আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই

হরতাল শব্দটি গুজরাটি। শব্দটি এসেছে হরিতাল বা সবুজাভ পীতবর্ণ থেকে। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আমলে কঠোরভাবে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা হতো। রাজকর্মচারীরা হঠাৎ হাটবাজারে হাজির হতেন। তারপর নির্দিষ্ট একটা স্থানে কাঠের বেড়া হরিতাল রঙে রঞ্জিত করে দিতেন।

এর দ্বারা বুঝানো হতো যে, অতঃপর এই হাটবাজার বন্ধ ঘোষণা করা হলো। রাজকর্মচারীরা হাটবাজারের দোকানপাটের মালামালের হিসাব নিতেন। জিনিসপত্রের দরদাম ঠিক করে দিতেন এবং যাওয়ার সময় ওই বেড়ার হরিতাল রং মুছে দিয়ে যেতেন। হাটবাজার আবার যথারীতি বসত, চলত। সেই থেকে হাটবাজারের বেচাকেনা বন্ধের জন্য হরতাল শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

পরবর্তীকালে হরতাল শব্দটি রাজনৈতিকভাবে ধর্মঘটের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এখন হরতাল বলতে বিক্ষোভ-প্রকাশার্থে দোকান-হাট, কাজকর্ম প্রভৃতি সাময়িকভাবে বন্ধ করা বুঝায় (সংসদ বাংলা অভিধান)। হালে প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিবঙ্গে হরতাল শব্দের বদলে হিন্দি 'বন্ধ' শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। এর দ্বারা হাটবাজার, দোকানপাট, অফিস-আদালতসহ গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধের কথাই বুঝানো হয় এবং তা বুঝানো হয় প্রতিবাদী অর্থেই। (তথ্য সূত্র : স্থান-কাল-পাত্র, দৈনিক ইত্তেফাক ১২/৩/০৪)

হরতাল অবরোধ ও রাজনৈতিক হানাহানিতে গত ২২ বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

একই সময়ে আহত হয়েছেন এক লাখেরও বেশি মানুষ। ১৯৯০ সালে এরশাদের ক্ষমতা ত্যাগের পর থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করে দেশ। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতার কারণে গণতন্ত্র শব্দটি বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রচর্চার অভাবে রাজনীতিতে আপসহীন মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হানাহানিতে ঝরে পড়ছে বিপুল সংখ্যক প্রাণ।

সারা জীবন পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে কাউকে কাউকে। খাতাপত্রে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও গণতন্ত্রচর্চার অভাবে তার বিকাশ ঘটছে না। গড়ে উঠছে না রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের মধ্যে সহনশীলতার মনোভাব। নির্বাচন এলেই হানাহানি নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের সংবেদনশীলতায় আঘাত হানলেও এই অদৃশ্য বৃত্ত থেকে রাজনীতিকরা বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা সৎ ও সত্যিকারের সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের এক বড় অংশকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। এ শূন্যতায় সমাজবিরোধীরা রাজনীতিতে জেঁকে বসার সুযোগ পাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বুড়িগঙ্গা পাড়ের এই দেশের যা কিছু মহান অর্জন তার প্রায় সবই এসেছে রাজনীতিকদের হাত ধরে। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের জয় সম্ভব হয়েছে রাজনীতিকদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের পথে জাতির প্রত্যাবর্তন ঘটলেও গণতন্ত্রচর্চার অভাবে তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ।

রাজনীতিকদের ভুলে আজ বিদেশিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলাতে চেষ্টা করছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এটি কোনো সুখবর নয়। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই যাতে আমরা সমাধান করতে পারি সে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

সস্তা শ্রমের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হলেও হরতাল ও রাজপথের সহিংসতার ভয়ে তারা এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির হিসাব মতে, একদিনের হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে ১৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

হরতাল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। হরতালের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকে, সেখানে শিক্ষার্থীদের যাওয়া-আসা করতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। হরতালে ককটেলের যথেচ্ছ ব্যবহার জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ককটেলের আঘাতে যারা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম কর্মীও রয়েছেন।

পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বহু ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও নিরীহ পথচারীরাও নিগৃহীত হয়েছেন। হরতাল গণতান্ত্রিক কর্মসূচি হলেও এর গণতান্ত্রিক চরিত্র ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। জ্বালা-পোড়াও, বোমাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সবে ঞধশব ড়ভভ পর্যায়ে আছে।

'গরিবের বউ সবার ভাবী' এই কনসেপ্টের আওতায় আমাদের ঘরের বিষয়টি নিয়ে অন্যরা মাথা ঘামাচ্ছেন, এটি শুভ নয়। একবার বল অন্যের কোটে চলে গেলে ফিরে পেতে অনেক ক্লেশ ভোগ করতে হয়। এদিকে এটি সুরাহা করতে কাউকে বাদ দিয়ে এককভাবে চিন্তা করা যাবে না। এতে আপাতত স্বস্তি এলেও সুখ-শান্তি আসবে না, যা ইতিহাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে থাকে। এর মধ্যেই শহরাঞ্চল থেকে গ্রাম্য জনপদে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিরোধী দল ছাড়াই সরকার নির্বাচনের পথে যেতে চাচ্ছে। গণতান্ত্রিক দিক দিয়ে সবার পার্টিসিপেশন আবশ্যক, নতুবা চলমান ঘা আপাতত প্রশমিত হলেও পরবর্তী ক্যান্সারাস ঘাতে উদ্ভব হওয়ার বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। একটি কথা মনে রাখতে হবে সব মানুষই সমান। কেননা কারও একটি, আবার কারও দুটি বা তিনটি ভোটের মৌলিক অধিকার নেই। সবারই একটি ভোট।

তাই সবিনয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি; কাউকে ছোট-বড় বলে নিগৃহীত করবেন না। কেননা প্রত্যেক মানুষ তার চিন্তাধারার রাজত্বে সে রাজা সেখানে কারও নাক গলানো ঠিক হবে না। তা ছাড়া আরও সানুনয়ে অনুরোধ করব, সবাইকে মর্যাদা দিয়ে কথা বলতে হবে এবং ব্যক্তিগত বিষয়ে আক্রমণ করে কথা বলা ঠিক হবে না। অর্থাৎ কোনো ধরনের বাক্য দূষণের মধ্যে যেন না পড়তে হয়। তাই বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে সংঘাত এড়ানোর জন্য সমঝোতার বিকল্প আছে কিনা আমার জানা নেই।

পরিশেষে সবার বিবেকের এজলাসে যথাযথ সম্মান রেখে এই মর্মে একটি কথা বলছি, এই সোনার দেশটি কিন্তু আপনার, আমার ও সবার। এটি ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিদের নয়। যে অবস্থা দেখছি হাতে এতটুকু সময় নেই। এখনই এবং এই মুহূর্তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সমঝোতার ব্যাপারে বর্ণিত পরার্মশ যদি বাস্তবভিত্তিক মনে করেন, তাহলে ভেবেচিন্তে সচেষ্ট হতে পারেন।

আবারও বলছি, উধুং ধৎব নবরহম পড়ঁহঃবফ, তাই সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।