আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মালোচনা: পবিত্র ঈদ’ই মীলাদুন্নবী উত্তম বিদআত না নিকৃষ্ট বিদআত?

আমরা এমন একটা পরিবেশ চাই, যেখানে শিশুরা তাদের পছন্দ-অপছন্দের ধাপগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় হবে।

===ফয়সল সাইফ===

সূরা আনআম’এ মহান আল্লাহ’তায়ালা ইরশাদ করেন- (১৫৯) যাঁরা নিজেদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে নিজেরাই নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাঁদের কোনো দায়িত্বই তোমার ওপর নেই। তাঁদের ব্যাপারটা আল্লাহ তা’য়ালার হাতে। তখন তিনি তাঁদের বিস্তারিত বলবেন, তাঁরা কে কী করেছিল।

আমরা মুসলমানরা যেমন বিশ্বাস করি, যে পবিত্র কোরআনের একটা অক্ষরও বৃথা বা অনর্থক নয়; ঠিক সেরকম ভাবেই এখানে যা বিবৃত হয়েছে, পরবর্তী সময়ে তাই ঘটেছে।

মুসলমানরা এখন নানা দল-উপদলে বিভক্ত। এই বিভক্ত মুসলমান সমাজের একটা অংশের কাছে, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহাকে বিবেচনায় নিয়েও সবচেয়ে বড় ঈদ হল- ঈদ’ই মীলাদুন্নবী। আমার এই আলোচনা মূলত তাই নিয়ে। ইনশাল্লাহ, এখানে ধাপে ধাপে তা সম্পন্ন করব। তার আগে আমরা জেনে নেই, মীলাদ শব্দটি বলতে আসলে কী বোঝান?

মীলাদ: ‘মীলাদ’ শব্দের অর্থ জন্ম সময়।

তবে, যাঁরা মীলাদুন্নবী পালন করেন, তাঁরা মীলাদ বলতে শুধুমাত্র রাসূল (সাঃ) এর জন্মের সময় নিয়ে আলোচনা করা বোঝান না; বরং তাঁরা মীলাদুন্নবী বলতে- প্রতি বছর রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিন পালন করাকে বোঝান।

মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম: যেহেতু মীলাদ বলতে- প্রতি বছর রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিন পালন করাকে বোঝানো হয়, সেহেতু আমাদের জানতে হবে সেই দিনটা কোন দিন? সর্বসম্মত মত অনুসারে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম রবিউল আওয়াল মাসের সোমবারে হয়েছিল। কিন্তু তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে ৪টি রেওয়াত প্রসিদ্ধ আছে। যাহা- ২য়, ৮ম, ১০ম ও ১২শ। এর মধ্যে ১২শ তারিখের রেওয়াতটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

এমনকি হাফেজ ইবনে আসকালানী (রহঃ) এর ওপর ইজমার দাবী বর্ণনা করেছেন। এটাকেই কামেলে ইবনে আসীরে গ্রহণ করা হয়েছে। তা ছাড়া মাহমুদ পাশা মিশরী গণনার মাধ্যমে ৯ম তারিখ’কে গ্রহণ করেছেন। যা আবার জমহুরের সনদ বিহীন। চন্দ্রোদয়ের স্থান বিভিন্ন হওয়ার কারণে, গণনার ওপর এমন নির্ভরযোগ্যতা নেই, যা জমহুরের বিরুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করে।

তাই আমরা অধিক প্রসিদ্ধ মত অনুসারে ধরে নিতে পারি, যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ। তবে, তা’ই যে শতভাগ সঠিক- সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।

ইসলাম ধর্মে বার্ষিক ঈদ’ই মীলাদুন্নবী পালনের গুরুত্ব: কোনো সহীহ বা দুর্বল হাদীসে এমন কোনো প্রমাণ নেই, যে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় বা তাঁর মৃত্যুর পরে কোনো সাহাবী সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্মদিন উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করেছেন। তাঁদের পরে তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ীদের অবস্থাও তাই ছিল। এবং এঁরাই বিশুদ্ধ ইসলামী মত অনুসারে সর্বশ্রেষ্ট মুসলিমদের তিনটি যুগ [দ্রঃ সহীহ বোখারী- ৩৩৮৯]।

এঁরাই বাকি সবার কাছে অনুসরণীয়। উল্লেখ্য- রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিন উদযাপনের সাথে সহীহ হাদিসে সবচেয়ে কাছাকাছি যা পাওয়া যায়, তা হল- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রতি সোমবারে রোজা রাখতেন। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, সোমবার দিনটি তাঁর জন্মদিন এবং এই দিনেই তাঁর ওপর ওহী নাযিল হয়েছিল [দ্রঃ সহীহ মুসলিম- ২৬১৬]।
এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে প্রশ্ন রাখা যায়, যে জন্মদিনে যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোযা রেখে থাকেন, তাহলে তাঁর জন্মদিন পালনের নামে, ঈদ পালন ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা গ্রহণযোগ্য? যেহেতু আমরা জানি, ইসলামে ‘ঈদ’ এবং ‘রোজা’ শব্দ দুটি পরষ্পর বিরোধী। রোজা রাখা অবস্থায় ঈদ উদযাপন একেবারেই অসম্ভব।

