন। টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হবে। অভিযোগ হলো, এই কাজ পাইয়ে দিতে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বন্ধু মামুনকে টাকা দেওয়ার। হার্বিন পাওয়ার ইক্যুইপমেন্ট লিমিটেড চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান।

এর স্থানীয় এজেন্ট নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এর চেয়ারপারসন খাদিজা ইসলাম। আদালতে দেওয়া তাঁর বিবৃতির সঙ্গে এফবিআইয়ের এজেন্টের তথ্যগত অমিল নেই। তবে খাদিজার দাবি, বেআইনি টাকা না, কনসালট্যান্সি ফি।

তারেকের বন্ধু মামুন কত বড় জ্ঞানী-গুণী লোক, যিনি ফি নিতে পারেন কোটি কোটি টাকা।

টঙ্গীতে একটি মামুলি প্ল্যান্ট বসাতে মামুন কি এমন কারিগরি পরামর্শ দিতে পারেন? আর সেই টাকা দেশের ব্যাংকে পোষায় না, সিঙ্গাপুরে জমা করতে হয়। বিএনপির কাছ থেকে উল্লাস নয়, সঠিক তথ্য চাই।

ডেবরা সঠিক হলে কীভাবে তারেক বেকসুর খালাস পেতে পারেন, তা আমাদের মাথায় ঢুকছে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়তে চাই। গতকালের রায় মূলত ফখরুদ্দীন আহমদ, জেনারেল মইন উ আহমেদ এবং লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরীর প্রচেষ্টারই ফল।

২০০৮ সালে মার্কিন সরকারের সঙ্গে তাঁরাই এই অর্থ পাচারের তদন্তে চুক্তি করেছিলেন। ২০০৭ সালের জুনে অবশিষ্ট ২০ কোটি টাকা তাঁরাই আনেন। ওই পর্যন্ত এগিয়ে না থাকলে গতকালের রায়টা কপালে জুটত, তা হলফ করে বলতে পারি না। এর প্রমাণ ক্ষমতাসীনেরা বিএনপি-জামায়াতের আর কোনো কীর্তি (দুর্নীতি) নিজেদের মামলাসূত্রে আদালতে নেয়নি।

ডেবরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, ২০০৩ সালের ১৮ আগস্ট খাদিজা মামুনকে টাকা দেন।

এই হিসাবের অনুকূলে সিটিব্যাংক এনএ দুটি ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। প্রথম ভিসা ক্রেডিট কার্ড (৪৫৬৮৮১৭০০০০৬৪১২৪) মামুনের। দ্বিতীয় ক্রেডিট কার্ড (৪৫৬৮৮১৭০১০০৬৪১২২) তারেকের। ডেবরা বলেন, ‘আমি ব্যাংক থেকে তারেকের পাসপোর্টের (ওয়াই০০৮৫৪৮৩) ফটোকপি উদ্ধার করি। ’ বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের আছে আহ্বান, তাঁরা যেন এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন।

কারণ, তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে ডেবরা ও মার্কিনরা নিপাত যাক বলতে ইচ্ছে করছে!

ডেবরা আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার সময় উচ্চ স্বরে সিঙ্গাপুরের কাগজপত্রে তারেকের বয়ানে তাঁর পিতার নাম ‘মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম’ এবং তাঁর মায়ের নাম ‘বেগম খালেদা জিয়া’ উল্লেখ করেন। ডেবরা বলেন, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তারেক ওই ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ৫০,৬১৩.৯৭ ডলার খরচ করেন। এর সিংহভাগ যে খাদিজারই পাঠানো টাকার অংশ, ডেবরা তা-ও নির্দিষ্ট করেন। অথচ গতকালের রায়ে ২০০৭ সালে দাখিল করা তারেকের একটি সম্পদ বিবরণীর তথ্য এসেছে। এমনকি এর বরাতে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের আইনজীবীরা উল্লেখ করেছেন।

সম্পদ বিবরণীতে অনেকে কালো টাকার উপার্জনও বৈধ আয় হিসেবে দাবি করতে পারেন। আদালত কী প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন সেটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন।

কী বিচিত্র এই দেশ! এই মামলার বিচার শুরু হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। কেবল তারেককে নির্দোষ দাবি করেননি তিনি, দিব্যি মামলাটিকে ‘ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ রকমই বা কাছাকাছি একটি দৃশ্য এর আগে ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরীর দেওয়া চেক নিয়ে দেখেছি।

