উন্নয়নের ধারা টেকসই করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাংলাদেশকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ ও কাজের পরিবেশ উন্নততর করতে হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই অভিমত তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ: উন্নততর আর্থসামাজিক পরিণতির জন্য উন্নততর কাজের পরিবেশ চাই’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন গত সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে জেনেভায় আইএলওর প্রধান কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট।
’
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি, শ্রমমান ও কাজের পরিবেশ এবং তৈরি পোশাক খাতের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকতর উন্মুক্ত ও বাজারমুখী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
আইএলও বলছে, বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোগের প্রধান বাধাগুলোর অন্যতম হলো দক্ষ শ্রমিকের অভাব। আর তাই শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো ও শ্রমশক্তির জন্য উন্নতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অভিবাসন নীতিরও সমন্বয় করতে হবে, যেন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবাসী-আয় বাড়ানো যায়।
আইএলও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমভাবে বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর আওতা ও পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত শ্রমবাজার প্রবর্তন করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সমন্বিত শ্রম বাজার ও সামাজিক নীতির প্রবর্তন করা না যাবে, বাংলাদেশ তার অর্থনীতির গতিময়তা ও জীবনযাত্রার মান টেকসই পর্যায়ে ধরে রাখতে পারবে না। ’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘যেহেতু তৈরি পোশাক খাত অর্থনীতির কেন্দ্রে আছে, সেহেতু নতুন পদক্ষেপগুলো হতে হবে সুদূরপ্রসারী। ’
আইএলও বলছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশ যে উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তা প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য।
১৯৯০ সালে যেখানে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল মাত্র দশমিক ৬ শতাংশ সেখানে ২০১১ সালে তা হয়েছে ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। অথচ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘শিল্পের নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশ এই খাতের কাজের পরিবেশ নিম্নমানে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে, যা এর টেকসই উন্নয়নে বাধা হয়ে উঠেছে। এমনকি ভয়াবহতম শিল্প বিপর্যয় ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট।
’
তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে ১১৪ জন শ্রমিক ও রানা প্লাজার ভবন ধসে এক হাজার ১৩৩ জন শ্রমিকের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করে আইএলও বলছে, গত ছয় মাসে বাংলাদেশ সরকার যদিও শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্যা কারখানার বিশেষত পোশাক কারখানার বাজে অবস্থা ঠিক করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমলেও ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে মাথাপিছু দৈনিক দুই ডলারের কম উপার্জনকারী মানুষ মোট জনগোষ্ঠীর ৭৬ শতাংশ। একই সময়ে নগর দরিদ্রদের ১০ শতাংশেরও কম সামাজিক সহযোগিতার আওতায় নেই।
আইএলও মনে করে, কাজের পরিবেশ উন্নত করা হলে তা রপ্তানির জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। একই সঙ্গে তা বাংলাদেশি তরুণদের বিশেষত নারীদের দেশের বাইরে যাওয়া থেকে অনেকটাই নিবৃত করবে।
আর কাজের জন্য বিদেশে যেতে গিয়ে বাংলাদেশি তরুণেরা অনেক চড়া মাশুল দেন। কাজের জন্য বিদেশে যেতে তাঁদের মাথাপিছু জিডিপির সাড়ে চার গুণ বেশি অর্থ গুনতে হয়, যা এশিয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ। তার পরও যেসব দেশে যায়, সেখান নিয়োগকারীদের দ্বারা অপদস্থ ও হয়রানি হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মজুরি নির্ধারণ নীতিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষত ন্যূনতম মজুরির ভূমিকা বাড়াতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর নভেম্বর মাসে ত্রিপক্ষীয় মজুরি বোর্ড যে মজুরি প্রস্তাব করেছে, তা নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে। ’
অনানুষ্ঠানিকভাবে যাঁরা কাজে নিয়োজিত, তাঁদের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করে আইএলও। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বছরে ২০ লাখের বেশি কর্মক্ষম মানুষ গত দুই দশক ধরে জনগোষ্ঠীতে যুক্ত হলেও গত ১০ বছরে গড়ে দুই লাখ করে মানুষের আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হয়েছে। এর ফলে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ১৯৯৯-২০০০ সময়কালের ৭৫ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ’
বাংলাদেশের পল্লি সমাজ ও কৃষির আধুনিকায়নসহ বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে তাৎপর্যবহ হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএলও।
কিন্তু শিক্ষা, শ্রমবাজার ও কাজের পরিবেশে নারীরা বড় বৈষম্যের শিকার, যা কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।