আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুদ্ধিজীবি হত্যার অন্তর্নিহিত কারন

সত্য আর মিথ্যার মধ্যে নিরপেক্ষতা নয়

এখন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবি হত্যার কারন হিসাবে সবাই বলেন দেশ যেন চলতে না পারে সেজন্য এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। সেটা অবশ্যই ঠিক, তবে এর বাইরে আরো গভীর কিছু বিষয় আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত: পাকিস্তানি বাহিনী ১০ ডিসেম্বরের পরই আত্মসমপর্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তখন তাদের মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল পাকিস্তানি সামরিক এবং আধাসামরিক (রাজাকার/আলবদর/আল শামস) বাহিনীর সদস্যদের জীবন বাচিয়ে আত্ম সমপর্ন করা। ১৩/১৪ ডিসেম্বরই ইয়াহিয়া নিয়াজীকে সেটা জানিয়ে দেন।

তাহলে সেই সময় এই গর্দভদের যখন চাচা আপন প্রান বাচানোই দায়, তখন তাদের পক্ষে একাকি এমন একটা পরিকল্পনা করা কঠিন ছিল। তবে এদের ব্যক্তিগত জিঘাংসার ধরন আজো আমরা যেমনটা দেখছি (প্রায় প্রতিদিন তারা কোন না কোন খানে কোন না কোন আলীগ নেতাকে নিরস্ত্র আবস্থায় কুপিয়ে বা আগুন দিয়ে হত্যা করছেন) সেটা চিন্তা করলে এটা স্বাভাবিকই মনেহয়। একইসাথে তাদেরকে যে কেউ কিছু করতে পারবেনা –এমন একটা আত্মবিশ্বাস তাদের সবসময়ই ছিল। যেমন ইয়াহিয়ার সেই চিঠিতে পাকিস্তানী বাহিনীর যে কিছু হবে না, এইরকম যোগাযোগ উনি জাতিসংঘের সাথে আগেই করে রেখেছেন বলে নিয়াজীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর ১০ ডিসেম্বর জামাতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম শিরোনাম করে –‘আমাদের সাথে আমেরিকা আর চিন আছে, ভয় পাবার কিছু নাই’।

তারপরো আমার ধারনা, এই পরিকল্পনার পেছনে আরো শক্তিসালী কেউ ছিল। মনে রাখতে হবে আত্মসমপর্ন ১৬ তারিখ বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কিন্তু আরো আগের। সম্প্রতি জানা গেছে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের চিঠি আমেরিকা ১৮ ঘন্টা নিজের কাছে আটকে রেখেছিল। (পাকিরা আত্মসমপর্নের চিঠি কিন্তু দিয়েছিল তাদের আব্বাজান আমেরিকাকে !)। আমেরিকা সব সময়ই একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা মাথায় রেখে কাজ করে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় যখন অবিসম্ভাবি, তখন তাদের করনীয় কি ? হয় বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুন দেশের সরকারের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন (যেটা প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু অন্তত সম্ভব ভেবেছিলেন !) অথবা নতুন সরকারকে হঠিয়ে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। এই পরিকল্পনা তারা আগেই নিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে অন্তত নয়। আমরা আজ জানি বাংলাদেশের জন্মটা ছিল কিসিন্জারের জন্য ব্যক্তিগত পরাজয়। ৩ টি ঘটনা তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিপযর্স্ত করেছিল, যার পেছনে ছিলেন তিন মহামানব – থিউ, আলেন্দে আর মুজিব।

কিন্তু তাদের উপরে প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া সম্ভব ? ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানন্ত্রী মোসাদ্দেক কে দিয়ে শুরু সিআইএর ষড়যন্ত্র, আর কু্ বাস্তবায়নের দীর্ঘ ইতিহাসের। ইরানের ঘটনায় সিআইএর হাত থাকার কথা সম্প্রতি ওবামা স্বীকারো করেছেন। এরপরে আরো অসংখ্য দেশে বছরের পর বছর সিআইএ এই কাজ করে গেছে সিদ্ধ হস্তে। তাহলে সেটই যে করতে হবে বাংলাদেশে তা নির্ধারিত হয়েছিল নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালেই। তাজউদ্দিনের কথা এই ক্ষেত্রে না বললেই নয়।

কি আশ্চর্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল তার ! ৭১ সালেই বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রায়ই তিনি একটি কথা বলেতন যে ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে বিদ্রোহী হিসাবে বিচার করে ফাসি দেয়া হবে। যদি জিতি তাহলে আততায়ির হাতে প্রান হারাতে হবে। ‘ তো বাংলাদেশের নতুন সরকারেক যদি একইরকমভাবে কু্ করে সরাতেই হয় তাহলে সেটা কিভাবে করতে হবে ? ১৯৭১ সালেই সিআইএ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তখনকার মেজরদের (শফিউল্লা, জিয়া সবাই তখন মেজর ছিলেন) কয়েক জনকে রিক্রুট করেছিল, তার দলিল আগেই অবমুক্ত হয়ে গেছে, যদি সেই মেজরের নাম এখনো অবমুক্ত হয়নি। কিন্তু শুধু সেরকম ১ জন থাকলেই তো হবেনা। আরো কিছু পরিক্ষিত টেকনিক আছে সিআইএর কু এক্সপোর্ট করার।