আদালত শুধু অনৈতিকতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন না। রাজনীতি আজ প্রায় পুরোপুরি নৈতিকতাবিবর্জিত। কতিপয় বিবেকবর্জিত লোক জুটেছেন, এঁরা বিষাক্ত তত্ত্ব গেলাচ্ছেন। বলছেন, এটাই নাকি রাজনীতি। আপাতত খটকা একটাই।

মামুন দণ্ডিত হলে মামুনের ব্যাংক-বন্ধু কী করে বেকসুর হতে পারেন? তারেক মামুনের পাচার করা টাকার অনুকূলে দেওয়া ক্রেডিট কার্ডই তো ব্যবহার করেছেন। ওই টাকা তারেক গ্রিসের এথেন্স, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক এবং দুবাইয়ে কেনাকাটা ও চিকিৎসায় খরচ করেছেন। ওই সব স্থানের ভিডিও ফুটেজ হয়তো সাক্ষ্য দেবে যে, কারা তখন তারেকের সঙ্গী ছিলেন।

তারেকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অপ্রমাণিত? নাকি মিথ্যা প্রমাণিত? ‘অপ্রমাণিত’ ও ‘মিথ্যা প্রমাণিত’ কথায় অনেক ফাঁক। অপ্রমাণিত বললে ধরে নেব, আদালত বুঝতে পারলেও উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেননি।

আর মিথ্যা প্রমাণিত লেখা হলে আদালত একটি দায়িত্ব নেবেন বলে গণ্য হবে।

আদালত তো নিজ থেকেও ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করতে পারেন। তারেক টর্ট (ক্ষতিপূরণ) আইনে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। টাকা পাচারের মামলায় তিনি ১০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারেন। দণ্ডবিধিতে সাজানো মামলার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট প্রতিকার রয়েছে।

কিন্তু পরিহাস অন্যত্র। এভাবে ফয়সালার দেশ আমরা গড়তে পারিনি। কল্পনাতেও ধরা দেয় না।

একে দেখতে হবে প্রধানত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এফবিআইয়ের তত্ত্বাবধায়নকারী বিশেষ এজেন্ট ডেবরা।

১৬ বছর ধরে এফবিআইয়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। ফরেনসিক সায়েন্সে স্নাতকোত্তর, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার নিজের দেশে জবানবন্দি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিংয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে বিবেচনা করা হয়। ’

২০০৯ সালের মে মাসে মার্কিন ফেডারেল কোর্ট ষড়যন্ত্রমূলক কর জালিয়াতির দায়ে স্যামুয়েল আর্ল পোপকে ৫১ মাস দণ্ড এবং এলেথিয়া অলিভিয়াকে ৩৭ মাস জেল দিয়েছিলেন। এই মামলার তদন্তকারীদের মধ্যে ডেবরা ছিলেন এবং সে জন্য তিনি প্রশংসিত হন। ডেবরার ভাগ্যে কী জুটবে? তাঁর অভিযোগ আপাতত অর্ধেক প্রমাণিত।

তারেককে তিনি কেন ও কী কারণে দুষলেন বলে মনে হলো? নাকি আমরা ফতোয়া পাব মামুনের হারামের টাকার ভাগ খাওয়া হারাম নয়? মামুন ব্যবসায়ী বন্ধু। তাঁর অসৎ উপার্জনের দায় কেন তাঁর সৎ বন্ধুরা নেবেন? এমন জলবৎতরলং কিছু শুনব কি?

তবে ডেবরা লাপ্রোভোত্তের জবানবন্দি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাষ্ট্র এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। মার্কিন কংগ্রেসে এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ খালেদা জিয়াকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে টুইট করেছেন। এই ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ ও তাঁর মিত্ররা ওই দায় এড়াতে পারেন না। ডেবরা আদালতে ৭৫ মিনিট কথা বলেছেন।

সাক্ষ্য হিসেবে ৪৩ পৃষ্ঠা এবং অন্যান্য নথি হিসেবে আরও ২২৯ পৃষ্ঠা জমা দিয়েছেন। কথিত জনপ্রিয়তার ঢলে এই ইতিহাস ভেসে যাবে না। এর সঙ্গে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ভাবমূর্তিও জড়িত। পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যন্ত আর মন্তব্য নয়, তবে আমরা ডেবরার সাক্ষ্যকে নাকচ করি না। তারেকের বেকসুর খালাস দেখে বিএনপির নর্তনকুর্দন অনৈতিক ও অশোভন।

গতকাল তারেক নৈতিকভাবে দণ্ডিত হয়েছেন।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।