মূল রচনা: পড়ুন বাংলাদেশের ছেলে নাফিস বিন যাফরের চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার জয়ের গল্প
ছয়-সাত বছর বয়স তখন। সকালে স্কুল থেকে বলা হলো বিকেলের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে হবে নাফিস বিন যাফরকে। মা জানেন, ছেলে আবৃত্তিটা ভালোই করে। নাফিসকে বললেন, ‘কোনটা করবে?’ সুকুমার রায়ের বই হাতে নিয়ে নাফিস জানাল, ‘আবোলতাবোল’ আবৃত্তি করবে। ‘কিন্তু এটা তো তোমার মুখস্থ নেই।
’ নাফিসের উত্তর, ‘মুখস্থ কবিতাগুলো তো পুরোনো। আমি নতুন কিছু করতে চাই। ’ এরপর বিকেলের অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার উঠেছিল নাফিসের হাতে।
এখন নাফিস বিন যাফর ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন নামে বিশ্বখ্যাত যে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেখানে কাজের শর্ত হলো প্রতিটি নতুন চলচ্চিত্র বা প্রকল্পে নতুন ধরনের অ্যানিমেশন কৌশল দেখাতে হবে। আর তাই তো নতুন কিছু করার আনন্দে মেতে আছেন নাফিস।
নিত্যনতুন অ্যানিমেশনে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন গোটা দুনিয়াকে।
বাস্তব চলচ্চিত্রে বিশেষ আবহ সৃষ্টি হোক বা অ্যানিমেশন ছবিতে তাক লাগানো কৌশলই হোক, হলিউডের চলচ্চিত্রে চলে প্রযুক্তি আর সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ চর্চা। নাফিস এখন ড্রিমওয়ার্কসের প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার। তবে এই প্রকৌশলী ইট-পাথর-কংক্রিট নিয়ে কাজ করেন না, অ্যানিমেশন ও বিশেষ আবহ সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখেন। তাঁর লেখা প্রোগ্রাম ব্যবহার করে চলচ্চিত্রে দেখানো হয় পুরো ম্যানহাটন শহর জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া, আকাশছোঁয়া দালানকোঠা ভেঙে পড়ার দৃশ্য—কখনোবা কুংফুতে দক্ষ কোনো পান্ডার কাণ্ডকীর্তি।
অস্কার পেয়েছেন অস্কার দিচ্ছেন
নাফিসের হাতে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেরা পুরস্কার অস্কার এসেছিল ২০০৮ সালে। ডিজিটাল ফ্লুয়িড সিমুলেশন কৌশল তৈরির জন্য দুই সহকর্মী ডুগ রোবল ও রিও সাকাগুচির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ২০০৭ অর্জন করেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাফিস বিন যাফর। ‘কাজটা করে খুব মজা পেয়েছিলাম, তাই পুরস্কার পেয়ে খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। ’ সে বছরের বাংলা নববর্ষে ‘ছুটির দিনে’র তরুণদের বিশেষ সংখ্যায় নাফিসকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। এবার এসেছেন দেশে।
২৪ নভেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে মুখোমুখি বসে টের পাওয়া গেল তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। নাফিস নিজে যেমন, তাঁর ওয়েবসাইটও তেমন—সাদামাটা। www.nafees.net সাইটের শিরোনামে বাংলায় তাঁর নাম লেখা। সাদা পটভূমিতে খুব আপাত সাধারণ সাইটটিতে নাফিসের কাজ, তাঁর পরিবার, বেড়ানো এমনকি জটিল সব অ্যানিমেশনও। বিশেষ আবহের কৌশলগুলোর সহজ-সরল ব্যাখ্যাও রয়েছে।
নিজের সম্পর্কে তো দারুণ এক কথা লিখেই রেখেছেন: ‘আই ক্যান রিড অ্যান্ড রাইট কোড। দ্যাট অ্যাবাউট সামস ইট আপ। ’ এক জায়গায় আছে, “আমি একটা পুরস্কার জিতেছি, দেখো। ’ দেখো মানে ‘লুক’-এ ক্লিক করলেই দেখা যায় একটা কাঠবিড়ালির হাতে অস্কারের ট্রফিটা। সে বছর কারিগরি অস্কার বিজয়ীদের মধ্যে নাফিস ছিলেন কনিষ্ঠ।
গত দুই বছরের অস্কারেও তিনি সর্বকনিষ্ঠ, তবে মনোনীত বা বিজয়ী হিসেবে নন। নাফিস বিন যাফর কারিগরি অস্কারের বিচারকমণ্ডলীর একজন সদস্য। মানে, নাফিস এখন অস্কার দেন।