তাদের ব্রাজিলিয়ান এক ডক্টরেট ভদ্রলোক যিনি ল্যাটিন আমেরিকায় সিআইএর এই কার্যপ্রনালী প্রথমদিকে প্রয়োগের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি তখন মার্কিন এক পত্রিকায় সগর্বে সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন ‘কেক তৈরীর প্রনালী রেডি, এখন শুধু ভাজো আর খাও !’। তো এই ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ সম্বন্ধে বিস্তারিত আমরা জানি চার্চ কমিটির প্রতিবেদন নামে বিখ্যাত মার্কিন কংগ্রেসের এক তদন্তে, যেখানে সিআইএ আসলে কি কি করছে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার নামে সেটা নিয়ে তদন্ত করা হয়। আর এটার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ১৯৭২ সালে চিলির নির্বাচিত ক্যারিশমাটিক নেতা সালভাদর আলেন্দে হত্যা এবং ক্যুর ঘটনায় সিআইএর যুক্ত থাকা। এর মাধ্যমে আমরা প্রথম অফিসিয়ালি জানতে পারি তারা বিশ্বজুড়ে এই সব কাজ করছে আর তার জন্য কি কি টেকনিক প্রযোগ করছে। যদিও আলেন্দে হত্যার পরপরই এক সাক্ষাতকারে আমেরিকার আরেক শত্রু (একমাত্র যাকে তারা হাজার বার মারা চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হয়েছে) ফিডেল ক্যস্ট্রো বলেন, ‘আলেন্দে মারা গেছেন আসলে অতিমাত্রায় গনতন্ত্রের জন্য।

তার দেশে সবারই ষড়যন্ত্র করার অধিকার ছিল। বিরোধী প্রেস ষড়যন্ত্র করেছে এবং ক্যু সফল করেছে। ‘ একই রকম আরেক নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশে ৭৫এর জুনে ৪টি বাদে বাকি সংবাদপত্র নিষিদ্দ করার সময় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ‘ চার্চ কমিটির রিপোর্ট থেকেও আমরা জানতে পারলাম চিলির নেতা আলেন্দেক হত্যায় এবং তার আগের বারের নির্বাচনে তাকে হারানোতে সিআইএর প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল। তারা কি টেকনিক ব্যবহার করেছিল, তার উপর চার্চ কমিটির রিপোর্টে একটা বিস্তারিত অধ্যায়ই আছে।

সেটা থেকে জানা যায় তাদের মূল টেকনিক ছিল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোপাগাণ্ডা চালানো। আর এই কাজে তাদের মূল অস্ত্র ছিল প্রথম আলো ...দু:খিত... এল মারকুরিও নামের একটি দৈনিক পত্রিকার। এছাড়া ছিল অর্থনীতিকে আক্রমন করা। যেটাও কিনা আমরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখেছি যখন কিনা খাদ্য বোঝাই জাহাজ আমাদের বন্দরের কাছ থেকে ফেরত নিয়া যাওয়া হয়েছিল দূবিক্ষ নিশ্চিত করার জন্য। তো এই টেকনিক যদি হয় ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ যা কিনা ১৯৫৩ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আর সেই প্রনালী যদি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সিদ্ধান্ত ৭১ সালেই নেয়া হয়ে থাকে (বাজী ধরতে পারেন আমেরিকা ঠিক এতোটাই এডভান্স চিন্তা করে)। তাহলে সেই প্রোপাগাণ্ডা চালানোর জন্য প্রধান বাধা কারা? জাতির সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়, অর্থাত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মানোর সময়ে যারা অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন- সেই সব বুদ্ধিজীবিরা নয় কি ? আর তাদের অনেকেই তখন নিরস্ত্র, বেসামরিক মানূষ, কলম যোদ্ধা। তাই ১৪ ডিসেম্বর তাদের হত্যা করাই কি মোক্ষম নয় ? ১৪ ডিসেম্বর যে সুদুর প্রসারী চক্রান্ত্রের সূচনা হয়, তা পরবতিতে ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে গেছে সিআইএ। যে কারনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরীক্ষিত গুনি শিল্পীদের অনেকেই, যারা বেচে ফিরেছিলেন, তারা পরবর্তিতে দৈন্যদশায় ধুকে ধুকে মরেছেন। আর অব:প্রাপ্ত, আমলা, হঠাত গজিয়ে উঠা বুদ্ধিজীবিরা, যাদের ভালো কোন সাহিত্য কর্ম কোনদিন দেখেন নি, তারা সেজেছেন জাতির বিবেক- ‘সুশিল সমাজ’।

এমনিক আজো মুনতাসির মামুন, গাফফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, ড: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা ড: আনোয়ারকে কিভাবে ধীরে ধীরে লেবেল মেরে, প্রান্তিক আর অপ্রাসংগিক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুক্ত চিন্তার দৈনিক আর তার সহচর অন্যান্য দৈনিক/টিভি গুলো। তাদের একমাত্র অযোগ্যতা- তারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে কেনা দিন বেইমানি করতে পারেন না। ৭১ সালে যেমন তথাকথিত নিরপেক্ষ হতে পারেন নি, আজো না। আর নতুন প্রজন্মের ইমরান এইচ সরকার, নিঝুম মজুমদার, মারুফ রসুলদেরৃ মিথ্যা নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যার সকল আয়োজন করে রাখা হয়েছে। আজ থেকে ৪২ বছর আগে এই দিনে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে বীষ বৃক্ষের বীজ বোপন করা হয়েছিল, আজ তারই শাখা প্রশাখায় দেশের সব মিডিয়া ছেয়ে গেছে।

আর তাতে ভর করে ৭১ এর শকুনেরা আবারো আমাদের মানচিত্র হিংস্র থাবায় রক্তাত্ত করছে প্রতিদিন। ৭১ এ আমরা জিতেছিলাম, ২৯১৪ তে কি হবে ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.