আমরা এমন একটা পরিবেশ চাই, যেখানে শিশুরা তাদের পছন্দ-অপছন্দের ধাপগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় হবে।
===ফয়সল সাইফ===
পবিত্র কোরআন প্রাচীন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দিকে মানুষকে আহবান করে না, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে না এবং বিরোধিতাও করে না। এর বিশেষত্ব হলো, মানুষ যদি নির্ভূল কোনো জ্ঞান লাভ করে; আর তা পবিত্র কোরআনে খুঁজতে যায়, তবে সেটা নির্ভূল বর্ণনাতেই পাওয়া যায়। যদিও তা বিস্তারিত নয়।
ধর্মবিরোধীদের একটা অভিন্ন অবস্থান এই যে, তাঁরা সব ধর্মকে এক পাল্লায় রেখে বিচার করেন।
আর নির্দিষ্ট একটি ধর্মের ত্রুটি সব ধর্মের ওপর ছড়িয়ে দেন। এর ফলে, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর ভূলের দায় পবিত্র কোরআনকেও বহন করতে হয়। আসুন আমরা দেখি, সেটা কতটা যৌক্তিক।
(১) মহাবিশ্ব এবং প্রাণ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা: সহীহ বোখারী শরীফের একটি হাদিসে- ইবনে কাসীর ইবনে জরীরের বরাত দিয়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- মদীনার ইহুদীরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে একত্রিত হয়ে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীকে রোববার ও সোমবার, পর্বতমালা ও খনিজ দ্রব্যাদি মঙ্গলবার, উদ্ভিদ-ঝড়না ও অন্যান্য বস্তু এবং জনশূণ্য প্রান্তর বুধবার সৃষ্টি করেছেন। এতে মোট চারদিন সময় লাগে।
তারপর বৃহস্পতিবার দিন তিনি আকাশ সৃষ্টি করেন। আর শুক্রবার তারকারাজি, সূর্য-চন্দ্র ও ফেরেশতা সৃজিত হয়। শুক্রবার দিনের তিন প্রহর বাকি থাকতে এসব কাজ শেষ হয়। তারপর সেই দিনের দ্বিতীয় প্রহরে সম্ভাব্য বিপদাপদ সৃষ্টি করা হয়। আর শেষ প্রহরে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়।
ইবলীসকে আদেশ করা হয় তাঁকে সেজদা দিতে। ইবলীস অস্বীকার করলে তাঁকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসব কাজ তৃতীয় প্রহরের শেষ দিকে সমাপ্তি লাভ করে। (ইবনে কাসীরের মতে এই হাদিসটি তুলনামূলক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত)।
তা ছাড়া সহীহ মুসলিমে বর্ণিত- আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বাচনিক এক রেওয়াতে জগত সৃষ্টির শুরু শনিবার থেকে বলা হয়েছে।
এই হিসাবে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি ৭ দিনে হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে এ সৃষ্টি ৬ দিনে হয়েছে। (এ কারণে হাদিসবিদগণ আবু হুরায়রা (রাঃ) এর উক্তিটি অগ্রাহ্য বলে বাতিল করে দেন। কেউ কেউ এটাকে কা’বে আহবারের উক্তি বলেও অভিহিত করেছেন)।
এখানে উল্লেখ্য, যে ইবনে আব্বাসের বর্ণিত প্রথম হাদিসটিও ইবনে কাসীরের মতে অগ্রাহ্য।
কারণ প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে- শেষ প্রহরে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়। ইবলীসকে আদেশ করা হয় তাঁকে সেজদা দিতে। ইবলীস অস্বীকার করলে তাঁকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কিন্তু, পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা আছে- আদম সৃষ্টির ঘটনা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির অনেক পরে হয়েছে। তখন পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বিদ্ধমান ছিল।
এবং জ্বীন ও শয়তানরা পৃথিবীতে বাস করতো।
এমতাবস্থায় হাদিসবিদগণের মতে- উপরোক্ত রেওয়াতগুলো ইসরায়েলী রেওয়াত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যেহেতু বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্টের সাথে এর মিল রয়েছে।