নাফিস বলেন, ‘বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতা খুব চমৎকার। ১৫ থেকে ১৬ জন বিচারক থাকেন।
অনেকের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগের অভিজ্ঞতা শুনি, খুবই ভালো লাগে। ’
রূপকথার মতো
যাফর বিন বাশার ও সৈয়দা নাফিসা যাফরের একমাত্র সন্তান নাফিস বিন যাফর। জন্ম ঢাকায়, ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর। ১৯৮৯ সালে এই পরিবার পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। নাফিস বলেন, ‘এর আগে কুমিল্লা ইস্পাহানী স্কুল, ঢাকায় শহীদ আনোয়ার স্কুল ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেছি।
’ নাফিসের মা বলেন, ‘ও আমাদের লক্ষ্মী ছেলে। ওকে বড় করতে তেমন কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। ’ শহীদ আনোয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর পর আর ছেলেদের পড়ার সুযোগ নেই। মা-বাবা তখন নাফিসকে মানারাতে ভর্তি করানোর কথা ভাবলেন। ইংরেজি মাধ্যম, তাই ক্লাস ফোরেই ভর্তি করাতে চাইলেন।
নাফিস বেঁকে বসলেন, ‘এক বছর ধরে তো বলেছি ফোরে পড়ি, আরও এক বছর ফোরে পড়ি কীভাবে বলব?’ ভর্তি পরীক্ষায় খুব ভালো করলেন নাফিস, ভর্তি হলেন পঞ্চম শ্রেণীতেই। বাবা যাফর বিন বাশার ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে চাকরি নিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে বৃত্তি পেলেন যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার জন্য।
‘ওর বয়স যখন ১০ বছর, তখন আমরা তিনজন ছয়টা স্যুটকেস নিয়ে পাড়ি জমালাম যুক্তরাষ্ট্রে।
দক্ষিণ ক্যারোলাইনার চার্লসটনের স্কুল নাফিসকে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করল। এরপর ওকে নিয়ে গেল একাডেমি ম্যাগনেট হাইস্কুল। ’ জানালেন নাফিসা যাফর। এখানেও ভালো করলেন নাফিস। ১৬ বছর বয়সেই নাফিস শেষ করলেন ১২ বছরের শিক্ষাজীবন।
চার্লসটন কলেজে ঢুকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শুরু। মা-বাবা ভেবেছিলেন, ছেলে বোধ হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে ঢুকবে। কিন্তু কলেজের শেষ দিকে নাসার জন্য একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে দেওয়ার পর প্রোগ্রামিং নিয়েই এগিয়ে যেতে চান নাফিস।
নিত্যনতুন সৃজন
১৯৯৮ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রোগ্রাম বানাতে থাকেন নাফিস। এরপর যোগ দেন ডিজিটাল ডোমেইন নামের প্রতিষ্ঠানে।
এখানেই ফ্লুয়িড অ্যানিমেশন কৌশল তৈরি করেন। পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানসহ নানা ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে এই বিশেষ আবহ।
ডিজিটাল ডোমেইনের পর ড্রিমওয়ার্কস। এখন তাঁর হাতে আছে পিবাডি অ্যান্ড শারম্যান, হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগন-টু এর মতো ছবি। আগামী বছর মুক্তি পাবে এসব।
এর আগে নাফিস করেছেন শ্রেক ফরএভার আফটার, ২০১২, কুংফু পান্ডা ২-এর মতো ব্লকবাস্টার ছবি। তারও আগে ছবির তালিকায় আছে ট্রন, ট্রান্সফরমার-টু ছবির অ্যানিমেশন। ছবির পাশাপাশি করেছেন বিজ্ঞাপনের কাজও। নতুন কোনো কৌশল নিয়ে কাজ করছেন? ‘ফ্লুয়িড অ্যানিমেশন ছিল পানি বা তরল আগুনের বিশেষ আবহ তৈরি করার কৌশল। এখন আমরা কাজ করছি ডিস্ট্রাকশন টেকনিক নিয়ে।
মানে পুরো শহর ধ্বংস হবে এমন অ্যানিমেশন তৈরি করা হবে। দ্য ক্রুজ ছবিতে এমন কাজ করেছি। ’ নাফিস এখন বেশির ভাগ কাজ করেন অ্যানিমেশন ছবিতে।
প্রোগ্রামার, তবে...
