আমরা অনেকেই হয়তো ভাবি, যা কিছু বহু মানুষের চোখের সামনে ঘটে গেছে, তা বিকৃতির স্পর্শ এড়িয়ে ভাবীকালের মানুষের জন্যে একটি বিবৃতি হয়ে টিকে থাকবে। যা কিছু চাক্ষুষ, যা কিছু স্পষ্ট, যা কিছু প্রত্যক্ষ, তা কীভাবে পাল্টাতে পারে? এক নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে আমরা আমাদের দেখা সময়কে অর্পণ করে দিই কনিষ্ঠদের হাতে। তারা কি আমাদের চোখ দিয়েই সে সময়কে দেখতে পায়?
আমার অভিজ্ঞতা বলে, পায় না। এ কারণেই মতিঝিলে অপারেশন শাপলায় হাজার হাজার হুজুর মরার গুজব একটা মিথ হিসেবে দীর্ঘায়িত হয়। শাহবাগে উচ্ছৃঙ্খলতার গুজব শাহবাগ ও ফেব্রুয়ারি থেকে একটু দূরবর্তী স্থান ও কালে গিয়ে রটনাকারীর হাতে পড়ে মিথে পরিণত হয়।
কাদের মোল্লা দাবি করতে পারে, কসাই কাদের সে নয়, কোনো ভিন্ন লোক।
আমাদের ক'জনই বা পুরোনো খবরের কাগজ ঘাঁটি? ক'জন একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি? আমাদের স্বস্তি পরিশ্রম না করার মধ্যে। তাই আমরা নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পণ করি প্রোপাগাণ্ডার কাছে। এ সুযোগ কাজে লাগায় সমাজের দুর্জন।
আমি একাধিকবার বিভিন্ন সময়ের মানুষের কাছে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা চেয়েছি, বেশিরভাগ সময়ই আমার যাচিত আখ্যান আর রূপ পরিগ্রহ করেনি।
আইয়ূবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবের শাসনকাল, জিয়াউর রহমানের শাসনকাল, এরশাদের শাসনকাল, এরকম অনেক অধ্যায় নিয়ে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনুরোধ করেছি। তারা কেউ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলে গেছেন, কেউ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আজ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় অনুভব করলাম, সময়কে খবরের কাগজ একা ধরে রাখতে পারে না। খবরের কাগজে তথ্য আছে, কিন্তু তার কাছে ফিরে যাওয়ার আকর্ষণ ততোটা নেই। সে আকর্ষণ আছে সাহিত্যে।
গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, কবিতায়। সে কারণে যা কিছু আমাদের সমকাল, তাকে সাহিত্যে গেঁথে ফেলাটা খুব জরুরি। আজ এক তরুণী হাসতে হাসতে আমাকে বলছিলেন, এরশাদ তো একটা জোকার। আমি এরশাদের শাসনামলে নিতান্তই বালক ছিলাম, কিন্তু আমি খুব ভালো করে জানি, এরশাদ কোনো জোকার নয়, সে একটা ভয়ানক রক্তপিপাসু নৃশংস লোক ছিলো। আমাদের রাজনীতির পরিমণ্ডল তাকে ভাঁড়ের মুখোশ পরার সুযোগ করে দিয়েছে, আর শিল্পী ও সাহিত্যিকদের নিষ্ক্রিয়তা তাকে সে মুখোশ ক্রমাগত পরে থাকার সুযোগ দিয়েছে।
এরশাদের হাতে রক্তের দাগ শুধু সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে আসেনি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সে রক্তের দাগের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, সে সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের অবহেলা। জামাতশিবির এই অবহেলাকে পুঁজি করে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে হয়েছে দানব, আর এরশাদ হয়েছে ভাঁড়।
আমি তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ করবো, লিখুন। গল্প লিখুন, উপন্যাস লিখুন, নাটক লিখুন সমকালকে নিয়ে (কবিতা লেখার কথা বললাম না, কারণ কবিতা লিখতে পারেন খুব অল্প কিছু গুণী মানুষ, বাকি যা লেখা হয় তা কবিতার নামে শব্দবিষ্ঠা)। শাহবাগের মতো প্রচণ্ড একটি ঘটনা নিয়ে শাহবাগে শামিল হওয়া এতো গুণী মানুষেরা খুব বেশি গল্প লেখেননি।
গল্প লিখেছে হাসনাত আবদুল হাই আর অদিতি ফাল্গুনীর মতো শাহবাগের পিঠে ছুরি মারা প্রতিক্রিয়াশীলেরা। সমকালকে এভাবে নষ্ট করার দৌড়ে তাদের জন্যে মাঠ পিটিয়ে সমান করে দিয়েছে দুর্বৃত্ত প্রথম আলো। আমাদের নিষ্ক্রিয়তা একদিন সেই বিকলাঙ্গ সাহিত্যের জন্যে র্যাম্প তৈরি করে দেবে, আর সে র্যাম্পে চড়ে মঞ্চে উঠবে অসত্য ও বিকারে ভরা ইতিহাস, যা ঘটেনি কখনো।
আসুন লিখি। প্রথম একটা দুটো লেখা হয়তো কাঁচা হবে, কিন্তু তারপর আপনার হাতকে সচল রাখবে আপনার চোখে দেখা সময়।
তাকে নিজের ভেতরে বন্দী করে রেখে হনন করবেন না। অনাগত সময়ের মানুষের পাশে যদি নিঃশঙ্ক চিত্তে দাঁড়াতে চান, তাদের জন্যে আপনার চোখে দেখা সময়কে লিখে রাখুন। লিখুন, কে ভাই, কে দুশমন। ভাবীকালের তরুণের স্লোগান আপনাকে লিখে রেখে যেতে হবে, আজ, এখনই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।