তবে, এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের ভাষ্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
সূরা নাযিয়াত: আয়াত (২৭) তোমরা কী সৃষ্টিতে কঠিন না মহাকাশ? তিনিই এসব বানিয়েছেন। (২৮) তিনি এর উচ্চতা উন্নিত করেছেন এবং একে সুবিন্যস্ত করেছেন।
(২৯) আর এর রাতকে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন, আর বের করে এনেছেন দিবালোক। (৩০) আর পৃথিবী- এর পরে তাঁকে প্রসারিত করেছেন। (৩১) এর থেকে তিনি বের করেছেন তাঁর জল আর তাঁর চারণ ভূমি। (৩২) আর পাহাড়-পর্বত- তিনি তাঁদের মজবুতভাবে বসিয়ে দিয়েছেন। (৩৩) তোমাদের জন্য এবং তোমাদের গবাদিপশুদের জন্য খাদ্যের আয়োজনে।
উপরোক্ত আয়াত সমূহকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই- প্রথমে আল্লাহ তা’য়ালা শূন্য আকাশকে উচ্চতা দান করেছেন এবং সেটাকে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। তখন তাঁতে কিছুই ছিল না। তারপর তিনি গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহ সমস্থ কিছু সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীকে দিলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত আর দিবালোক। একে তিনি চারণ ভূমি রূপে প্রসারিত করেছেন এবং বের করেছেন তাঁর জল।
পাহাড়-পর্বতকে মজবুত ভাবে বসিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর খিলক হিসেব। তারপর সৃষ্টি হয়েছে জীবন্ত প্রাণ।
তাহলে, দেখা যাচ্ছে পবিত্র কোরআনের এই দাবী বৈজ্ঞানিকভাবেও অসত্য নয়। কারণ এখানে, গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহের বিচরণের জন্য স্থান প্রস্তুত করা হয়েছে সবার আগে। তারপর দৃশ্যমান সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে।
এর মধ্যে পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে যেহেতু সূর্যকে নক্ষত্ররূপে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু পৃথিবী পেয়েছে রাত-দিন। পৃথিবীকে বিরচণের উপযোগী করা হয়েছে এবং তাতে প্রাণের উপযোগী হিসেবে আলো ও জলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেহেতু আলো ও জল ছাড়া প্রাণ ঠিকতে পারে না। আর পর্বতমালা ছাড়া পৃথিবী সুদৃঢ় থাকতে পারত না। পবিত্র কোরআনের সবগুলো বর্ণনাই এখানে বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক এবং ধারাবাহিক।
কিছু সংখ্যক মানুষ এখানে পবিত্র কোরআনের সূরা ফুজিলাতের ৯-১২ নম্বর আয়াতের বর্ণনা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে। তাঁরা আসলে এক্ষেত্রে আয়াতের মর্মার্থই বুঝতে পারে না। বিষয়টা প্রাসঙ্গিক বলে, আমি সুরা ফুজিলাতের আয়াতগুলোর উল্লেখ করলাম- (৯) তোমরা কী সেই সত্ত্বাকে অস্বীকার কর, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে। এবং তোমরা কী তাঁর সমকক্ষ স্থির কর? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা (১০) তিনি পৃথিবীর উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, এবং তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন। এবং চারদিনের মধ্যে তিনি তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন- পূর্ণ হল জিগ্যাসুদের জন্য।
(১১) এরপর তিনি আকাশের দিকে মনযোগ দিলেন, যা ছিল ধুম্ররপুঞ্জ। অতপর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন- তোমরা আস, ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল- আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম। (১২) তারপর তিনি আকাশ মন্ডলীকে দুদিনে সপ্ত আকাশ করে দিলেন। এবং প্রত্যেক আকাশে তাঁর আদেশ প্রেরণ করলেন।
আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দিয়ে সুশোভিত ও সংরক্ষিত করেছি। এটা পরাক্রমশালী আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।
এই আয়াতগুলোকে বিশ্লেষণ না করে যদি সোজা হিসেবে ধরে নেওয়া হয় যে পৃথিবী সৃষ্টি করা হলো দুই দিনে, তারপর চারদিনে তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলো, তারপর দুদিন আকাশকে সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত করা হলো- তাহলে মোট দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় আটদিন। যেটা পবিত্র কোরআনের দাবী মতে- ছয়দিনে মহাবিশ্ব এবং প্রাণ সৃষ্টির বিপরীত (দ্রঃ সূরা ইউনূসের ৩ নম্বর আয়াত; সূরা সাজদাহ’র ৪ নম্বার আয়াত; সূরা ফুরকানের ৫৯ নম্বর আয়াত; সূরা হুদের ৭ নম্বর আয়াত; সূরা ক্বাহাফের ৩৮ নম্বর আয়াত; সূরা হাদীদের ৪ নম্বর আয়াত)। তবে, এখানে গভীর কালিতে উল্লেখ্য- চারদিনের মধ্যে তিনি তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন।
মুফাসসীরে কোরআনরা একমত, যে এটা পৃথক চারদিন নয়। বরং বলা হয়েছে চারদিনের মধ্যে খাদ্যের ব্যবস্থা অর্থাৎ প্রাণ সৃষ্টি করা হয়েছে। মানে ব্যাপারটা এরকম, একটা ঊদাহরণ দেই- ধরুণ আমি সর্বমোট চারদিন আমেরিকায় অবস্থান করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলাম। আর বাংলাদেশে ফিরে এসে বললাম- আমেরিকায় আমি দুইদিন নিয়ইয়র্কে ছিলাম। তারপর ওয়াশিংটন ঘুরে চারদিনের মধ্যে (চারদিনে) অস্ট্রেলিয়া চলে যাই।
তার মানে কী দাঁড়ায়? আমি কী দুই আর চার- মোট ছয়দিন আমেরিকায় ছিলাম, না দুই যোগ দুই- মোট চারদিন আমেরিকায় ছিলাম? চারদিন।
বর্ণনাটার গভীর মর্মার্থও তাই বলে। যেহেতু আমি নির্দিষ্ট করে বলিনি, যে নিউইয়র্কে দুইদিন ছিলাম আর ওয়াশিংটনে চারদিনই ছিলাম। সেহেতু এটা বললে ভূল হবে না, যে নিউইয়র্কে দুই দিন থাকার পর- উল্লেখ না করা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনে আমি দুইদিনই ছিলাম। কারণ আমেরিকায় থাকাকালীন সময়টাই ছিল মোট চারদিন।
উপরোক্ত আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে, যে দুই দিন পৃথিবী সৃষ্টির পর চারদিনের মধ্যে খাদ্যের ব্যবস্থা তথা প্রাণের সৃষ্টিজনিত চারদিন পৃথক চারদিন নয়। এটা মোট চারদিনের আওতাভূক্ত।
তারপর আমরা যদি উক্ত সূরার ১১-১২ নম্বার আয়াতদ্বয় বিশ্লেষণ করি- তাহলে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীকে ডাকলেন (এখানে পৃথিবীর নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার মানে হতে পারে, যেহেতু এখানেই আল্লাহ তা’য়ালার মূল উদ্দেশ্য প্রাণ সৃষ্টি করবেন এবং মানবজাতি পৃথিবীর সাথে অন্য যেকোনো গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহের চেয়ে বেশি পরিচিত এবং ধর্মগ্রন্থটাও তাঁদেরই জন্য- তাই)। এর মধ্যে আকাশ ছিল ধুম্ররপুঞ্জ বিশেষ। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত করলেন এবং শেষ আকাশকে প্রদীপ দ্বারা সুশোভিত করলেন।
সূরা নাযিয়াতের ধারা অনুযায়ী আমরা যদি এই অংশটাকে প্রাথমিক পর্ব ধরে নেই, তাহলে চমৎকার সমাধান চলে আসে। আর যেহেতু আয়াতে উল্লেখ নেই, যে প্রথম চারদিনেই পৃথিবী সৃষ্টি এবং প্রাণ সৃষ্টির কাজ সংঘটিত হয়েছিল- তাই এটা ধরে নিতে কোনো সমস্যা নেই (সচেতনভাবে মনে রাখুন-আমি এখানে আয়াতের কোনোরূপ অদল-বদলের কথা বলছি না)। কারণ, পবিত্র কোরআনের বর্ণনার ধারাই সেটা বলছে। পৃথিবী এবং প্রাণ যদি আগে সাজানো হতো, তাহলে আকাশের সাথে পৃথিবীকে ডাকার প্রয়োজন ছিল না। দুটো আলাদা থাকলে এমনিতেই আকাশকে বিন্যস্ত করা যেত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।