নাফিস বিন যাফর কম্পিউটার প্রোগ্রামার। নানা রকমের প্রোগ্রামই লিখতে পারতেন।
তবে প্রোগ্রামের যুক্তিতে লাইনের পর লাইনের সংকেত লিখে চলচ্চিত্রে অসম্ভব সব কাণ্ডকারখানা ফুটিয়ে তুলছেন বাস্তবের মতো করে। সৃজনশীলতা তাঁর রক্তেই মিশে আছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন নাফিসের মামা। আর তাঁর মায়ের মামা শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। নিজের মাও ফুলেল নকশা নিয়ে কাজ করেন, বাবা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
মায়ের মতে, ‘বাবার কাছে গণিত আর বিজ্ঞান পেয়েছে আর আমার দিক থেকে সৃজনশীলতা। ’
নাফিস যে প্রোগ্রাম লেখেন, তা দিয়ে কম্পিউটার অ্যানিমেশনের বাকি কাজ করে দেয়। প্রোগ্রামেই যাবতীয় নির্দেশনা দিয়ে দেন। ‘তবে একদম শুরুতে তো কিছু থাকে না। তখন আমাকে একটা স্কেচ দাঁড় করাতে হয়।
তাই আঁকার বিষয়টা রয়েই যায়। ’
মুরগি কেন মিউট্যান্ট নামে বাংলাদেশের একটা অ্যানিমেশন ছবি দেখেছিলেন বেভারলি হিলসের এক উৎসবে। সেটার কথা বারবার বলছিলেন নাফিস। ‘ওটার কথা মনে পড়লেই হাসি পায়, খুব মজার ছবি। দারুণ সব সংলাপ।
’ তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘বাংলাদেশে মেধা আছে, দরকার অবকাঠামোর কিছুটা উন্নয়ন। ’
মা-বাবা থাকেন নিউইয়র্কে, আর নাফিস থাকেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। যাওয়া-আসা, কথাবার্তা হয় সব সময় । প্রোগ্রামিং সংকেত লেখার বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসও নিতে যান। অবসরে বই পড়েন, কনসার্টে গিয়ে গান শোনেন।
ভালোবাসেন রান্না করতে।
সবার আগে কাজ
লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার আগে অনেকের মতো হলিউডের গ্ল্যামার নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল নাফিসের। ‘এখন আমি বুঝি যে এখানে গ্ল্যামার আছে, ড্রাগস আছে—কিন্তু সবাই নিজের কাজের ব্যাপারে খুব সৎ। নিজের ক্ষমতা তুলে ধরতে কাজটা করা লাগে ঠিকভাবে। ’ একটা উদাহরণও দিলেন তিনি।
এক দিন এক ছবির শুটিংয়ে গিয়ে দেখেন একজন অভিনেতা উল্টো অভিনয় (রিভার্স অ্যাকটিং) করছেন। মানে উল্টো করে হাঁটছেন, উল্টো করে ঠোঁট নাড়াচ্ছেন। ‘আর সবই করছেন অর্ধেক গতিতে। এটা দেখে আমি তখন বুঝলাম, অভিনয় কী আর কেনইবা এঁরা এত বেশি টাকা পান। ’
নাফিস বললেন, ‘আত্মসমালোচনা করতে হয় প্রথমে।
কোনো কাজ শেষ হওয়ার পরই আমরা দেখি, তৃপ্তি পাওয়ার তো কিছু নেই। অনেক জায়গায় ভুল-ত্রুটি আছে। নিজেদের খুব একটা অভিনন্দিত করতে পারি না। ’
আর এ কারণেই হয়তো নাফিস বিন যাফর অভিনন্দন পেতে থাকেন বাদবাকি সবার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।