আবার ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম [দ্রঃ সহীহ মুসলিম-২৫৩৭, ২৫৩৮, ২৫৩৯, ২৫৪০, ২৫৪১, ২৫৪২ সহীহ বোখারী- ১৮৬৭, ১৮৬৮]। তা ছাড়া আইয়ামে তাশরীকে’ও রোজা রাখা হারাম [দ্রঃ ২৫৪৩]।
মূলত কারো জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করার বিষয়টি আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। জন্মদিন পালন ‘আ’জামী’ বা অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ। ফলে প্রথম যুগের মুসলিমগণ এই সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেন না।

পারস্যের মাজুস বা অগ্নি উপাসক ও বাইযান্টাইন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল জন্মদিন, মৃত্যুদিন ইত্যাদি পালন করা। তবে, প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে পারস্য, সিরিয়া, মিসর ও এশিয়া মাইনরের যে সকল মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসেন, তাঁরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাহাবীদের অনুসরণ-অনুকরণ করতেন। এবং তাঁদের জীবনাচারণে আরবীয় রীতিনীতিরই প্রাধান্য ছিল। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম সম্রাজ্যে অনারব পারসিয়ান ও তুর্কী মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়। এরপর থেকে মুসলিম সম্রাজ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলন ঘটে।

তার মধ্যে পবিত্র ঈদ’ই মীলাদুন্নবী অন্যতম। এবং নিঃসন্দেহে তা ইসলামী ভাবধারার পরিপন্থী একটি নিকৃষ্ট বিদআত। সহীহ বোখারী শরীফে এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে - (৬৭৮১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর কিতাবই সর্বোত্তম কথা। আর সর্বোত্তম হেদায়াত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হেদায়াত। সুতরাং এ দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয়সমূহ (বিদয়াত) নিকৃষ্টতম।

আর তোমাদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই আসবে। তোমরা তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। তা ছাড়া নিকৃষ্ট বিদআত প্রবর্তক বা প্রবর্তকদের আশ্রয়দান কারীদের সম্পর্কে সহীহ বোখারী শরীফের অপর এক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে- (৬৮০৮) তাঁর ওপর আল্লাহ’তায়ালা, সকল ফেরেশতা এবং মানব সম্প্রদায়ের লানত।

ঈদ’ই মীলাদুন্নবী প্রবর্তনের ইতিহাস: দুই ঈদের বাইরে কোনো দিবসকে সামাজিকভাবে উদযাপনের শুরু হয় হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন শিয়াদের উদ্যেগে। সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরী বা ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের আব্বাসীয় খলীফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বনী বুয়াইহির শাসক মুইজ্জুদ্দৌলা ১০ই মহরম আশুরাকে শোক দিবস এবং ৮ই জিলহাজ্বকে গাদীর খুম দিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন।

এরপর মিশরে ৩৫৮ হিজরী বা ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৬৭ হিজরী বা ১১৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসমাঈলীয় শিয়া শাসকগণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২ ঈদের বাইরে কিছু দিবস পালন করতেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন জন্মদিন। যেমন: হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মদিন, হযরত আলী (রাঃ) এর জন্মদিন, হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর জন্মদিন, হযরত হাসান (রাঃ) এর জন্মদিন, হযরত হুসাইন (রাঃ) এর জন্মদিন।
হিজরী ৪র্থ শতাব্দীতে মিশর থেকে যে অনুষ্টান (ঈদ’ই মীলাদুন্নবী) উদযাপনের শুরু হয়, প্রাথমিক অবস্থায় তা কায়রোর বাইরে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে, ইরাকের অন্তর্গত ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর মাধ্যমেই এই উৎসব সুন্নী জগতে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়।


সহীহ বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে- (৬৮২০) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন যে নবী করীম (সাঃ) বলেন- কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমরা এক এক বিঘত করে এবং এক এক হাত করে পূর্ববর্তী জাতির অনুসরণ-অনুকরণ করবে। অতঃপর তাঁকে জিগ্যেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পারসিক ও রোমানদের? উত্তরে তিনি বললেন- এঁরা ছাড়া আর কারা হতে পারে?
তা ছাড়া একই ধরণের কথা বলা হয়েছে ইহুদী ও নাসারাদের অনুসরণ সম্পর্কেও। সহীহ বোখারী- (৬৮২১) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন যে নবী করীম (সাঃ) বলেন- তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের পন্থাগুলো অনুসরণ করবে, যে এক এক বিঘত করে এবং এক এক হাত পরিমাণও ব্যবধান থাকবে না। এমনকি তাঁরা যদি গুই সাপের গর্তেও ঢুকে পড়ে; তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকবে। বর্ণনাকারী বলেন- আমরা আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইহুদী ও নাসারাদের? উত্তরে তিনি বললেন- এঁরা ছাড়া আর কারা হতে পারে?
আর এখন তাই হচ্ছে।

আমরা ঈদ’ই মীলাদুন্নবীর নামে মেরি ক্রিস্টমাসকে অনুসরণ করছি। দয়াময় আল্লাহ’তায়ালা আমাদের ক্ষমা করুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।